× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মেঘের দেশে পাঁচ দিন [শেষ পর্ব]

ভালোবাসার শিলং

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২২ ১৮:০৭ পিএম

আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:২০ এএম

ভালোবাসার শিলং
ভালোবাসার শিলং
ভালোবাসার শিলং

শিলংকে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। আজও ব্রিটিশ আমলের কিছু বাড়ি সেই সাক্ষ্য বহন করছে। উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। তার চূড়ায় তুলার মতো মেঘ। রঙ-বেরঙের ফুল-অর্কিড-গাছগাছালির সমাহার। পাহাড়ের বুক চিরে ঝরছে অজস্র ঝরনাধারা। পাদদেশে আঁকাবাঁকা সড়ক। এখানকার রাস্তা, বাড়িঘর, সরকারি ভবন সবকিছুই সাজানো, গোছানো, সুন্দর। বিশেষ করে সরকারি ভবনগুলো স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য। 

যদিও চেরাপুঞ্জি ঘুরে আসার পর শিলং শহরকে তেমন ভালো লাগেনি। শিলং পাহাড়ের পাইনে ঘেরা যে পরিবেশ শেষের কবিতার পাতায় পাতায় পেয়েছিলাম তার তেমন কিছুই নজরে এলো না। এমনকি ওয়ার্ডস লেক এবং তৎসংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখেও মন ভরেনি। ঘিঞ্জি শিলং শৈলশহর আর পাঁচটা পাহাড়ি শহরের মতোই বর্তমানের বহুতল কালচারে ভুগছে। এমনকি চেরাপুঞ্জির বড় বড় ঝরনা দেখে আসার পর এখানকার এলিফ্যান্ট ফলস, স্প্রেড ঈগল ফলস, সুইট ফলসকেও খুবই সাধারণ মনে হয়েছে। তাপরও শিলং অনন্য, অসাধারণ। এখনও শিলংয়ে যা আছে, তা অন্য কোথাও নেই। 

আমরা শিলং পৌঁছি ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায়। সেদিন ছিল রোববার, সাপ্তাহিক ছুটি। দোকানপাট সব বন্ধ। পরদিন ভারতের স্বাধীনতা দিবস হওয়ায় সেদিনও ছিল সবকিছু বন্ধ। কাজেই সন্ধ্যার পর মার্কেটে ঘোরা, কিছু কেনাকাটা করা, ফুটপাতের খাবার খাওয়া, এসবের কিছুই হয়নি। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হওয়ায় সকাল থেকেই চোখে পড়ছিল বিভিন্ন যানবাহন, অফিস-বাসভবনে ভারতীয় পতাকার সমারোহ। শহরের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বাংলাদেশের মতো এখানেও দেখলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুচকাওয়াজ হচ্ছে। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ, গাড়ি, ভিড়, জ্যাম। 

আগের দিন রাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও সকালে আমরা যখন হোটেল থেকে বের হই, তখন ছিল কড়া রোদ। গরমও ছিল অনেক। আমরা প্রথমে গেলাম উমিয়াম লেক, স্থানীয়রা যাকে বলে ‘বড়া পানি।’ এই লেককে ওপর থেকে যতটা সুন্দর লাগে, কাছে গিয়ে ততটা লাগে না। কাঠফাটা রোদ আর তীব্র গরমের কারণে আমরা লেকের ভেতরে ছায়ায় গিয়ে খানিক্ষণ বসে থাকলাম। কিন্তু তপ্ত আবহাওয়ায় বোটিং করার ইচ্ছে হলো না। লেকটা এমনিতে চমৎকার। চারদিকে ঘন সবুজ পাহাড়ের মাঝে লেকটি একটা আলাদা সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এটি ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে উমিয়াম নদীকে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। শিলংয়ের পানির মূল উৎসও নাকি এই উমিয়াম লেক। 

এই লেক থেকে বের হয়ে আমরা যাত্রা করি সুইট ফলস দেখতে। আমাদের গাড়ি চালক সজল জানালো, পাহাড় থেকে খুব সুন্দর করে এই ঝরনার জল পড়ে বলে এর নাম সুইট লেক। আমরা যখন মূল শহরে প্রবেশ করলাম, তখন মেঘালয় যার জন্য বিখ্যাত সেই বৃষ্টি নামল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। পাহাড়ি ঢল। উমিয়াম লেক থেকে সুইট ফলস পর্যন্ত মাত্র ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন ভবন থেকে পানির স্রোতধারা রাস্তায় নেমে আসছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির জলে সয়লাব পুরো শহরটাকেই একটা ঝরনা মনে হলো। রাস্তায় শত শত গাড়ি। বৃষ্টি ও জলের তোড়ে গাড়িগুলোও ধমকে আছে। পাহাড়ে বৃষ্টির একটা সুবিধে হচ্ছে এখানে জল দাঁড়ায় না, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জল সরে যায়। জ্যাম ঠেলে শহর পেরিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারের রাস্তায় গিয়ে উঠলাম। দুই পাশে ঘন সবুজ বন। মাঝে এক চিলতে পিচঢালা রাস্তা। আর আকাশ থেকে ঝরছে অঝোর বৃষ্টি। দূরের পাহাড়গুলো কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টাটা সুমো গাড়িতে আমরা ছয়জন নিশ্চুপ হয়ে ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে গোগ্রাসে গিলছিলাম এমন অনির্বচনীয় দৃশ্য। 

মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘শিলংয়ের চিঠি’-তে তিনি লিখেছেন, ‘গর্মি যখন টুটলো না আর পাখার হাওয়া শরবতে ঠান্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলং নামক পর্বতে।’ কবির ঠিকানা ছিল ‘জিৎভূমি’। টানা দুমাস ছিলেন তিনি ওই বাড়িতে। অন্যধারার উপন্যাস শেষের কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘শিলং পাহাড়টা চারদিক থেকে অমিতকে নিজের মধ্যে যেন রসিয়ে নিচ্ছে। আজ সে উঠেছে সূর্য ওঠবার আগেই। জানলা দিয়ে দেখলে দেবদারু গাছের ঝালরগুলো যেন কাঁপছে, আর তার পিছনে পাতলা মেঘের উপর পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্য তার তুলির লম্বা লম্বা টান লাগিয়েছেÑআগুনজ্বলা যেসব রঙের আভা ফুটে উঠেছে তার সম্বন্ধে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই!’ 

এক সময় আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই সুইট ফলসে। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করার পর গাড়িচালক সজল আমাদের নামতে বলল। কিন্তু দরজা খুলেই টের পেলাম, এমন প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে সুইট ফলসের সৌন্দর্য উপভোগ সম্ভব নয়। সকালে তীব্র রোদ ও গরম দেখে আমরা ছাতা-রেইনকোট সব হোটেলেই রেখে এসেছি। কে জানত, আজ এমন বৃষ্টি নামবে। কিছুক্ষণ গাড়িতে বসে দূর থেকে সুইট ফলস দেখে আমরা মনের মধ্যে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সুইট ফলস বাউন্ডারি ছাড়িয়ে মিনিট পাঁচেক চলার পর আকস্মিক বৃষ্টি থেমে গেল। আমাদের গাড়িচালক সজল সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার সুইট ফলসে নিয়ে এল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে বেশ খানিকটা নিচে নেমে দেখলাম বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের কোল থেকে ‘সুইট ফলস’ নামের আদুরে কন্যার খলখলিয়ে নেমে আসার দৃশ্য। শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এই সুইট ফলস। বহু দূরে পাহাড় থেকে প্রায় ২০০ ফুট নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ঝরনাটি। সবচেয়ে খাড়া এবং সবচেয়ে মায়াবী জলপ্রপাতগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত এই সুইট ফলস। পুরো এলাকাটি নির্জন এবং শান্ত। জনমানবহীন। ঝরনাজলের আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। নির্জনতার স্বাদ ভালোভাবে উপভোগ করে আমরা ফিরলাম শহরের দিকে।

কিন্তু আকাশের আজ সত্যিই মন খারাপ। থেমে থেমে কেবলই কাঁদছিল। আমাদের এখনকার গন্তব্য ক্যাথেড্রাল চার্চ। এটা শিলংয়ের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো চার্চ। চার্চটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে, একটা অর্ধচন্দ্রাকার সিঁড়ি ভেঙে এর প্রার্থনাগৃহে যেতে হয়। এই চার্চের মূল আকর্ষণ এর অভিনব স্থাপত্যশৈলী। গির্জার ভেতরে যিশুখ্রিস্টের জীবনের নানা কাহিনি, উপাখ্যান ও ঘটনাবলিকে অবলম্বন করে অসাধারণ তৈলচিত্র আঁকা আছে।

পরিষ্কার দিনের আলোয় এই গির্জা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং বরফে আচ্ছাদিত হিমালয়ের চূড়াও নাকি দেখা যায়। বৃষ্টি ও মেঘের বাড়াবাড়িতে আমরা অবশ্য সেই দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। বৃষ্টির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমরা পুরো গির্জাটি প্রদক্ষিণ করি। আমাদের মতো শত শত পর্যটক এই গির্জা দেখতে এসেছেন। ভবনটি এমনই গাম্ভীর্যপূর্ণ অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে, এর সামনে গেলেই শ্রদ্ধায় মাথাটা কেমন আনত হয়ে যায়।

ক্যাথেড্রাল চার্চ দেখে আমরা গেলাম ব্যাম্বু হাট রেস্টুরেন্টে, দুপুরের খাবার খেতে। সেখানে খেলাম হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি। প্রতি প্লেট তিনশ বিশ রুপি। দারুণ টেস্ট। বিকেলে গেলাম গলফ্ গ্রাউন্ডে। প্রথমেই একপশলা বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে দিল। পাইনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখলাম। বৃষ্টি থেমে গেলে পূর্বাকাশে দেখা গেল রঙধনু। সে আরেক সৌন্দর্য। ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দেশের অন্যতম পুরোনো এই গলফ কোর্সটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম। ১৮টি হোল আছে গলফ মাঠে। পাশেই পোলো গ্রাউন্ড। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের বিস্তার, সবুজ ঘাসের কার্পেট আর পাইন বনের শোভা— এক অনবদ্য কোলাজ।

গলফ্ গ্রাউন্ড থেকে আমরা গেলাম পুলিশ বাজার। সেখানে দিল্লি মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে বিভিন্ন পদের মিষ্টি খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে সাদ হোটেলে রুমপ্রতি সাড়ে তিন হাজার রুপি বিল মিটিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম পুলিশ বাজার। সেখানে কিছু দোকানপাট ঘুরে দেখলাম। কিন্তু কেনার মতো তেমন কিছু পেলাম না। জিনিসপত্র মানের তুলনায় দাম অনেক বেশি মনে হলো। সেখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে আমরা চললাম ডাউকির উদ্দেশে। 

দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে আমরা শিলং শহর থেকে বাইরে বের হলাম। এরপর রাস্তাঘাট সব সাদা মেঘে ঢাকা পড়তে থাকল। এই মেঘের মধ্য দিয়েই আমাদের গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকল। চারদিকের পাহাড়গুলো মেঘের নিচে চাপা পড়ে গেছে। প্রায় ৫০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের কোনোটির ওপর দিয়ে আর কোনোটির কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকল। ছোট ছোট বাচ্চারা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাল! মেঘালয় আজ যেন মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে রয়েছে। ডাউকির কাছাকাছি আসার পর প্রথম রোদের দেখা পেলাম। 

ডাউকি বাজারে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন আমরা ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে চারটা। আজ আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হলো না। খুব দ্রুত দুই প্রান্তের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হয়ে গেল। সিলেটের তামাবিল প্রান্তে এসে আমরা বাড়ির পথে রওনা হলাম। কিন্তু মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে রইল। এই বিষণ্ণতা মেঘ-পাহাড়-গুহা-ঝরনা-অর্কিড ও ফুলের জন্য। অসাধারণ প্রকৃতির জন্য, সহজ-সরল মানুষগুলোর জন্য। রোজকার যান্ত্রিকতাঘেরা জীবনকে দূরে সরিয়ে রেখে পাঁচটা দিন আসলেই অন্যরকমভাবে অনুভূতির মধ্যে কাটল। মেঘালয়ের এই পাঁচটা দিন ছিল ঘোরলাগা ভালোলাগায় ভরা। রোজকার রুটিনে তো ফিরতেই হবে। আমরাও ফিরছি। কিন্তু হৃদয়জুড়ে থেকে গেল মেঘালয় ভ্রমণের স্মৃতি।

প্রবা/জিকে



শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা