মেঘের দেশে পাঁচ দিন
চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২২ ১৮:০৫ পিএম
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২২ ২৩:৪০ পিএম
ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এখানে তিন দিন অবস্থানকালে আমরা মেঘের দেখা পেলেও বৃষ্টি পাইনি। অথচ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ভারী বর্ষণের কথা বলা ছিল। আমরা ছাতা-রেইনকোট, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, পাতলা টি-শার্ট কত কিছুই না বয়ে এনেছি। কিন্তু এগুলো কোনো কাজে লাগেনি। কে জানে ক্লাইমেট চেঞ্জের কুপ্রভাবেই বুঝি এখন চেরাপুঞ্জিও আর আগের মতো আর বