এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৪১ এএম
আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২৪ এএম
খবর : জালিয়াতি, মিথ্যে তথ্য, দুর্নীতি ও টেন্ডার ঘাপলার অভিযোগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে ফিফা নিষিদ্ধ ও জরিমানা করেছে।
আরও পড়ুন : আপিল করবেন ‘অবিচারের শিকার’ সোহাগ
আরও পড়ুন : সোহাগের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
আরও পড়ুন : জালিয়াতির অভিযোগে বাফুফের সোহাগকে নিষিদ্ধ করল ফিফা
আরও পড়ুন : এখনই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না বাফুফে
আরও পড়ুন : ‘শাস্তিটা শুধু সোহাগকে দিলে হবে না’
লম্বা সময় নিয়ে সোহাগের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেছে ফিফা। শুনানিতে তাকে ডেকেছে। সবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছে জানিয়েছে সোহাগ অপরাধী। আর্থিক অনিয়ম, জোচ্চুরি, জালিয়াতি ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। ফিফার অনুদানের অর্থ তার সইয়ে নয়ছয় হয়েছে। শাস্তি হিসেবে ফিফা সোহাগকে এই পদে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। সেই সঙ্গে সোহাগকে ১২ লাখ টাকাও জরিমানা গুনতে হবে।
প্রশ্ন ১ : বাফুফে সাধারণ সম্পাদক সোহাগের বিরুদ্ধে ফিফা যখন এই অভিযোগ আনল তখন বাফুফে সেটা কেন নিজেরাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি। অভ্যন্তরীণ তদন্ত বলে একটা কথা তো আছে। বাফুফের ডিসিপ্লিন এবং এথিকস কমিটিও আছে। কই তারা কেন তখন কোনো ব্যবস্থা নিল না?
প্রশ্ন ২ : সোহাগের বিরুদ্ধে ফিফা এমন গুরুতর অভিযোগ এনে তদন্ত করছে, সেটা কখনও মিডিয়াকে জানায়নি বাফুফে। কেন এই লুকোছাপা করল বাফুফে? এমন তথ্য বাফুফে কেন গোপন করবে? বাফুফে কি কোনো গোপনীয় সংস্থা?
প্রশ্ন ৩ : বাফুফের শীর্ষকর্তারাই ফেডারেশনের অনেক তথ্য জানেন না। বা তাদের জানানো হয় না। অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলতে যে মেয়েদের সফর বাফুফে বাতিল করে দিয়েছে সেটা বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদী জানতেনই না বলে জানিয়েছেন। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত হলো অথচ ফেডারেশনের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর পদধারী ব্যক্তিকে কেন তা জানানো হবে না? বাফুফেতে তাহলে কে কখন কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়- তার কোনো বিধিবিধান কি নেই?
প্রশ্ন ৪ : সোহাগের জালিয়াতি ফাঁসের পর বাফুফে তো এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। এই দায়ভার কি কেবল সোহাগের, নাকি বাফুফের পুরো পরিচালনা কমিটির?
এবার উত্তর মেলাই।
বাফুফের যেসব কেনাকাটা এবং টেন্ডার নিয়ে দু’নম্বরি করেছেন সোহাগ সেই ফাইলগুলো কি বাফুফের শীর্ষকর্তাদের টেবিল ঘুরে আসেনি? অবশ্যই এসেছে। তাদের সম্মতি পাওয়ার পরই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোহাগ সেই ফাইলে কেবল সই করে সেটা অনুমোদন করেছেন। যেহেতু এসব ফাইলে সই তার তাই তাকেই আটকেছে ফিফা। কিন্তু ফাইলে সই সোহাগের থাকলেও সিদ্ধান্ত কি এককভাবে দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন সোহাগ? অবশ্যই না। বড় কর্তার ইঙ্গিত না থাকলে এসব ফাইলের তো গিট্টুই খোলার কথা না! সেই বিবেচনায় তো এটা সামগ্রিক অর্থে বাফুফের পুরো পরিচালনা কমিটির দায়। তাদের পিঠের চামড়া বাঁচানোর উপায় কই? সবচেয়ে বড় দায় খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের। সোহাগ তো বাফুফের চাকুরে। তিনি ওপরের স্যারের নির্দেশ কেবল পালন করেন। ওই যে কথায় বলে না- খায় দায় আকবর, ধরা খায় জব্বর!
