শায়লা বিথী
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:১৩ পিএম
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৫৩ পিএম
ছবি : লেখকের সৌজন্যে
ছবি : লেখকের সৌজন্যে
এভারেস্টকে পেছনে রেখে আমরা শ্বেতশুভ্র পথ দিয়ে হেঁটে চলছি। শীতে জমে যাচ্ছিলাম সবাই। আইস বুটে লাগানো ক্রাম্পনের কাঁটায় বরফ কচ কচ করে কাটছে। হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বুকসম বরফের মধ্যে। এমনই রোমাঞ্চকর লাকপারি পর্বতশৃঙ্গ অভিযান নিয়ে লিখেছেন শায়লা বিথী
পূর্ব আকাশে তখন সূয্যিমামা উঠি উঠি করছে, আশপাশে যতদূর চোখ যায় বিশাল বরফের পাহাড়। আর পেছন ফিরলেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট। চূড়ার কাছাকাছি এভারেস্ট অভিযাত্রী দলের লাইনটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় হাঁটছে তারা। এভারেস্টকে পেছনে রেখে আমরা শ্বেতশুভ্র পথ দিয়ে হেঁটে চলছি। শীতে জমে যাচ্ছিলাম সবাই। আইস বুটে লাগানো ক্রাম্পনের কাঁটায় বরফ কচ কচ করে কাটছে। সবার সামনে আমাদের প্রধান গাইড দাওয়া শেরপা তার পেছনে এমএ মুহিত এবং তার পেছনেই আমি হাঁটছি। আমার পেছনে আরও তিনজন। আমরা সবাই মেন রোপে বাঁধা অবস্থায় হাঁটছি।
হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বুকসমান বরফের মধ্যে। রোপে টান পড়লে সামনের সহযাত্রী দুজন দাঁড়িয়ে পড়ে, বাকিরা আর কাছে এগিয়ে এলো না। যেহেতু দাওয়া আমাদের প্রধান গাইড, তাই সবাইকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আমার কাছে এগিয়ে এলো। কাছে এসে আমার কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরে বলল, পুশ ইউরসেলফ! কিন্তু আমি কী পুশ করব, পায়ে কোনো তলই তো পাচ্ছি না! কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে দাওয়া অন্য এক সহকারী গাইডকে ডেকে আমাকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে ওপরে তুলল। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ দম নিলাম। আমি একটা হিডেন ক্রেভাসে বা লুকায়িত বরফ ফাটলে পড়ে গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে বড় কোনো দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছি। পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণের সময় আমাদের একটা ক্লাস ছিল এই ক্রেভাসে পড়ে গেলে কী করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে। এ ছাড়া পর্বতারোহীদের বিভিন্ন অভিযানে ক্রেভাসে পড়ে যাওয়ার গল্প পড়েছি অনেক! কিন্তু আমার সঙ্গেই এমনটা ঘটবে কল্পনাতেও ভাবিনি। আমাকে ওপরে তুলে প্রধান গাইড দাওয়া জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ভয় পেয়েছো? সামনে আরও যেতে চাও? সত্যি বলতে ভয় পেয়েছিলাম কিছুটা, কিন্তু হাসিমুখেই বলেছি আমি সামনে যেতে চাই।
পাঠকের মনে এতক্ষণে প্রশ্ন নিশ্চয়ই জেগেছে কোন পর্বত অভিযানে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে! সাসপেন্স আর বাড়াব না! ঘটনা বহুল এই অভিযানে গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের মে মাসে। বাংলা মাউন্টিনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) সদস্য হিসেবে এই অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। দলে ছিলেন বিএমটিসির প্রেসিডেন্ট ও এ পর্বত অভিযানের দলনেতা এভারেস্ট বিজয়ী এমএ মুহিত ও অভিজ্ঞ পর্বতারোহী কাজী বাহালুল মজনু।
৭ হাজার ৪৫ মিটার বা ২৩ হাজার ১১৩ ফিট উচ্চতার এই পর্বত তিব্বত সাইড দিয়ে এভারেস্টের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। লাকপারি শব্দের অর্থ স্ট্রোমি মাউন্টেন বা ঝড়ো পর্বত। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ কিংবদন্তি পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি এভারেস্ট পর্বতে রেকি অভিযান পরিচালনা করেন, তখন তিনি এই লাকপারি পর্বত জয় করেন।
লাকপারি পর্বত অভিযানের বিশেষত্ব হচ্ছে, এ অভিযানে পর্বতারোহীরা এভারেস্টকে খুব কাছে থেকে দেখতে পাবে এবং এভারেস্টের বেশখানিকটা পথ ট্রেকিং করার সুযোগ পাবে। বলা চলে অর্ধেক এভারেস্ট অভিযানের অনুভূতি পাবে। কেননা, লাকপারি পর্বতের বেসক্যাম্প তিব্বত সাইড দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প, মিডল ক্যাম্প এমনকি এভারেস্টের অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প সব একই। এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প থেকে লাকপারি পর্বতের পথ ও এভারেস্ট চূড়ার পথ আলাদা হয়েছে।
তিব্বত দিক দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করেই যাওয়া যায়। অভিযানের প্রথম দিনে আমরা নেপালের থামেল থেকে গাড়িতে করে নেপাল-চায়না বর্ডারের গ্রাম রসুয়াগাডি আসি। সেখান থেকে পরদিন বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিব্বতের কেরুং শহরে প্রবেশ করি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কেরুং শহরের উচ্চতা ২ হাজার ৭৭৪ মিটার। পরের একটা দিন এ শহরেই কাটাই। কেরুং শহর নতুন গড়ে উঠছে, তার ছাপ রয়েছে চারদিকে।
অভিযানের তৃতীয় দিন আমাদের গন্তব্য তিব্বতের তিংড়ি নামে অন্য একটা শহর। জিপে করে সকাল সকাল আমরা তিংড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। কেরুং থেকে তিংড়ি আসার পথটা অসাধারণ। হাইওয়ে দিয়ে যতদূরে চোখ যায় বিরানভূমি আর তার পরই বিশাল পাহাড়। ঠিক যেন সিনেমায় দেখা কোনো কাল্পনিক গ্রহ! পথে দিকুচে নামে একটা লেক পড়ে। এত বিশাল নীল পানির লেক আমি আগে কখনও দেখিনি। পরে গুগল করে জেনেছিলাম লেকটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে কোথাও কোথাও ৬ কিলোমিটার। এ ছাড়া কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট, ষষ্ঠ উঁচু পর্বত চোইউ এবং ১৪তম উঁচু পর্বত শিশাপাংমার দেখা পেয়েছি।
কেরুং থেকে তিংড়ি শহরে জিপে করে আসতে ৬ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। মূলত হাইওয়েকে কেন্দ্র করেই শহরটা গড়ে উঠেছে। এখানেও একটা দিন অতিরিক্ত কাটাই আমরা। এই চার দিনে খুব সামান্য হলেও ছোটবেলায় বইয়ে পড়া নিষিদ্ধ শহর তিব্বতে ঘোরার সুযোগ হয়েছে।
৮ মে দুপুর ১২টা নাগাদ তিংড়ি থেকে এভারেস্ট বেসক্যাম্প পৌঁছি। তিব্বত অংশে এভারেস্ট বেসক্যাম্পের উচ্চতা ৫ হাজার ১৫০ মিটার বা ১৬ হাজার ৯০০ ফিট। আগেই বলেছি তিব্বত সাইডে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করে আসা যায়। চারপাশে উঁচু উঁচু পর্বত আর তার মাঝে বিশাল এক ময়দানের মতো জায়গা। এটাই এভারেস্ট বেসক্যাম্প। আর নাক বরাবর সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চোমোলুংমা বা এভারেস্ট। এই প্রথম এত কাছ থেকে এভারেস্টকে দেখলাম। কেমন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে! চমৎকার আবহাওয়া ছিল সেদিন, তবে প্রচণ্ড বাতাস। শত শত টেন্ট বেসক্যাম্পে, যেন মেলা বসেছে। এখানে সবাই এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আমরাই শুধু লাকপারি অভিযানে এসেছি।
আমাদের টেন্ট বুঝে নিয়ে ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ডায়নিংয়ে গেলাম। সেখানে তিন পোলিশ পর্বতারোহী ও এক ইন্ডিয়ান পর্বতারোহীর সঙ্গে পরিচয় হলো। ওরা এভারেস্ট অভিযাত্রী। মাসখানেক আগে এসেছে অভিযানে। এখন ওদের এক্লাটামাইজেশন বা উচ্চতায় খাপ খাওয়ানোর সময় চলছে। ইতোমধ্যে তারা এভারেস্টের ক্যাম্প টু পর্যন্ত ঘুরে এসেছে। এখন শুধু অপেক্ষা করছে কয়েক দিনের ভালো আবহাওয়ার জন্য। তারপর ফাইনাল অভিযানে বেরিয়ে পড়বে।
পরবর্তী তিন দিন চলল আমাদের এক্লাটামাইজেশন। উচ্চতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বেসক্যাম্পের পাশে উঁচু পাহাড়ে ট্রেকিং করছি। বেসক্যাম্পে অবস্থানের চতুর্থ দিন আমরা এভারেস্ট মিডলক্যাম্প পৌঁছাই। সেখানে রাত কাটিয়ে পরবর্তী দিন আমরা এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পৌঁছাই। এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পের উচ্চতা ৬ হাজার ৩০০ মিটার। উচ্চতায় খাপ খাওয়াতে এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে আমরা আরও তিন দিন কাটাই। অতঃপর ১৭ মে রাত ২টা ৩০ মিনিটে আমরা লাকপারি পর্বত চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোতে পথ চলতে চলতে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করি। রোদ উঠলে ঠান্ডা কিছুটা কমে আসে।
সকালের আলো ফুটলেই চোখের সামনে লাকপারি পর্বতের দেখা পাই। দেখে মনে হলো, মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। খুব সহজেই পৌঁছে যাব আমরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলছি পথ, কিন্তু পথ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। অথচ লাকপারি একদম নাক বরাবর। মনে হচ্ছে একটা দৌড় দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায়। কতবার এমন হয়েছে আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি যে আর ওপরে আগাব না। ওখানেই থেকে যাব।
হাল যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখনই গাইড বলল, আর মিনিট দশেকের পথ, আমরা লাকপারির চূড়ায় পৌঁছে গেছি। ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় বেলা প্রায় ৩টা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা একটানা হেঁটে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম তখন ঠিক কী অনুভূতি হয়েছিল তা আজ আর মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছিলা না আমি লাকপারির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তবে সত্যি বলতে এতটাই ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিল কখন আমি টেন্টে ফিরে গিয়ে পা দুটোকে একটু বিশ্রাম দেব। আর পেটভরে খেতে পারব।
মনের মধ্যে যখন এসব এলোমেলো ভাবনা খেলা করছিল তখনই ভ্রম ভাঙাল দাওয়া শেরপার। বলল ফিরতে হবে দ্রুত। এই দীর্ঘ পথ ফিরতে হবে ভেবে আমার আবার চিন্তা বেড়ে গেল। একেই তো সকালের ক্রেভাসে পরে যাওয়ার ঘটনা আজ সারা দিন মাথায় গেঁথে ছিল। আবার সেই পথে ফিরতে হবে মনে করেই পা আর আগাচ্ছিল না। লাকপারির চূড়ায় আধা ঘণ্টার মতো থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরি। আরও ৬ ঘণ্টার মতো হেঁটে রাত সাড়ে ৯টায় অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পৌঁছাই। এই ফেরার পথটুকু আমি কীভাবে হেঁটেছি মনে নেই।
দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা ট্রেকিং করে শেষে যখন টেন্টে পা রাখলাম আমি কিছু সময়ের মতো অবচেতন ছিলাম। আমার ভাসা ভাসা মনে পড়ছে কোনো এক শেরপা দ্রুত আমার শরীর থেকে হার্নেস সেট, আইস বুট, আর উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট খুলে দিচ্ছে। কেউ একজন গরম পানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে খাওয়ার জন্য। স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিল আমার।
কিছু তথ্য
ছবি : লেখকের সৌজন্যে