ভোলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৯ এএম
আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:২৪ পিএম
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জেগে ওঠা চর কুকরি মুকরি হয়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য। প্রবা ফটো
ভোলা জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জেগে ওঠা এক চরাঞ্চল কুকরি মুকরি। এক পাশে সমুদ্রসৈকত, অন্য পাশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। নীল সাগরের হাতছানি আর বনাঞ্চলের জন্য কুকরি মুকরি পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য।
কিন্তু দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, কাঁচা রাস্তা আর আবাসন সংকটে এখানে আসা পর্যটকদের পোহাতে হতো নানা বিড়ম্বনা। সেই সমস্যাও এখন আর নেই। গত দুই বছরে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কুকরি মুকরির রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বেড়িবাঁধসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এসেছে সাগরবেষ্টিত এই অঞ্চলে। নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বিদ্যুতের আলোয় আলোকিতও হয়েছে এই জনপদ। এই পরিবর্তনের ফলে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সুবিধা যেমন হয়েছে, তেমনি বদলে গিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের জীবনও।
কুকরি মুকরি রেস্ট হাউস এলাকার গৃহবধূ হোসনে আরা বেগম। একসময় তার স্বামী করতেন দিনমজুরের কাজ। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। দুই বছর আগে এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘হোসনে আরা হোম স্টে সার্ভিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে তার আয় এখন ২০-২৫ হাজার টাকা। হোসনে আরা জানান, প্রথমে একটি টিনের ঘর দিয়ে ব্যবসা শুরু হয়। ধীরে ধীরে সেই ঘর পাকা ঘরে রূপান্তর ঘটান। এখন ভালোই আয় হয়। দূর হয়েছে সংসারের অভাব।
হোসনে আরার মতো অনেক নারী উদ্যোক্তা পর্যটননির্ভর কাজ করে বদলে ফেলেছেন নিজেদের জীবন। পাশাপাশি অটোরিকশা, মোটর সাইকেল, স্পিডবোট ও নৌকা চালানোর সঙ্গে যুক্ত আছে অনেক বেকার যুবক।
কুকরি মুকরির উন্নত যোগাযোগ আর নিরাপদ পরিবেশের কারণে ইকো ট্যুরিজম ঘিরে দিন দিন সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের। ফলে কৃষি ও মাছ ধরা পেশা বাদ দিয়ে মানুষ নতুন পেশায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
খেয়াঘাটসংলগ্ন নারী হোটেল ব্যবসায়ী শিরীনা আখতার জানান, একসময় তার হোটেলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেচাবিক্রি হতো। রাস্তা ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে মৌসুমে কোনো কোনো দিন ২০ হাজার টাকাও বিক্রি হয়।
কথা হয় কয়েকজন অটোরিকশা ও মোটর সাইকেল চালকের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, একসময় তারা কৃষিকাজ করতেন। এখন রাস্তাঘাট হওয়ায় অটোরিকশা এবং মোটর সাইকেল চালান। কারণ মানুষ ঘুরতে আসে, পর্যটকদের যাতায়াতে কাজ করেন তারা।
কুকরি মুকরির এই বদলে যাওয়ার পেছনে আছে বেসরকারি উদ্যোগ। কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ‘ইকো ট্যুরিজম’ প্রকল্পের আওতায় নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে উঠছে। ফলে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপদ খাদ্য আর থাকার সুব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় দিন দিন পর্যটক বাড়ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে সরকারি রেস্ট হাউসের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য নতুন করে যুক্ত হয় হোম স্টে সার্ভিস, বনের মাঝে ঝুলন্ত সেতু, জিপ ট্রাকিং, রেস্টিং বেঞ্চ, গাছের মাচায় ট্রি হাউস, চাইনিজ রেস্টুরেন্টসহ নানা প্রকল্প।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল কাদের জানান, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক লাখের বেশি পর্যটক এসেছে কুকরি মুকরিতে। আর এসব পর্যটকের কাছ থেক ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আয় করেছে স্থানীয় উদ্যোক্তারা। পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হোটেল ব্যবসা, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ আয় হয়েছে। আর কুকরি মুকরিকে কেন্দ্র করে পুরো ভোলা জেলায় আয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।
চর কুকরি মুকরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাসেম মহাজন জানান, আমাদের এই অঞ্চল একসময় অবহেলিত ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে বদলে গেছে এই জনপদ। এখন পর্যটকদের কোনো বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না। এতে করে একদিকে যেমন চাঙ্গা হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য; অন্যদিকে কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্য মানুষের।