এই মুহূর্তে বাফুফের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল নতুন কাউকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। কারণ ফিফার আদেশে গত শুক্রবার থেকেই তো সোহাগ নিষিদ্ধ। তার তো অফিসেই প্রবেশের এখন আর সুযোগ নেই। কিন্তু শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সালাউদ্দিন যা বললেন সেটাকে সোহাগের পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতোই মনে হলো!
অদ্ভুত বিষয় হলো বাংলাদেশের ফুটবলে যত অপকর্ম হয় তার প্রায় সবই কেন শুধু ফিফা এবং এএফসিকে তদন্ত করতে হবে? বাফুফের ডিসিপ্লিন কমিটির কাজ কী তাহলে? ঘরোয়া ফুটবলে পাতানো খেলার শাস্তি দিল এএফসি। এখন জালিয়াতি ও দুর্নীতির শাস্তি দিল ফিফা। তাহলে বাফুফে কী করে? ফিফা-এএফসি বাইরে থেকে এসে বাফুফের দুর্নীতি ধরে ফেলে আর এই ভবনের বড়কর্তার চেয়ারে বসেও সেই দুর্নীতি, জালিয়াতি সালাউদ্দিন কেন টের পান না? কুয়ালালামপুর থেকে এএফসি এসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাতানো ম্যাচ খুঁজে বের করে ফেলে আর স্টেডিয়াম থেকে হাঁটা দূরত্বে থেকেও বাফুফে সভাপতি এসব দু’নম্বরি দেখতে পান না। জুরিখ থেকে ফিফার এথিকস কমিটি এসে তার সাধারণ সম্পাদকের জোচ্চুরি ধরে ফেলে আর মতিঝিলে একই ভবনের পাশের কক্ষে বসেও সেটা টের পান না। নাকি সব জেনেও তিনি চুপ থাকেন। এই দেখতে না পাওয়া অথবা চুপ করে বসে থাকা- দুটোই তার বড় ব্যর্থতা। কাজী সালাউদ্দিন এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কি না সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু তার দপ্তরে ঘটে যাওয়া এই দুর্নীতি ধরা তো তার কাজ। সেটা তিনি পারেননি। এই ব্যর্থতার প্রেক্ষিতেই বাফুফে সভাপতির চেয়ারে বসার নৈতিকতা তিনি হারিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হাত পেতে টাকা চাওয়া ছাড়া আপাতত বাফুফের আর বড় কোনো কাজ নেই। ভিক্ষার সেই হাত কখনও পাতেন তারা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দরবারে। কখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ে। কখনও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কাছে।
বাফুফে সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ এনেছে ফিফা, সেই পরিমাণ কিন্তু খুব বড় নয়। সামান্য কয়েক লাখ টাকা মাত্র। কিন্তু এই দুর্নীতির মাত্রা এবং এর ব্যাপকতা অনেক বড়। বল কেনা, বিমান টিকিট ক্রয় এবং যে প্রক্রিয়ায় অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ভুয়া টেন্ডারে অংশ নেওয়ার জালিয়াতির সঙ্গে বাফুফে জড়িয়েছে তাতে আন্তর্জাতিক ফুটবল পরিমণ্ডল এবং বহির্বিশ্বে এই দুর্নাম ও কালির ছিটা যে বাংলাদেশের গায়েও লাগছে।
খেলোয়াড়ি জীবনে সালাউদ্দিনের একটা বিজ্ঞাপন টিভির পর্দায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। দৃশ্যটা এমন ছিল- মাঠ থেকে ফিরে সালাউদ্দিন গায়ে সাবান ঘষছেন আর ময়লা দূর হচ্ছে। সেই দৃশ্য এখন বদলে গেছে। এখন নাক পর্যন্ত ময়লা, অদক্ষতা আর ব্যর্থতায় ডুবে যাওয়া বাফুফের সালাউদ্দিন যে নিজেই নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না!