মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:২৭ পিএম
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:২৮ পিএম
মিরসরাই উপজেলার বড় দরগার হাট অঞ্চলের গভীর পাহাড়ি বনে অবস্থিত মিরসরাই ট্রেইল ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
জায়গাটা মিরসরাই উপজেলার বড় দরগার হাট অঞ্চলের গভীর পাহাড়ি বনজঙ্গলে। দিনক্ষণ ঠিক করে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর বন্ধুরা এক রাতে মাইক্রোতে করে ছুটলাম। চট্টগ্রাম মহাসড়ক যানজটমুক্ত থাকায় ভোর সাড়ে ৪টার মধ্যেই মিরসরাই পৌঁছে গেলাম। গাইড আগেই অপেক্ষায় ছিলেন। তাকে তুলে এবার কমলদহ ব্রিক ফিল্ডের পাশের সড়ক ধরে রেললাইনের দিকে ছুটছি। পথে ব্রেক দিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো চাঁনমিয়া জামে মসজিদে ফজর নামাজ আদায় করে নিই।
এরপর গাড়ি গিয়ে থামল রেললাইনের ধারে। এবার সারা দিনের জন্য দুই পা-ই সম্বল। মেঠোপথ মাড়িয়ে, ক্ষেতের আল ধরে সবুজ পাহাড়ের দিকে হাঁটছি। একটা সময় হারিয়ে যাই পাহাড়ের ভাঁজে। এটি কমলদহ ট্রেইল নামে পরিচিত। মাত্র ২০-২৫ মিনিট হাঁটতেই ঝরঝরি ঝরনা পাই। ঝরনাধারাটা খুবই সুন্দর হওয়ায় বর্তমানে অতি উৎসাহী পর্যটকরা রূপসী ঝরনা নামে ডাকেন। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছায় ঝিরিপথে না গিয়ে ঝরঝরির পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে এগিয়ে যাই। ট্র্যাকিং করে যেতে যেতে অনেক ক্যাসকেড চোখে পড়ে। যেগুলো একেকটা ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যের। কেউবা ভুল করে ঝরনাও ভেবে থাকেন।
একটা সময় চোখে ধরা দেয় খুব সুন্দর একটি ঝরনা। নাম তার ছাগলকান্দা। গাইডের মুখে নামটা শুনে মুচকি না হেসে পারলাম না। ছাগলকান্দা ঝরনাটা বেশ চওড়া। প্রায় ৪০-৫০ ফিট উচ্চতা থেকে অবিরাম ধারায় ঝরছে। ইচ্ছামতো শীতল পানিতে শরীর ভিজিয়ে নিই। সকালে নাশতা না খাওয়ায় পেটে টান পড়ল কম-বেশি সবারই। তাই আর দেরি নয়। জঙ্গল থেকে শুকনো লাকড়ি জুগিয়ে নুডলসের জন্য গরম পানি বসিয়ে দেওয়া হলো। খেয়েদেয়ে দেহ চাঙ্গা। স্বল্প সময় হাঁটার পরই বেশ খাড়া ও পিচ্ছিল পথ সামনে আসে। তাই রিস্ক না নিয়ে রেপ্লিং করে উঠি।
ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুধরাজ ঝরনার দেখা মিলে। প্রতিটি ঝরনার নামই ভিন্ন রকম আকর্ষণের। এর ভৌগোলিক আকৃতিটাও বেশ চমৎকার। যাই এবার মধু খাইয়া ঝরনা দেখতে। বুনো পরিবেশে, ঝিরির পানিতে হাইকিং চলছে। চারপাশ নিঝুম নিস্তব্ধ একটা ভাব। বিষাক্ত চেলার ছুটে চলা। পায়ের নিচে পাথরের ভান্ডার। কোথাও কোথাও দুপাশের গাছগুলোর ডাল একটার সঙ্গে অন্যটা এমনভাবে জড়িয়েছে যে, সূর্যের আলোও হার মেনেছে। এ পাশটায় সাধারণ পর্যটকদের খুব একটা বিচরণ নেই। আর থাকেইবা কেমনে। দে-ছুট-এর দামালরাইত ঝিরির পানিতে, কম-বেশি চিৎপটাং খেয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। তবু ছিল না ক্লান্তি।
হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাই মধু খাইয়া ঝরনা। গা ছমছম করা পরিবেশ। ঝোপঝাড়, জঙ্গল দিয়ে ঘেরা মধু খাইয়া। পাথরের ভাঁজে ভাঁজে কলকল শব্দে পানি গড়িয়ে পড়ে। এর দ্বিতীয় ধাপে উঠতে হলে মধু খেয়েই উঠতে হবে! তা না হলে পা ফসকালেই পগারপার। কিন্তু এ কী হায়, কারও সঙ্গেই মধু নেই। তাই রেপ্লিং করেই উঠে পড়লাম। ওয়াও! অসাধরণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার মধু খাইয়া। ঝরনার ওপর থেকে জঙ্গলের রূপ দেখে বিমোহিত আপনাকে হতেই হবে।
দ্বিতীয় ধাপে ওঠার পর বুঝতে বাকি রইলা না যে, মধু খাইয়া ঝরনার রূপ যতনা না সুন্দর, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন এর অবস্থান। নামের সার্থকতা যাই হোক না কেন, তবে মধু খাইয়া দেখতে যাওয়ার ট্রেইলটা অসাধারণ ভালো লাগার। এ রকম রোমাঞ্চকর ট্রেইলে অংশ নিতে পারা, ভ্রমণ জীবনে সবার জন্যই হবে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।
মধু খাইয়ার নির্যাস নিয়ে ফিরে আসি, আবারও ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো থাকা জায়গাতে। কমলদহ ট্রেইলে এ রকম অনেক ওয়াই সাদৃশ্য স্থান রয়েছে। যার প্রতিটি ধরে আগালেই প্রকৃতির নানা রূপ চোখে ধরা দেবে। আমরাও যাচ্ছি। বেশ কিছুটা সময় হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পর পেলাম, অনিন্দ্য সুন্দর পাথর ভাঙা ঝরনা। তীব্রগতিতে প্রায় ৭০-৮০ ফিট উচ্চতা থেকে অবিরাম ধারায় পানির ছন্দপতন।
স্ফটিক স্বচ্ছ পানির রঙ অনেকটা নীলাভ। ঝরনার আকৃতি অনেকটা ছুরির মতো। ঝরনার সামনে প্রাকৃতিকভাবেই জলাধার সৃষ্টি হয়েছে। সেই জলাশয়ের শীতল পানিতে মন ভরে ডুবডুবি চলে। সকাল গড়িয়ে বিকাল। তাই আর দেরি না করে বারৈয়ার ঢালা দিয়ে ফেরার পথ ধরি।
যাবেন কীভাবে : ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে চড়ে নেমে যেতে হবে মিরসরাই উপজেলার বড় দরগার হাট। সেখান থেকে সিএনজি/অটোতে কমলদহ গ্রামের রেললাইন।
ভ্রমণ তথ্য : সময় নিয়ে ভালোভাবে দেখতে হলে সকাল সকাল যেতে হবে। সব মিলিয়ে ৭-৮ ঘণ্টার ট্রেইল। সঙ্গে ভালো মানের দড়ি রাখুন। খাবার-দাবারের অপচনশীল মোড়ক ফেলে আসবেন না। প্রয়োজনে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলবেন। দক্ষ গাইড সঙ্গে নিন। অন্যথায় হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।