× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ডায়েট যখন সমাজ ও রাজনীতির

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪২ পিএম

ডায়েট যখন সমাজ ও রাজনীতির

ডায়েট তথা পরিমিত খাদ্যাভ্যাস সুস্থ জীবনের জন্যপ্রয়োজনীয় বিষয়। ইতিহাসবিদদের মতে, অষ্টাদশ শতকে আধুনিক ডায়েটব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু জীবনযাপনে সুস্থতার প্রশ্নেডায়েট নিয়েহয়েছে সামাজিক আন্দোলন। কখনও বিষয়টি নিয়েতৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকটও। ইতিহাসের পথরেখায় এ বিষয়ে লিখেছেন আহমাদ শামীম

সকল সুখের মূল যখন স্বাস্থ্য, তখন এই স্বাস্থ্যের প্রতি বাড়তি নজর না দিয়ে কি আছে উপায়! শরীর সুস্থ রাখতে আমাদের কতই না চেষ্টা। এত কিছুর পরও কি সুস্থ থাকতে পারছি? প্রশ্ন থেকেই যায়। সুস্থ থাকার প্রধানতম শর্তগুলো কী? উত্তরে অনেকেই অনেক কিছু বলবেন হয়তো। খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলা চর্চার মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই সুস্থ থাকতে পারি, মোটা দাগে উত্তরে সন্তুষ্ট হবেন অনেকেই। কিন্তু সুস্থ থাকার শর্ত, নিয়ম এবং চর্চা আমরা কতটা মানি এবং কতটা জানি? প্রশ্ন রইল আবারও।

শরীর যখন অসুখের কবলে পড়ে, সুস্থতা যখন আমাদের ছেড়ে পালায়; ডাক্তার, ওষুধ আর টেস্ট-ওই টেস্টের জোয়ারে ফাইল ভারী হতে থাকে তখন হয়তো মনে হয়Ñইশ, একটু নিয়ম মেনে চললে কী আর হতো ক্ষতি! ঠিক তাই, চোর পালালেই তো বুদ্ধি আসে! বিষয়টাও তেমন। অ্যানাটমির ভাষায়, আমাদের শরীর হলো অনেকটা যন্ত্রের মতো। যন্ত্র যেমন সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে বিগড়ে যায়, তেমন শরীরও। নিয়মের বাইরে গেলেই বেঁকে বসবে।

আধুনিক সময়ে সুস্থ থাকার অন্যতম প্রধান যে বিষয়টি তা হলোডায়েটবা পরিমিত আহার কিংবা বলা যায় খাদ্যসংযম। বিভিন্ন ধর্ম সংস্কৃতিতে পরিমিত আহারের কথা বলা হয়েছে। শরীরের জন্য উপকারী অপকারী দুই রকমের খাবার নিয়ে রয়েছে অজস্র বিধিনিষেধও। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করবেন ডায়েট? ডায়েট কি শুধুই সুস্থতার জন্য, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কারণও?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে অন্তত ৩০০ বছর পেছনে। অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে কম চর্বিযুক্ত খাবার, ব্যায়াম, ডায়েট চার্ট, ডায়েট পিলসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মনে করা হয়, ভিক্টোরিয়ান যুগেই (১৮৩৭-১৯০১) আধুনিক ডায়েটব্যবস্থা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্থূলকায় মানুষ ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া শুরু করে। ইংরেজ ডাক্তার ম্যাথু ডবসনের ডায়াবেটিকস রোগের কারণ, উৎস বিভিন্ন পদ্ধতির পক্ষে ১৭৯৭ সালে স্কটিশ মিলিটারি সার্জন জন রোল্লোর প্রকাশিত প্রবন্ধনোটস অব অ্যা ডায়াবেটিস কেস’- তিনি মিট ডায়েটের উপকারিতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। ম্যাথু ডবসন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের প্রস্রাবে গ্লুকোজের অত্যাধিক উপস্থিতির কথা জানান। তবে আধুনিক সময়ের ডায়েটিশিয়ানদের মধ্যে জনপ্রিয়তম মানুষটি হলেন ইংরেজ ভদ্রলোক উইলিয়াম বেন্টিং। ১৮৬৩ সালে তার লেখা প্রকাশিতলেটার অন করপুলেন্স, অ্যাড্রেস টু দ্য পাবলিকশিরোনামের পুস্তিকায় তিনি ডায়েট নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা বা ডায়েট প্ল্যান প্রণয়ন করেন। তিনি পরিমিতভাবে চার বেলা খাবারের কথা বলেন। তার খাবার তালিকায় ছিল মাংস, সবুজ শাকসবজি, ফল ড্রাই ওয়াইন। আর খাদ্য তালিকা থেকে তিনি চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, ভাত, বিয়ার, দুধ বাটার বাদ দেন। বর্তমান সময়ের আধুনিক ডায়েটব্যবস্থার বা ডায়েট প্ল্যান তার হাত ধরেই আসে। ১৮৬৩ সালে তার লেখা ওই ছোট্ট বইটির সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। ডায়েটের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথম যে বইটি বেস্ট সেলারের তকমা লাভ করে সেটা কিন্তু আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়। ক্যালরি কমিয়ে ওজন কমানোর চিন্তা থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় মার্কিন ডাক্তার কলামিস্ট লুলু হান্ট পিটারসের বইডায়েট অ্যান্ড হেলথ : উইথ কি টু দ্য ক্যালরিস

তবে তথ্যগত এসব ভুল শুধরে দেবে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের অধ্যাপক . করিন্না ওয়েগনারেরপ্যাথলজিক্যাল বডিজবইটি। তার গবেষণাধর্মী বইয়ে দেখিয়েছেন, মধ্য ভিক্টোরিয়ান যুগে মুটিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষ এক প্রকার যুদ্ধই ঘোষণা করেছিল! ওজন কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করাটা অনেকটা ছিল তাদের বিনোদনের মতোই! স্থূলতা কমিয়ে শরীর আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং আত্মসংযমের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি বিতর্কেরও কমতি ছিল না। ডায়েটের পাশাপাশি সে সময় বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল সংযম খাদ্যের শৃঙ্খলার ওপর। অত্যধিক মোটা মানেই হলো আপনার নৈতিকতার অভাব আছে, আপনি দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং আপনি নিয়মের বাইরের একজন অসামাজিক মানুষ!

. করিন্না ওয়েগনার তার প্যাথলজিক্যাল বডিজ বইটিতে দেখাতে চেয়েছেন ভিক্টোরিয়ান যুগেরও আগে জর্জিয়ান যুগের (১৭১৪-১৮৩৭) শেষ দিকেই মূলত মানুষের মধ্যে প্রথম স্বাস্থ্য বিষয়ে চিন্তা তথা মুটিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। . ওয়েগনারের ভাষ্যমতে, ‘জর্জিয়ান যুগে ব্রিটেনজুড়ে মানুষের মধ্যে ছিল বেশ আরামপ্রিয়তা, খাবারের প্রতি অত্যধিক মোহ, মদপান এবং আনন্দ উদ্যাপনের বিষয়টি, যেন আপনি এসবের জন্যই বেঁচে আছেন।

তবে জর্জিয়ান যুগের মানুষের অমিত জীবনযাপন এবং মুটিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে প্রথম যে মানুষটি কাজ শুরু করেন তার নাম জর্জ চেইনি। স্কটিশ ডাক্তার ভদ্রলোককে আধুনিক যুগের প্রথম ডায়েটিশিয়ান হিসেবে আখ্যা দেন স্বাস্থ্যবিদরা। তিনিই প্রথম ডায়েট বা পরিমিত আহারের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনার পদ্ধতি শুরু করেন; যা ওই সময়ের মানুষের চিন্তাভাবনার অদূরেই ছিল।

. করিন্না ওয়েগনার তার বইয়ে লিখেছেন, ‘তিনি তার খাদ্য তালিকা থেকে মদ মাংস বাদ দেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় ৩২ কেজি ওজন কমাতে সক্ষম হন। জর্জ চেইনি তার সফলতার গল্প ১৭৪০ সালে প্রকাশিত দ্য ন্যাচারাল মেথড অব কিউরিং (সিক) দ্য ডিজিজ অব দ্য বডি অ্যান্ড দ্য ডিজঅর্ডার অব দ্য মাইন্ড শিরোনামের বইয়ে প্রথম বিশদ আলোচনা করেন। তিনি ডায়েটের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনার একটা নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করে সমাজের ধনীদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষত হন। তিনিই হলেন প্রথম আধুনিক ডায়েট ডাক্তার। জর্জ চেইনির পন্থা খুব সহজেই সফলতার মুখ দেখে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, ডায়েট ডাক্তার হিসেবে নতুন চিকিৎসাব্যবস্থারও প্রচলন ঘটে। ওজন কমিয়ে ফেলাটা দ্রুতই ফ্যাশনে পরিণত হয় তখনকার মানুষের মধ্যে।

. ওয়েগনার তার বইয়ে আরও দেখাতে চেয়েছেন, ডায়েটব্যবস্থার প্রচলন যেমন চিকিৎসাব্যবস্থায় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে, তেমন চিন্তাটি ব্রিটেনের রাজনীতিও দারুণ প্রভাবিত করে। প্রশ্ন হচ্ছে, ডায়েটের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোথায়? এখানেই মূলত . ওয়েগনারের সফলতা। আর্থিকভাবে জীবনযাপনের দিক দিয়ে জর্জিয়ান সমাজের নিচুস্তরের মানুষের সঙ্গে ওপরের মহলের বিস্তর ফারাকের ফলে অসন্তোষ অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল সে সময়। পাশাপাশি ফরাসি বিপ্লবের যাত্রাকালে সবার মনে প্রশ্ন উঠেছিল, ব্রিটেন কি তার রাজত্ব এবং বিশ্বজোড়া আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে, নাকি ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে? মনোভাবের প্রধান কারণ হলো, সে সময়কার রাজা চতুর্থ জর্জের অসংযত জীবনাচার, তার স্থূলকায় বিশাল দেহ এবং শাসনের অব্যবস্থাপনা। . ওয়েগনারের ভাষায়, ‘রাজা চতুর্থ জর্জের আনফিট শরীরই হলো তার অব্যবস্থায় পূর্ণ শাসনব্যবস্থার প্রতিরূপ। রসনায় তার প্রিয় ছিল পার্সিয়ান ফ্রেঞ্চ খাবার। এটা কোনোভাবেই দেশপ্রেমের উদাহরণ হতে পারে না। অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ এবং এসব বিষয়ের ফলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটবার সম্ভাবনা দারুণভাবে দেখা দেয়।

সামাজিক রাজনৈতিকভাবে যখন অস্থিরতা ঘনিয়ে আসতে থাকে তখনই স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এবং সচেতনতায় জর্জ চেইনির ডায়েটব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রভাব রাখে জর্জিয়ান সমাজে। পাশাপাশি রাজার পক্ষ থেকেও বিদেশি খাবার না খেয়ে দেশি খাবার গ্রহণের প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। রাজা চতুর্থ জর্জের শরীর নিয়ে চিন্তা জাতীয়তাবাদী মনোভাবই মূলত সে যাত্রায় তাকে ব্রিটিশ রাজত্বকে রক্ষা করে।

রাজা চতুর্থ জর্জের শাসনামলের পরপরই শুরু হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। ভিক্টোরিয়ান যুগের রাজনীতি সমাজব্যবস্থায় জর্জিয়ান যুগের ডায়েট বিষয়ক ভাবনাটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন . ওয়েগনার। এসব দেখেশুনে বলতেই হয়, ডায়েট শুধু শরীর সুস্থ রাখারই উপায় নয়, বরং এটা নৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক বিবেচনায়ও কম গুরুত্ব বহন করে না। সুতরাং ভালো থাকতে হলে, সুস্থ থাকতে হলে তথা সুখে থাকতে হলে পরিমিত আহারের কোনো বিকল্প নেই।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা