× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অর্থ খাতের গুরুতর ব্যাধি

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১২ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

চলমান বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের সমস্যা যুক্ত হয়েছে। চলতি মাসে হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের খবর সংবাদমাধ্যমেই পাওয়া গেছে। অর্থ পাচার রোধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জোরালো পদক্ষেপ বরাবরের মতোই ক্ষীণ। প্রশ্ন হলো, হুন্ডির মাধ্যমে কখন অর্থ পাচার হয়? যখন কেউ দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থ পাঠাতে চায়, আর বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চায়, তা হাতে হাতে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। ফলে বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চান, তা বিদেশেই থেকে যায়। সেই অর্থ পাচারকারীদের হাতে বিদেশে তুলে দেওয়া হয়। আর দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করেন, তারা তা হুন্ডিচক্রের হাতে তুলে দেন।

দেশ থেকে অনেকেই বিদেশে নগদ ডলার নিয়ে গেলেও কেউ বস্তায় ভরে বিদেশে টাকা নিয়ে যান না। কারণ, বিদেশে বাংলাদেশি টাকার কোনো মূল্য নেই। যখন কারও বিদেশে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন শুধু ওই অর্থের মূল্য ডলারের মাধ্যমে বিদেশে স্থানান্তর হয়। দেশীয় টাকার বিপরীতে বিদেশে ডলার পেয়ে যান পাচারকারীরা। অবৈধ এই স্থানান্তরের ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এমন সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডলারের বাজারদর বিবেচনায় রাখা হয় না। অথচ এই ডলার যদি বৈধ পথে আসত, তা হলে দেশের ব্যাংকগুলো ডলার পেত এবং তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও যুক্ত হতো। এর পর আমদানির ক্ষেত্রে সেই ডলার খরচ করা যেত। ডলারের যে সংকট চলছে, তাও এতটা প্রকট হতো না। রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসীদের পরিবার পেলেও দেশে প্রকৃতপক্ষে ডলার আসছে না। বরং উল্টো পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থ। অভিযোগ আছে, আর্থিক সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান নানাভাবে এই হুন্ডি প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। নজরদারির অভাব থাকায় এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া ‘আন-অথরাইজড' অর্থ অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেন। কিছু কিছু অর্থের চালানের জন্য হুন্ডিই একমাত্র পন্থা। এর পেছনের কারণ, বিদেশে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে গেলে এর সোর্স সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করা হয়। তা ছাড়া কাগজ ও দলিলাদি সমর্পণের মাধ্যমেই ওই অর্থ ব্যবহারের বৈধতা পান। তাই অনেকে হুন্ডির আশ্রয় নেন।

আবার কেউ অর্থ স্থানান্তর করে বেশি রেট পাওয়ার আশায় হুন্ডিতে জড়ান। হুন্ডি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাদের সক্রিয় ভূমিকা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করতে সহায়ক হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বরাবরই ব্যর্থ। কারণ অর্থ পাচার যে মাধ্যমেই হোক, ব্যাংক ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। আমরা জানি, অর্থপাচার নিয়ে এ পর্যন্ত কথা হয়েছে যত কাজের কাজ হয়নি তত। ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে সমন্বিতভাবে এ ব্যাপারে নির্মূহ অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও অপচয়- এসব সমস্যা আগে থেকেই চলছিল। সেগুলোর সমাধান হয়নি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চলমান বৈশ্বিক সমস্যা। এখনকার এই খারাপ পরিস্থিতিও হয়তো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব; কিন্তু বাজার, ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্মদক্ষতা সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আর ব্যষ্টিক পর্যায়ে স্থানীয় সরকার বলে কিছু দেখা যায় না। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নেই, অর্থাৎ বাড়ির ওপরের দিকটা সব ঠিক দেখালেও ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে আছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রেরই অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সংকটাপন্ন মুহূর্তেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ভালো অবস্থানে আছে। যেসব খাতে আইএমএফ কিছু শর্ত দিয়েছে, সেসব খাতে দ্রুত সংস্কার করা জরুরি। অর্থনীতির বিকাশে প্রতিবন্ধক এমন সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। আমরা জানি, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার ফলে আমাদের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমছে। কিন্তু গত রমজান মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আশানুরূপভাবে বেড়েছে। যেকোনো উৎসবের আগে এমনটা হয়। প্রক্রিয়া যেমনই হোক, আর্থিক খাতুে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দূর করতে না পারলে কখনই সামগ্রিকভাব অর্থনীতির ঔজ্জ্বল্য আশা করা যাবে না।

আমি মনে করি, দেশে ডলারের একাধিক রেটের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আমাদের এই সমস্যায় পড়তে হবে না। কারণ ভিন্ন ভিন্ন রেট থাকায় অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের চেষ্টা করেন। এমনকি এমএফএসের মাধ্যমেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসা হচ্ছে নানাভাবে। এসব বিষয়ে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক খাতের সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারব বলে মনে করি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যে বিষয়গুলোর কথা বলেছি, সেগুলোর সমাধান আগে করলে আমরা আরও স্থিতিশীলতা পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষত অর্থনীতির অবস্থা স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। বর্তমান সরকার এ বিষয়ে 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র নীতি ঘোষণা করেছে। প্রতিটি খাতে যদি সুশাসন-স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়, তা হলে আর্থিক খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর্থিক খাতের ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তরিক অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানো কঠিন কিছু নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচলিত আইন মোতাবেক কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হবে। আর্থিক খাতে অনিয়ম বন্ধে আমাদের আইন যে নেই, তা তো নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব আইন প্রতিপালন কিংবা মেনে চলার বিষয়ে অনেকেরই সচেতনতা কিংবা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু আইন অমান্যের উগ্রতাই অনেক ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত। খেলাপি ঋণ এবং কোনো কোনো ব্যাংক সংকটগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার খবর প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবদ্ধ আইনগুলো অনুসরণ করলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনতা দিতে পারলে আর্থিক খাতের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অনেকটাই নিরসন হতো। যেহেতু সরকার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র ঘোষণা দিয়েছে, সেহেতু যারা এসব অপকর্মে যুক্ত তাদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে কঠোর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে মামলা সাজানোর জন্য বিভিন্ন অনুষঙ্গ খুঁজে বের করতে হয়। তখন তদন্তের নামে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অসাধুরা সহজেই পার পেয়ে যান। আর্থিক খাতে অনিয়মের বহু মামলা এখনও বিচার প্রক্রিয়াধীন কিংবা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। অভিযুক্তরা যদি শাস্তির আওতায় না আসেন, তা হলে আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানো যাবে না। অর্থ পাচারও আমাদের বড় আরেকটি ব্যাধি। এই ব্যাধির সংক্রমণ একদিনে হয়নি। এর কারণগুলোও সচেতনদের অজানা নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে জরুরি রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে ব্যাপক-এই অভিযোগ অমূলক নয়। দেশে ব্যাংক খাতে অপচয় বেশি হয়। বিগত কয়েক বছর একাধিক ব্যাংকের ওপর পর্যবেক্ষণ ও সমীক্ষণ চালানো হয়েছে। কিন্তু শুধু গুণগত ও পরিমাণগত সমীক্ষণ দিয়ে কিছু করলে হবে না। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার জন্য শুধু বাহ্যিক কারণগুলোই দায়ী নয়। বরং দেশের ভেতরেরই এমন কিছু বিষয়ের কারণে এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। এর মধ্যে রয়েছে কম রাজস্ব আদায়, অনুপযুক্ত খাতে সরকারি ব্যয় এবং অনাদায়ী ঋণ। এসব কিছুই আর্থিক খাতে অনিয়মের মাত্রা বাড়াচ্ছে একদিকে আর অন্যদিকে অপচয় বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু বাড়তি চাপেই রয়েছে। প্রচণ্ড গরমে উৎপাদন ব্যবস্থা নানা কারণে বিলম্বিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে অতীতেও অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু আর্থিক খাতের দীর্ঘসূত্রতার ফলে কার্যকরভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।


  • অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা