× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কেনিয়া-তানজানিয়া ভ্রমণ

যেন স্বপ্নে ঘুরে আসা এক জগৎ

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২২ ১৫:৪১ পিএম

আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২২ ১৬:৪৫ পিএম

বাংলাদেশি দম্পতি রেজাউল বাহার ও শারমিন বাহার

বাংলাদেশি দম্পতি রেজাউল বাহার ও শারমিন বাহার

বাংলাদেশি দম্পতি রেজাউল বাহার ও শারমিন বাহার। ২০০৮ সাল থেকে বেড়ানো শুরু করেছেন।  একসঙ্গে পৃথিবীর ৮৮টি দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। গত ১৫ বছর ধরে এই দম্পতি আমেরিকা থাকছেন। সম্প্রতি তারা ঘুরে এসেছেন কেনিয়া-তানজানিয়া। সেই গল্প প্রতিদিনের বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন রেজাউল বাহার। 


পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া-তানজানিয়াতে আমাদের যাত্রা শুরু নাইরোবি থেকে। এখান থেকেই কেনিয়ার মাসাই মারা হয়ে তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি আর গরংগোরো। ফিরে আসা তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারো থেকে। অনেক দিনের প্ল্যান, ৯ দিনের এই ট্রিপটা ঠিক হলো সেন্সটুয়ারি রিট্রাইটসের সঙ্গে। ওদেরই বাংলো আর তাবুতে কাটবে আমাদের দিনগুলো।

কেনিয়ার নাইরোবিতে নেমে এক রাত হোটেল, পরদিনই অভ্যন্তরীণ উইলসন এয়ারপোর্ট থেকে খুব ছোট একটা প্লেনে আমাদের যেতে হবে মাসাই মারার কিচওয়া টাম্বো এয়ারস্ট্রিপে। এরপর বাকি ভ্রমণটা হবে ছোট ছোট প্লেনে। কিচওয়া টাম্বো এয়ারস্ট্রিপে আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে নেলসন। সে আমাদের ড্রাইভার এবং ট্যুর গাইড। আগামী চারদিন আমরা থাকব মারা নদীর পাশে বাংলোতে। 

বাংলোর গা ঘেঁষে বয়ে গেছে মারা নদী। কুমির আর জলহস্তীর আনাগোনা এখানে। তবে এই এলাকায় জলহস্তীর সংখ্যাটাই বেশি। প্রতিদিন সকালে এখানে ঘুম ভাঙে জলহস্তীর ডাকে। এরা রাতে খাবারের সন্ধানে বের হয়, ফিরে আসে সকাল হওয়ার আগেই। সারাদিন পানিতেই এদের অবস্থান। মারা ন্যাশনাল রিজার্ভ ১ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। এখানকার আদিবাসীরা মাসাই নামে পরিচিত। বন্যপ্রাণী রক্ষায় তাদের সরে যেতে হয়েছে মারা রিজার্ভের বাইরে। একসময় তারাও বন্যপ্রাণী শিকার করত। তবে এখন তা বন্ধ হয়েছে। 

মারা এলাকা হলো বিস্তীর্ণ খোলা অভয়ারণ্য, মাঝেমধ্যে কিছু পাহাড়ি জায়গা, ছড়ানো-ছিটানো কিছু বড় গাছ। অনেক বেশি বড় গাছ না থাকার মূল কারণ হাতি, এরা গাছ উপড়ে ফেলে। জিরাফ গাছের নিচ থেকে পাতা খেয়ে খেয়ে গাছের আকৃতি তৈরি করে ফেলে ছাতার মতো। বেশ আগে মানুষ খেলার নামে শিকার করত পাঁচটি প্রাণী। সিংহ, লেপার্ড, হাতি, গন্ডার আর বন মহিষ। অনেকটা ট্রফি জেতার খেলা, নাম বিগ ফাইভ গেম ড্রাইভ। এখনও ট্যুরিজমের জন্য সাফারিতে বের হলে বলা হয় গেম ড্রাইভ, খুঁজে খুঁজে বের করা হয় বিগ ফাইভ অ্যানিম্যালস। 

প্রায় ৯০টির বেশি ল্যান্ড অ্যানিম্যাল আছে মাসাই আর সেরেঙ্গেটিতে। মাসাই আর সেরেঙ্গেটি মূলত একই বিস্তীর্ণ ভূমি, দুটো দেশের সীমানার কারণে কেনিয়ার অংশটুকু মাসাই মারা, তানজানিয়ার অংশের নাম সেরেঙ্গেটি। সেরেঙ্গেটি শব্দের মূল অর্থ সীমাহীন বিস্তীর্ণ ভূমি। এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই সেই বিশালতার মূল অর্থ। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘাস আর ঘাস, মাঝেমধ্যে দু-একটা বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। সেরেঙ্গেটি মূলত মাসাই মারার ২০ গুণ বড়। পৃথিবীতে কিছু বন্য প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে। কিছু প্রাণী যার থাকার জন্য প্রয়োজন সীমাহীন এলাকা। চিতা এমনই একটি প্রাণী, প্রতিটা চিতার জন্য প্রয়োজন প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা। এতটা জায়গা কি মানুষ করে দেবে? মারা-সেরেঙ্গেটিতে ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারে এখন চিতা বাকি আছে মাত্র ৩০০টি। এদের দেখা যেমন বিরল, এদের শিকার করতে বের হওয়া স্বচক্ষে দেখা লটারি জেতার মতো ভাগ্যের ব্যাপার। এমন বিরল ঘটনা ঘটে গেছে আমাদেরই চোখের সামনে।

মাসাই মারা নদীর পাশে স্যাংচুয়ারি ওলনানা লজ থেকে সেদিন খুব সকালে বের হয়েছি। গাড়ির স্টিয়ারিং নেলসনের হাতে। সঙ্গে বাংলো থেকে দেওয়া দুপুরের খাবার। ইচ্ছা আছে, কোনো একটা ফাঁকা জায়গায় খেয়ে নেব। যা হোক, এখানে গাড়িচালকদের পরস্পরের মধ্যে রেডিও কমিউনিকেশনের ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ নেলসনের কাছে সংকেত এলো-চিতা বাঘ দেখা গেছে। সাধারণত এই প্রাণীর দেখা পাওয়া মুশকিল। লুকিয়ে থাকে। বের হয় শুধু খাবারের সন্ধানে।

মাসাই মারায় ঘাসগুলো দুই থেকে চার ফুট উঁচু। গাড়ি দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। অনেকক্ষণ পর চিতার সন্ধান পাওয়া গেল। চিতাটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে খোলা দিগন্তের দিকে। নেলসন জানাল, এটি ফিমেল চিতা। বাচ্চাদের কোথাও লুকিয়ে রেখে এখন শিকারে বের হয়েছে সে। দূর থেকে চিতার পিছু নিতে নিতে অনেকটা সময় পার হয়েছে। হঠাৎ দেখলাম চিতাটি অদৃশ্য হয়ে গেছে! আমরাও সরে গেলাম অন্যদিকে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো-চিতা আবার বের হয়েছে। আবারও তার পিছু নিলাম। উঁচু ঘাসের সীমানা ছেড়ে এখন সে ধীরে ধীরে খোলা প্রান্তরের দিকে যাচ্ছে। আফ্রিকার এই তৃণভূমিতে অসংখ্য হরিণ। চিতাটি দূর থেকে হরিণ দেখছে, আমরাও। খোলা দিগন্ত, উঁচু ঘাস, মাঝেমধ্যে উইপোকার ঢিবি। কিছুটা এগিয়ে চিতাটি একটি ঢিবির ওপরে উঠে বসে চারপাশটা দেখল। দুরবিনে দেখলাম, প্রায় মাইলখানেক দূরে কিছু হরিণ। চিতা এখন থেকে তার লক্ষ্য ঠিক করে নেবে, বেছে নেবে কোন হরিণটির পেছনে সে ছুটবে। চিতার পেছনে আছি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। সব কিছু ঘটছে ধীরগতিতে। ৫০০ মিলিমিটার ক্যামেরার লেন্স ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা করছিল। দুর্ভাগ্য, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মুহূর্তে চিতা বুলেটের বেগে দৌড়াতে শুরু করল। ১০ সেকেন্ডের মতো। তারপর থামল। মনে হলো চিতার হিসাবে গড়বড় হয়ে গেছে। দূর থেকে চিতাকে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেছে হরিণের দল।

দুপুর পার হয়েছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চিতাটি আবার শিকারে যাবে কি না বলা মুশকিল। চারদিক এখন হরিণশূন্য। চিতাটি ধীরে এগোচ্ছে। নেলসনকে বললাম—বাদ দাও। চলো ফিরে যাই, খেতে হবে। সে একটু ধৈর্য ধরতে বলল। দুরবিন নিয়ে সে এদিক-ওদিক দেখল। জানাল, চিতা যে পথে এগোচ্ছে সেই বরাবর প্রায় মাইল দুয়েক দূরে কিছু হরিণ দেখা যাচ্ছে। ভাবছি, ধুর! চলে যাওয়া দরকার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এক মিনিটের মাথায় কত অ্যাকশন দেখা যায়। আর এখানে প্রায় ঘণ্টা তিনেক হতে চলল। মনে মনে বিরক্ত হলাম। নেলসন কি বুঝতে পারছে না আমরা ক্লান্ত। বিকেল ৩টা পেরিয়ে যাচ্ছে। যা হোক, ক্যামেরা আবার হাতে নিলাম। চিতা এখন আমাদের মাইলখানেক সামনে। মাসাই মারায় কিছু নিয়ম আছে। প্রাণী শিকারে থাকলে তার পিছু নেওয়া যাবে না। শিকার ধরে ফেললে তার সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির হওয়া যাবে। ফলে আমরা একেবারে কাছাকাছি যেতে পারব না। যা হোক, এবার বহুদূরে কিছু হরিণ দেখা যাচ্ছে। আমার হাতে ক্যামেরা, নেলসনের হাতে দুরবিন। সে আমাদের অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে দূরে হরিণগুলোর মধ্যে একটি অল্প বয়সী হরিণ আছে। চিতাটি তাকেই টার্গেট করবে। চিতা আর হরিণের দূরত্ব তখনো প্রায় মাইলখানেক। প্রচণ্ড ভয়ে ছুটছে হরিণগুলো। চিতাটি যেন ছুটছে আরো জোরে। শিকার ধরতেই হবে। সে কী ভয়ংকর গতি। মাত্র ২২ সেকেন্ডে ধরে ফেলেছে তার শিকার! মুহূর্তের মধ্যে নেলসন গাড়ি স্টার্ট দিল। মনে হলো তৃণভূমির ওপর দিয়ে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। চিতার পাশে এসে গাড়ি থামল। দেখলাম, হরিণটি তখনো জীবিত, কান দুটি নড়ছে। গলার পাশে কামড়ে ধরে আছে চিতা। মাটিতে শুয়ে আছে দুটি প্রাণী। ক্লান্ত। বুক-পেট বেলুনের মতো ফুলে বড় হচ্ছে আবার ছোট হচ্ছে। এতক্ষণ শিকার দেখার উত্তেজনায় ছিলাম। এবার হরিণটির জন্য খুব মায়া হলো।

চিতার হরিণ (গ্যাজেল যার নাম) শিকার ক্যামেরায় বন্দি করার বিরল সৌভাগ্য আমাদের এই ট্রিপে। বিগ ফাইভসহ অগণিত প্রাণী ঘুরে ঘুরে দেখাই ছিল ট্রিপের মূল উদ্দেশ্য। খোলা গাড়িতে আমি, শারমিন (আমার স্ত্রী), সঙ্গে নেলসন সারাদিন মাসাই মারা ঘুরে বেড়ানো, কোথায় খালি জায়গা দেখে কোনো এক গাছের নিচে দুপুরের লাঞ্চ অথবা ব্রেকে এক কাপ কফি মারার সেই সময় আর অনুভূতি থাকুক সেখানেই। শব্দে বা ছবিতে তাকে ঘরের বসার রুমে নিয়ে আসা অসম্ভব। এ মাসাই মারাতেই চার দিনের গেম ড্রাইভে আমরা। পুরো ভ্রমণে অগণিত পশুপাখির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে আমাদের। খুব কাছ থেকে হয়তো ১০ ফুটের মধ্যে বসে থেকেই দেখা গেছে সিংহের দল, হাতি, জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তী। চিতা আর লেপার্ড- এ দুই প্রাণী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লুকিয়ে থাকে, বের হয় শুধু খাবারের সন্ধানে। মাসাই মারা থেকে আবারও প্লেনে করে চলে গেলাম তানজানিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি। বন্যপ্রাণীদের নিজস্ব ভূমিতে কিছুদিন থেকে খুব কাছ থেকে দেখা তাদের, মাসাইদের গ্রামে মানুষের জীবন ছুঁয়ে আসা, ক্ষুধার্ত চিতার বুলেটের মতো ছুটে বেড়ানো, অসহায় হরিণের প্রাণে বাঁচার শেষ চেষ্টা- এসবই অনেকটা কল্পনার মতো মনে হয়। মনে হয়, স্বপ্নে ঘুরে আসা এক জগৎ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা