× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মেঘের দেশে পাঁচ দিন [পর্ব-৩]

প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি চেরাপুঞ্জির গুহা

চিররঞ্জন সরকার

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২২ ১৭:৩৭ পিএম

আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২২ ১৭:৪৮ পিএম

প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি চেরাপুঞ্জির গুহা
প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি চেরাপুঞ্জির গুহা

চেরাপুঞ্জিতে আমরা যে হোটেলে ছিলাম এর নাম Me-Me-Ai Heaven এটা চেরাপুঞ্জির বিখ্যাত আবাসিক হোটেল Polo Orchid Resort পার হয়ে একটা খোলা জায়গায় তিনতলা এই গেস্ট হাউসটির সামনে সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত খোলা মাঠ মাঠের পরেই পাহাড়ের সারি পেছনে ছোট্ট লেক হোটেলের তিনতলার লবিতে দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্য দেখলে চোখ মন ভরে যায় অন্য সময় এর ভাড়া কম থাকলেও ভরা পর্যটন মৌসুমে আমাদের প্রতি রাতে পাঁচ হাজার রুপি গুনতে হয়েছে সঙ্গে অবশ্য কমপ্লিমেন্টারি নাশতা ছিল খাওয়ার জন্য আলাদা বিল হোটেলে ওয়াইফাই সুবিধা ছিল না তবে গিজার ছিল সার্ভিসও ছিল সন্তোষজনক

এই হোটেলে দুই রাত কাটানোর পর আজ আমরা শিলং চলে যাব তাই সকাল-সকাল হোটেলের লেনদেন চুকিয়ে বের হয়ে পড়ি আমাদের গাইড গাড়িচালক শংকর জানাল, আজ আমাদের কার্যক্রম গুহা পরিদর্শন ওরা অবশ্য গুহা বলে না, ইংরেজিতে কেইভ বলে

কেইভ, সুড়ঙ্গ বা গুহার নাম শুনলেই গা ছমছম করে মানুষের আদি বাসভবনই তো গুহা গল্প, উপন্যাসে এই গুহা বা সুড়ঙ্গ নিয়ে রয়েছে নানা ঘটনা এর সবই প্রায় রহস্যময় কিন্তু যারা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ভ্রমণ করেন, তাদের কাছে গুহাভ্রমণ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা


মেঘালয় শুধু বৃষ্টি বা জলপ্রপাত নয়, গুহার রাজ্য হিসেবেও পরিচিত এখানে অসংখ্য গুহা আছে মেঘালয়কে ঘিরে আছে তিনটি পাহাড়- খাসি, জয়ন্তিয়া গারো বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সংখ্যক গুহাপ্রেমী আসেন মেঘালয়ে কারণ এখানে প্রায় ১০০০টির মতো গুহা আছে তবে এর বেশিরভাগই দুর্গম, সাধারণের নাগালের বাইরে হাতোগোনা কয়েকটিতে মানুষ যায় এর অন্যতম হচ্ছে মৌসমাই আরওয়া

আমরা প্রথমেই যাই মৌসমাই [Mawsmai] কেইভ বা গুহায় প্রায় ৪০ মিনিট মেঘের ভেতর দিয়ে ছুটে নসিংথিয়াং জলপ্রপাত পার হয়ে তারপর পৌঁছলাম মৌসমাই পাহাড়ের মধ্যে গাছপালায় ঢাকা গুহার চারপাশ

গুহাটি অন্ধকারে ঢাকা একটি টর্চের আলো বা হালকা অন্য কোনো ধরনের আলো ফেললে এখানে এক বিস্ময়কর গুপ্ত সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় গুহার অভ্যন্তরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্ট্যালাগমাইট, স্ট্যালাকটাইট এবং দেয়াল অসংখ্য স্ফটিক আলোকরশ্মি প্রতিফলিত করে বিজ্ঞানের ভাষায়, গুহার ছাদ থেকে সরু স্ট্রয়ের মতো যে পাথরখণ্ডগুলো ঝুলে থাকে, সেগুলোকে স্ট্যালাকটাইট বলে আর গুহার নিচ থেকে যে স্তম্ভগুলো ওপরে উঠে আসে, সেগুলোকে বলে স্ট্যালাগমাইট মৌসমাই গুহার বড় বৈশিষ্ট্য হলো স্ট্যালাগমাইট স্ট্যালাকটাইটের নানা আকার আকৃতি



এর তলা থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই পাথরের ছাদ আর দেয়াল চুইয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে গুহার ভেতরে জল কোথাও অল্প, কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা এই জলে ভিজতে ভিজতে গুহায় পথ চলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর অদ্ভুত রূপে ধরা দিচ্ছে গুহার ভেতরে কোথাও কোথাও পাশাপাশি দুজনের চলতে অসুবিধা হয় কোথাও কোথাও এতটাই সংকীর্ণ যে রীতিমতো জড়সড়ো হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে গুহার ভেতরে জেনারেটরের সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা আছে ভেতরটা অসমতল এবড়োথেবড়ো, পাথর চুইয়ে চুইয়ে জল পড়ায় যথেষ্টই পিচ্ছিল

গুহার ভেতরে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা আকৃতির কখনও মানুষের মুখ, কখনও হাঁস বা পাখি কোনো কোনো জায়গায় পাথর বেয়ে একটু ওপরে উঠে আবার নামতে হয় ভেতরে ছাদ থেকে নেমে আসা পাথরের অদ্ভুত আকার আমাদের কাছে একেবারেই আনকোরা একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত গিয়ে পর্যটকদের ফিরে আসতে হয় আসা এবং যাওয়ার পথে আমরা অনেক ছবি তুললাম গুহার ভেতরে হেঁটে বেড়ানো এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

মৌসমাই গুহা থেকে বের হয়ে আমরা চললাম আরওয়াহ [Arwah] কেইভ পার্ক এটা পর্যটন এলাকা হিসেবে খুব সম্ভবত নতুন সংযোজন

আরওয়াহ কেইভে যাওয়ার পথটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় চারদিকে ঢেউ খেলানো পাহাড় আলো-ছায়ায় পাহাড়ের রঙও বিচিত্র কোথাও সবুজ, কোথাও টিয়া, কোথাও হালকা সবুজ চারদিকের সবুজ পাহাড়ের বিচিত্র রূপের এই দৃশ্য যেন ভোলার নয়

টিকিট কেটে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি উল্লেখ্য, এখানকার প্রতিটি স্পটে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে হয় টিকিটের দাম ৩০ রুপি থেকে দেড়শ রুপি পর্যন্ত

আরওয়াহ কেইভ পার্কে রয়েছে আলাদা আলাদা ১১টি স্পট গুহা দিয়ে প্রবেশ করে জলপ্রপাত, নদী, জঙ্গল, বাঁশের সাঁকো, বিশুদ্ধ জলের (ওদের ভাষায় মেডিসিন ওয়াটার) ঝরনাসহ আরও নানা কিছু চোখে পড়বে এর সিঁড়িগুলোও অত্যন্ত সুন্দর মাঝে মাঝে মেঘ এসে সিঁড়িগুলো ঢেকে দিচ্ছে মনে হচ্ছিল, মেঘের ভেতর সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি

ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই গুহাটি বিশাল বড় সুন্দরভাবে হাঁটা যায়, চাইলে নাচাও যায় এর পুরো নাম আরওয়াহ লুমশাইন্না কেইভ এটি লাখ লাখ বছরের পুরোনো জীবাশ্ম দিয়ে গড়া এর কাঠামোটি চুনাপাথরের এবং স্ট্যালাগমাইট স্ট্যালাক্টাইট প্রাকৃতিকভাবে খোদাই করা এটিতে অনেক সরু প্যাসেজ, চেম্বার এবং সেই সঙ্গে একটি স্রোতধারা রয়েছে

গুহার প্রবেশদ্বারটি অ্যারাবিয়ান নাইটস থেকে সোজা বাইরে, একটি জটিল সেটের দিকে নিয়ে যায় এর ভেতরটা আলোকিত এবং চুনাপাথরের দেয়ালে ক্রাস্টেসিয়ান শেল মাছের হাড়ের জীবাশ্ম দেখা যায়

এর অনেক বাঁক কোণ রয়েছে যা অবাক করার মতো গুহার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কখনও ঝরনা কখনও সমতল, কখনও উঁচু পাথরের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি পুরোটাই যেন একটি গোলকধাঁধা

গুহায় হাঁটার পথটি অত্যন্ত মনোরম মোহনীয় যা ঘন গাছপালা থেকে নান্দনিকভাবে খোদাই করা হয়েছে একপর্যায়ে পথটি লশিনা পাহাড়ের পাশ দিয়ে যায়, যা জলপ্রপাত আশেপাশের উপত্যকার আশ্চর্যজনক দৃশ্য উপহার দেয়

এই গুহায় ভ্রমণ এক দুর্লভ দুষ্প্রাপ্য অভিজ্ঞতা গুহা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাই বাঁশের সাঁকো পার হলে সেখানে সর্বরোগের একটি বিশুদ্ধ জলের (মেডিসিন ওয়াটার) ঝরনা আছে আমরাও সেই ঝরনার শীতল জল পান করি যদি যাবতীয় রোগের উপশম হয়!


গুহা পরিভ্রমণের শেষ প্রান্তে দেখলাম একটি পাথরের গর্তে জল জমে আছে সেখানে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এই গর্তে টাকা ফেললে মনের বাসনা পূরণ হবে! পর্যটকরা অন্ধবিশ্বাসে টাকা, আধুলি, সিকি ছুড়ে দেওয়ায় পানির নিচে ভালোই স্তূপ জমে আছে টাকা নয়, বিশ্বাসই এখানে মুখ্য, হয়তো কেউ পেয়েছে কখনও কোনো আরাধ্য হয়তো পায়নি, হয়তো পাবেও না তবু মানুষ আঁকড়ে থাকে বিশ্বাস নিভৃত একান্তে!

এই বিচিত্র কিন্তু অসাধারণ গুহা থেকে বের হয়ে আমরা সোজা শিলংয়ের পথ ধরলাম

রাস্তার পাশে দেখলাম কালো কালো কয়লার মতো পাথর পড়ে আছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওগুলো সত্যিই কয়লা খাসি-ভাষায় সোহরা বা সোরা অর্থাৎ কয়লা, ব্রিটিশদের উচ্চারণে হয়ে গেছে চেরা এবং সোরাপুঞ্জি হয়ে গেছে চেরাপুঞ্জি!

পরদিন স্বাধীনতা দিবসের ছুটি থাকায় পর্যটকে ভরে গেছে পথঘাট গাড়ি, বাইক নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়েছে সৌন্দর্য-সুধা অন্বেষণে

পুরো চেরাপুঞ্জিই যেন দিগন্তজুড়ে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের মিছিল আর সেই পাহাড় থেকে নেমে আসছে অসংখ্য ঝরনা পথে বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট একের পর এক বিভিন্ন ঝরনার নাম চোখে পড়ল ওয়াকাবাকা ওয়াটার ফলস ডুয়ান সিং ফলস ড্যানথেলন ফলস

এক সময় আমরা ম্যাকডক ব্রিজ পৌঁছলাম এটাও একটা ভিউ পয়েন্ট এই ব্রিজের পাশে একটি ছোট্ট হোটেলে পড়ন্ত দুপুরে খাবার খেয়ে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম

পাহাড়ের মৌনতা, সবুজ উপত্যকা, পাইন বনের রোমান্টিকতাকে সঙ্গী করে আমরা শেষ বিকেলে পৌঁছে যাই শিলং শহরে

 

[আগামীকাল প্রকাশিত হবে চতুর্থ পর্ব : ভালোবাসার শিলং]

 

প্রবা/জিকে/এমজে/

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা