জালিয়াতি কাণ্ডে সোহাগের সেই তিন সঙ্গী কারা?
এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:০৫ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২০ এএম
আবু নাঈম সোহাগের বিচার করতে দু’বছরের বেশি সময় নিয়েছিল ফিফা। তাকে শুনানির জন্য জুরিখে ডেকেছিল। আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে সোহাগ নিজের বক্তব্যও উপস্থাপন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। দু’বছরের লম্বা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ফিফা তাকে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক পদে দু’বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। সঙ্গে ১২ লাখ টাকা জরিমানা।
আরও পড়ুন : সোহাগের জালিয়াতি, সালাউদ্দিনের কি দায় নেই?
আরও পড়ুন : ফুটবলের স্বার্থেই সালাউদ্দিনের পদত্যাগ করা উচিত
আরও পড়ুন : কোনো দুর্নীতি হয়নি, দাবি সালাম মুর্শেদীর
আর বাফুফে সোহাগের বিচার করতে সময় নিল মাত্র দুদিন। ফুটবল অঙ্গনে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছে বাফুফে। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে বাফুফে নিজস্ব নিয়মে তদন্তেরও ঘোষণা দিয়েছে। সেই তদন্ত কমিটিতে আছেন ১০ জন!
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বলছেন, সোহাগ ভুল করেছেন। কাজের ভুল। সেই ভুলের জন্য ফিফা তাকে শাস্তি দিয়েছে। বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সোহাগকে সেটা তিনি প্রপারলি করেননি। এর দায় পুরোপুরি ব্যক্তিগতভাবে সোহাগের। আমরা কোনো দোষ নেব না।
তবে দোষ বা দায় না নেওয়ার গলাবাজি করলেও সেটা কার্যত কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বাফুফে। সোহাগের বিরুদ্ধে ফিফা যে ৫২ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে সেখানেই স্পষ্ট এই জালিয়াতি, অনিয়ম ও টেন্ডার ঘাপলার সঙ্গে শুধু সোহাগ একা জড়িত নন। তার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত। খেলার পোশাক ক্রয় বাবদ স্পোর্টস লিঙ্ককে ৩০ হাজার ডলার প্রদানের জন্য সোহাগসহ আরও তিনজন অনুমোদন এবং নির্দেশ দেন।
এখন প্রশ্ন হলো এই তিনজন কে?
নিশ্চয় তারা বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির কেউ। এবং অতি অবশ্যই পদমর্যাদায় সোহাগের চেয়ে সিনিয়র। এই ক্রয় অনুমোদনের জন্য সোহাগ শাস্তি পেলে অতি অবশ্যই বাকি তিনজনও সমান শাস্তিযোগ্য। কিন্তু যেহেতু সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই ক্রয় অনুমোদন প্রস্তাবে সোহাগের স্বাক্ষর রয়েছে, তাই ফিফা শুধু তাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং শাস্তি দিয়েছে।
ভাবার কোনো কারণ নেই সোহাগ বাফুফের এই ক্রয় অনুমোদন ও ঘাপলাবাজি টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাকী জড়িত ছিলেন। এটা নিশ্চিত যে তিনি শুধু তার সিনিয়রের আদেশ মেনেছেন।
কোনো একটা ঘটনার তদন্তের জন্য ১০ জনের কমিটি কেন ডাকবে? এত লম্বা কমিটি করার কারণ কী? এতদিন যারা সোহাগের ‘ সোহাগ’ পেয়ে আপ্লুত ছিলেন সেই তারাই এখন তার বিচারের জন্য কোমর কুঁদে নেমেছেন। তার কারণ একটাই- নিজেদের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে যে! তদন্ত কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা হয়তো সবাই ভীষণ ক্ষমতাবান। কিন্তু তাদের সবাই কি গুণ-মান আর কাজের দিক থেকে পরিষ্কার?
ফুটবল ফেডারেশন কখনোই সোহাগকে সমর্থন করেনি। মূলত তারা তাকে ব্যবহার করেছে। এখন ব্যবহার ফুরিয়েছে। তাই বাফুফের কাছে তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে গেছে। সোহাগের জালিয়াতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং অনুদানের নয়ছয়ের বিচার তো ফিফা করেই দিয়েছে। এই তদন্তে বাফুফের আর বাড়তি করার কী আছে। কিছুই নেই। লোক দেখানো পাঁয়তারা কেবল। এই অনিয়মের সঙ্গে সোহাগ ছাড়া আর কেউ জড়িত আছে কি না- বরং সেটাই বাফুফের খুঁজে বের করা উচিত ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি। বাইরের কোনো অডিট ফার্মকে দিয়ে পুরো হিসাবের অডিট করানো উচিত ছিল। এই তদন্ত কার্যকলাপ এবং প্রক্রিয়ায় বাফুফের কেউ থাকবে না। পুরো তদন্তকাজকে প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য এটাই হতো উপযুক্ত কাজ। কিন্তু নিজ কার্যনির্বাহী পরিষদের ১০ জনকে দিয়ে সোহাগের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি পরিচালনার অর্থই হলো বাফুফের নিজের চামড়া বাঁচানোর চেষ্টা। যে সিনিয়রদের নির্দেশে সোহাগ এই অপকর্ম করেছিলেন তাদের নাম কি এই তদন্ত কমিটি সামনে আনতে পারবে?
কোনোদিনও পারবে না?
সোহাগ বাফুফেতে সব কাজ কি শুধু নিজের সিদ্ধান্তেই করেছেন? তাহলে এক্সিকিউটিভ কমিটির কাজ কী? সোহাগ হচ্ছেন এক্সিকিউটিভ অথরিটি। পলিসি মেকিং বা নীতিনির্ধারণ স্থির করার দায়িত্ব হচ্ছে বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির। এই কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেবে বা নীতি গ্রহণ করবে, সোহাগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেটার বাস্তবায়ন করবেন। চাকরির শর্ত অনুসারে সোহাগ সেই সিদ্ধান্ত পালন করতে বাধ্য। একটি পেশাদার সংস্থার এটাই আদর্শ কর্মপদ্ধতি। এই কার্যনির্বাহী কমিটি যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্তও দেয় তারপরও সোহাগের সেটা বাস্তবায়ন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
তাহলে সূত্র কী দাঁড়াল?
বাফুফের কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আদেশ দিয়েছে। আর সোহাগ বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে সেই সিদ্ধান্ত পালন করেছেন মাত্র। এখন সেই সিদ্ধান্ত বা নীতিনির্ধারণ যদি ভুল বা অনিয়ম হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং সেটা যদি তদন্ত করতে হয় তাহলে সেই তদন্ত কমিটিতে কার্যনির্বাহী কমিটির কাউকে রাখার তো কোনো সুযোগই নেই। সোহাগকে ফিফা জালিয়াতি, অনিয়ম, অর্থ নয়ছয়ের জন্য শাস্তি দিয়েছে; কিন্তু সেই সঙ্গে এটা স্পষ্ট যে, একই অভিযোগের তীর বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির দিকেও উঠেছে। ফিফার তদন্ত রিপোর্টই তার বড় প্রমাণ। সেই তদন্ত রিপোর্টের ৫ নম্বর পৃষ্ঠার ১৬ ও ১৮ নম্বর পয়েন্টে সোহাগ ছাড়াও তিনজন ব্যক্তির সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জনৈক এই ব্যক্তিদের কি খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা করবে বাফুফে?
বাফুফে যদি সত্যিকার অর্থেই এমনসব অনিয়মের সঠিক তদন্ত করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বাফুফের বাইরে থেকে নিরপেক্ষ কাউকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া। ক্রীড়া দুনিয়ায় এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনিক বিতর্কের অবসানের জন্য জাস্টিস লোধা কমিটিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানে ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্কে তদন্ত করতে কাইয়ুম কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বাফুফে কি পারত না তেমন সদিচ্ছা বা সৎ সাহস দেখাতে?
দু’বছর ধরে ফিফা সোহাগের বিরুদ্ধে তদন্ত, শুনানি ও বিচারকাজ চালাল অথচ বাফুফে এই সময়ের মধ্যে মিডিয়ার কাছে টুঁ-শব্দও করল না। যখন ফিফা রায় জানাল তখন কুঁদে নামল লোক দেখানো তদন্তে বিশাল বহর নিয়ে। এই তদন্ত না আরেক তামাশার বিষয়বস্তু হয়- এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে!
সোহাগের জালিয়াতি ও মিথ্যাচার, অনিয়ম, তহবিল তছরুপ ও অপব্যবহার ফিফার আনা ইত্যাদি অভিযোগকে সালাম মুর্শেদী ঠিক দুর্নীতি মানতে নারাজ। কেন তিনি এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটাও পরিষ্কার নয়।
দুর্নীতি কী?
সহজ উত্তর নীতির বাইরে যা, তাই তো দুর্নীতি। অনৈতিক, অসম্মানজনক এবং অপরাধপূর্ণ যেকোনো কাজই তো দুর্নীতি। ব্যক্তিগত লাভ বা অন্যের লাভের জন্য ক্ষমতা পদের অপব্যবহারই তো দুর্নীতি। সহজ আরেকটা উদাহরণ আছে- আপনি যেটা জানেন না, সেই মূর্খতা ঢাকতে একগাদা উদাহরণ টানলেন- সেটাও দুর্নীতি।
সালাম মুশের্দী সম্ভবত সেদিন বলতে চেয়েছিলেন ওটা চুমু না কিস!