এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৩ পিএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৬ পিএম
ক্রিকেটে দ্বিতীয় ইনিংস সব সময় বড় চ্যালেঞ্জের। ২৬ টেস্ট খেলা চন্ডিকা হাথুরুসিংহে অবশ্য তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ইনিংসেই বেশি ভালো পারফরম্যান্স করেছেন। টেস্টে তার ৮টি হাফসেঞ্চুরির মধ্যে ৫টিই দ্বিতীয় ইনিংসে। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ৮৩ রানও করেছেন দ্বিতীয় ইনিংসে। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হতে চলেছে। অবশ্য প্রথম ইনিংসেও পারফরম্যান্সের বিচারে বেশ ভালোই সফল ছিলেন হাথুরুসিংহে। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিতে তিনি ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসছেন।
—পুরোনো হাথুরুসিংহের সামনে এই নতুন মেয়াদে মূলত কী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এই প্রশ্নের খুব সুন্দর উত্তর দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার হৈমন্তী গল্পে—‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।’
কোচের দায়িত্ব ছেড়ে একবার চলে গিয়েছিলেন, আবার ফেরত এসেছেন হাথুরুসিংহে। সে সময় তাকে চলে না যাওয়ার জন্য বিসিবি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। অনুরোধও করেছিল। কিন্তু তিনি শোনেননি। বিদেশে বসেই সেখান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই হাথুরুসিংহে আবার ফিরে আসছেন বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের বস হয়ে। চাকরিটা তার যতখানি প্রয়োজন। ক্রিকেটারদের পরিচালনার জন্য বিসিবিও হন্যে হয়ে এমন কাউকেই খুঁজছিল। তবে প্রশ্ন হলো—প্রথমবার তিনি ড্রেসিংরুমে যেমন ওয়েলকাম ওয়েলকাম হয়েছিলেন, এবার দ্বিতীয় দফায় তেমন স্বাগত-শুভকামনা তিনি পাবেন কি না?
আরও পড়ুন: ‘দেড় বছর আগে মাশরাফি বলেছিল হাথুরুকে নিয়ে আসেন’
প্রথম ইনিংসে তার চাকরির সময় তার সম্পর্কে তেমন ঠিকঠাক কেউ জানত না। প্রথম দফা চাকরিতে তিন বছর থাকার পর অনেকের সঙ্গে তিক্ততা, অনেকের সঙ্গে হৃদ্যতাও হয়েছে। হৃদ্যতা বা তিক্তটা দুটোকেই তার আবার ডিল করতে হবে। তিক্ততা যেন তার ক্রিকেটের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে না পারে, সেদিকে তার খেয়াল রাখতে হবে।
এটা স্পষ্ট যে, প্রথম দফায় কোচের দায়িত্বের সময় মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তার তিক্ততা হয়েছিল। মুশফিক তখন টেস্ট দলের অধিনায়ক ছিলেন। অবস্থা এমন যে টেস্টে অধিনায়ক কোথায় কাকে ফিল্ডিংয়ে দাঁড় করাবেন, সেই সিদ্ধান্তও তিনি নিতে পারছিলেন না। মাঠের বাইরে থেকে কোচ সবকিছু স্থির করে দিচ্ছিলেন। মাঠে কাঠের পুতুলের মতো হয়ে থাকতে হচ্ছিল মুশফিককে। এমন একটা অবস্থায় তার সঙ্গে তিক্ততা শুরু হয়। সেই মুশফিক তো এবারও ড্রেসিংরুমে থাকবেন। টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেও টেস্ট ও ওয়ানডেতে তিনি আছেন।
হাথুরুসিংহে প্রথম যখন ২০১৪ সালে আসেন তখন লিটন দাস, মোস্তাফিজুর রহমানদের অভিষেক হয়নি। এর মাঝে এখন তারা বাংলাদেশ দলে শক্ত জায়গায় গেছেন। এখন কোচ যদি এসে ওদের সঙ্গে বাচ্চাদের মতো ডিল করেন তাহলে ওরা কীভাবে নেবেন সেটা দেখার বিষয়। সে যখন প্রথমবার আসে তখন বাংলাদেশের টেস্ট দলের অধিনায়ক ছিলেন মুশফিকুর ও সাদা বলে মাশরাফি। দলে মাশরাফির কিছুটা কর্তৃত্ব ছিল, যে কারণে কোচের কাজটা কিছুটা হলেও সহজ ছিল।
আরও পড়ুন: ‘অসমাপ্ত’ আশরাফুলের অন্য আনন্দ
সাকিব আর মাশরাফির অধিনায়কত্বের ধরন ভিন্ন। মাশরাফির সঙ্গে কারও ব্যক্তিত্বের সংঘাত না হলেও সাকিবের সঙ্গে যে কারও ব্যক্তিত্বের সংঘাত হবে না, তার তো নিশ্চয়তা নেই। তাই এই জিনিসগুলোতে তাকে সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো হচ্ছে রিএন্টিগ্রেশনের পার্ট। প্রথম দফার চাকরিতে হাথুরুসিংহে এটি দারুণভাবে সামলেছেন।
এবার পারবেন?
মূলত ড্রেসিংরুমে সুদৃঢ় ঐক্য ধরে রাখাই হবে তার প্রথম চ্যালেঞ্জ।
প্রথম দফায় দল নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্তে একচ্ছত্র আধিপত্য, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র—সবকিছুই ছিলেন ওই একজন; হাথুরুসিংহে। এখন নির্বাচক প্যানেলে তিনজন আছেন। এই দলে আছেন আবদুর রাজ্জাক।
ক্রিকেটার রাজ্জাকের ক্যারিয়ার শেষ করার পেছনে হাথুরুর একটা ‘অংশ’ আছে। ২০১৪ সালে হাথুরু এসে রাজ্জাকের ক্যারিয়ার পার্মানেন্টলি দ্য এন্ড করে দেন। নির্বাচকদের সঙ্গে কোচের সম্পর্ক কেমন হবে, দল নির্বাচনে যেহেতু তাদের বড় ভূমিকা থাকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে জাতীয় দলের সঙ্গে যেসব স্টকহোল্ডার ইনভলব— সিলেক্টর, ম্যানেজার, খেলোয়াড়, অধিনায়ক প্রত্যেকের সঙ্গে তাকে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন: বিপিএলকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন এবং তা দ্রুতই
এগুলোতে সে কতটা কার্যকর হতে পারবেন তার ওপর তার সাফল্যও নির্ভর করছে। সন্দেহ নেই তিনি ভালো কোচ, তার ক্রিকেটিং আইডিয়া ভালো। এগুলো নিয়ে কখনও প্রশ্ন ছিল না। তার কোচিং স্কিল নিয়ে প্রশ্ন নেই কারও। তার ম্যান ম্যানেজমেন্ট বা মানুষকে কাজে লাগানোর পন্থাটা ঠিকঠাক ছিল না। সেই কারণে তিনি শ্রীলঙ্কাতে সমস্যায় পড়েন। সেখানেও চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বাংলাদেশেও একসময় সমস্যায় পড়েছেন। তাকেই এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। কারণ তিনি এখানে আবার নতুন করে আসছেন। বাকি যারা ছিলেন তারা আগে থেকেই আছেন।
অতএব পুরোনো হাথুরুসিংহের সামনে প্রথম নতুন চ্যালেঞ্জের নাম ড্রেসিংরুমে স্বস্তি আনা।
হাথুরুসিংহের প্রথম শুরুর সময়ে বাংলাদেশ টেস্টে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল পুরোদস্তুর স্পিন ট্র্যাক গড়ে। তাৎক্ষণিক জয়ের জন্য অনেকে হাথুরুসিংহের সেই কন্ডিশন-সহায়ক পরিকল্পনাকে সঠিক নয় বলে দাবি তুলেন। তবে বাস্তবতা হলো সেই সময় বাংলাদেশের জয়ের প্রয়োজন ছিল। এবং সেটা যেকোনো বিচারেই। টেস্টে হোম অ্যাডভানটেজ সবাই নেয়, বাংলাদেশও নিয়েছে। হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ এটা করেছে। এবং এটা করে টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে, তাও আবার একদম যা-তা উইকেটে। হাথুরুসিংহে অন্তত যা-তা উইকেট করেননি, তিনি স্পিনিং উইকেট বানিয়েছিলেন। স্পিনারদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, পেস বোলারদের কম। সেটা কোচের স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। কোচের স্ট্র্যাটেজি সফল হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সাফল্য আসছে তা নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এবং পাস ফেল
বাংলাদেশ যে আবার কবে অস্ট্রেলিয়াকে হারাবে, তার নিশ্চয়তা কী! অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার তো সুযোগ আসে পনেরো বছরে একবার। তো নেক্সট জয় কবে আসবে তা কে জানে। বাংলাদেশ কখনও ভাবেনি অস্ট্রেলিয়ার মতো টেস্ট দলকে তারা হারিয়ে দেবে। অস্ট্রেলিয়াও গর্তে ছিল, বাংলাদেশও কৌশল নিয়েছে। তো এটার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তার কাজ হচ্ছে সফলতা আনা। তো সেটি করতে যে ফর্মুলা সেটি তিনি করেছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দায়িত্ব তো হাথুরুসিংহের না। সেটার দায়িত্ব সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের, জালাল ইউনুসদের তথা বিসিবির। হাথুরুসিংহে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে চাকরি করেন, ওই সময়ে তিনি সফলতা এনে দেবেন এটা তার কাজ। দীর্ঘমেয়াদির ব্যাপারটি দেখবেন বিসিবির বড় কর্তারা। ওটা নিশ্চিত করার জন্যই তারা ওই হটচেয়ারে।