× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা মশার পেছনে, ফল শূন্য

ফয়সাল খান

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৮:৪৩ এএম

আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪৬ পিএম

মশক নিধন অভিযান। পুরানো ছবি

মশক নিধন অভিযান। পুরানো ছবি

প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেও মশা দমন করতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর ফলে প্রতি বছরই মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী। প্রাণও হারাচ্ছেন অনেকে। গত ১১ বছরে এ খাতে অন্তত ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সংগতকারণেই এই ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৪ জনের মৃত্যু হলো। একই সঙ্গে ওই ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৬৬১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৩৩ জন ঢাকার এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৮ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য বলছে, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২ হাজার ১২৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৪৯০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৩৯ জন। গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১ হাজার ১১৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছাড় পেয়েছেন ৮ হাজার ৯২৩ জন।

ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর প্রথম ৬ মাসে ২২২ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ বছরের ছয় মাস ৫ দিনে সাড়ে ১০ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের সাড়ে ৭ হাজার জনই ঢাকায়। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু ঘটেছে ৬২ জনের। 

এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ তাপস। অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মুখে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ প্রতি বছর শতকোটি টাকা খরচ হলেও মশক নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখাতে পারেননি কোনো মেয়র। মশক নিধনে নতুন নতুন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ ব্যাপারে কাউকে কখনও জবাবদিহিতার মুখোমুখিও হতে হয়নি। নগরবাসীর অভিযোগ, লোক দেখানো কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতি বছর মশা মারার নামে সরকারি অর্থের অপচয় করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: সব পানিতেই জন্মাচ্ছে এডিস, কামড়ায় রাতেও

মশা নিয়ন্ত্রণের বাজেট বরাদ্দ

২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভেঙে দুটি আলাদা সিটি করপোরেশন করা হয়। দুই সিটি করপোরেশনের পরের বাজেট ও মশক কর্মীদের বেতন-ভাতার হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২০১১ অর্থবছরে সংস্থা দুটি মশার পেছনে ১ হাজার ৭৯ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ করেছে। এ ক্ষেত্রে ডিএসসিসি ৪৯২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং ডিএনসিসি ৫৮৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচ করেছে। এর মধ্যে শুধু বেতন-ভাতা খাতেই খরচ হয়েছে ৫১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ওষুধ কিনতে ৫০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা এবং যন্ত্রপাতি খাতে ৬৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবছর জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও বিপুল অর্থ খরচ করা হচ্ছে। গত বছর মশা নিয়ন্ত্রণের প্রচারাভিযানে চিত্র নায়ক-নায়িকাদেরও সম্পৃক্ত করে ডিএনসিসি।

ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, তারকারা সিটি করপোরেশনের কাজে এলে তাদের সম্মানী দিতে হয়Ñ এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তার সঠিক হিসাব তার জানা নেই।

জনসম্পৃক্ততা বাড়েনি

প্রতিবছরই সিটি করপোরেশন জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়। চলতি বছর স্কুল শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও মশককর্মীদের নিয়ে সভা করেছে সিটি করপোরেশন। তা ছাড়া লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, ভ্রম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নানা কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এর কোনো সুফল মিলছে না।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী দুজন ম্যাজিস্ট্রেট জানিয়েছেন, প্রথমবার কোথাও এডিস মশার লার্ভা পেলে সাধারণত জরিমানা করা হয় না। সতর্ক করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে চলে আসেন তারা। তবে জরিমানা করা প্রায় সবার বাড়িতেই দ্বিতীয়বার এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।

এদিকে, গত ১৮ জুন থেকে পরবর্তী ১৩ দিন ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ সময় মোট ১ হাজার ৪১৭টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয় এবং ৯১টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এ সংক্রান্ত ৮৪ মামলায় ১৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবারের অভিযানে ১৮৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১২ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিমানা আদায় হয়েছে ৯২ হাজার টাকা।

কাজে লাগছে না যুক্তরাষ্টের অভিজ্ঞতা

এর আগে ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়লে মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে নাগরিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এডাল্টিসাইট ও লার্ভিসাইট নিধনে ওষুধ প্রয়োগের গতানুগতিক প্রক্রিয়া নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় সিটি করপোরেশন। বিশেষ করে তেলাপিয়া, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের এবং ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করার ঘোষণা দেন মেয়ররা। এসব উদ্যোগ যখন অসফল হয়, তখন মশক নিধনের কৌশল প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিনিধিদল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরে যান ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ওই সফরের সময় এ দেশে মশক নিধনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ভুল রয়েছে বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। তবে ওই প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে এলেও এখনও ওই প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়নি। অবশ্য তাদের প্রত্যাবর্তনের পর ডিএনসিসি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি সভা করে। কিন্তু এখনও পুরোনো পদ্ধতিতেই মশক নিধন কাজ পরিচালনা করছে করপোরেশন।

মিয়ামি সফর করে আসা একজন কর্মকর্তা জানান, ফগিং পদ্ধতি দিয়ে মশা কখনও মারা যায় না। মশক নিয়ন্ত্রণের ৮০ শতাংশ অর্থ তারা ব্যয় করেন লার্ভিসাইডিংয়ের কাজে।

তিনি বলেন, সব এলাকায় তাদের একটি টিম থাকে। এই টিমের সদস্যরা মশার প্রজননস্থল থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা ও মশার ডিম সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায়। বিশেষজ্ঞরা সেই মশা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মশার প্রজাতি নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন। কিন্তু আমরা মশক নিধন বলতেই ফগিং বুঝি। কোনো এলাকায় ফগিং না হলে, মানুষ মনেই করে না যে মশক নিধন কার্যক্রম হচ্ছে।

কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অসন্তোষ

সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নামমাত্র যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা নিয়েও নগরবাসীর মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। কারণ বেশিরভাগ এলাকাতেই কালেভাদ্রে দেখা মেলে মশক নিয়ন্ত্রককর্মীদের। অথচ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বারবারই বলছেন, মশক নিধনে নিয়মিত তারা লার্ভিসাইট ও এডাল্টিসাইট প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্রাশ প্রোগ্রামও পরিচালনা করা হচ্ছে।

কিন্তু নাগরিকদের অভিযোগ, মেয়র গেলেই কেবল গোছগাছ করে ‘লোক দেখানো’ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ছবি তোলা আর ভিডিও করা শেষ হলে সবাই চলে যান। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও সর্বজনীন নয়। মাত্র কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফলাও করে প্রচার করার অভিযোগও রয়েছে।

মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা সানজিদা খানম বলেন, মশা মারার অভিযান টিভিতে দেখা যায়। তা ছাড়া কখনই দেখিনি। গত বছর একবার মার্কেটে যাওয়ার সময় সড়কে ধোঁয়া উড়িয়ে মশা মারতে দেখেছিলাম।

উত্তরা এলাকার বাসিন্দা আজহারুল ইসলাম বলেন, সময় সময় মশা মারতে অনেকেই আসেন। কিন্তু মশা তো আর সময় বুঝে কামড় দেয় না।

অবহেলিত জায়গায় ৪৩ শতাংশ লার্ভা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যপক কবিরুল বাশার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নগর কর্তৃপক্ষ অথবা নগরবাসী কেউই শ শোধরায়নি। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মশা নিয়ে সবার ভেতর অবহেলা রয়েছে। মানুষের অনেক ব্যস্ততার কারণে কিছু কিছু জায়গায় অনুসন্ধানের জন্য যাওয়াই হয় না। 

তিনি বলেন, এবারের জরিপে ৪৩ শতাংশ মশার লার্ভা পেয়েছি বেজমেন্টে ও গাড়ি পার্কিং করার জায়গায়। অনেক বাড়িতে এমনসব জায়গা আছে যেখানে বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া কেউই যায় না। এ কারণে মনে হয় নগরবাসী সচেতন থাকলেও মশক নিধন কার্যক্রমে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়নি।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত লার্ভিসাইডিং করার পাশাপাশি নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিএনসিসি ও বাংলাদেশ স্কাউটের সদস্যদের যুক্ত করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম ও খতিব এবং স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসির সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। ছাদে ও বারান্দায় কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না।

শনি ও রবিবার থেকে জোরদার হচ্ছে অভিযান

আগামীকাল শনি ও রবিবার থেকে মশক নিধন অভিযান আরও জোরদার করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে বিশেষ সভা করেছে ডিএনসিসি। ডিএসসিসিও তাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়েছে। 

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমরা তিন দিনের বিশেষ অভিযান শেষ করেছি। আগামী রবিবার থেকে আরও জোরালো অভিযান শুরু হবে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা জানান, আগামীকাল শনিবার থেকে মশকবিরোধী চিরনি অভিযান পরিচালনা করা হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা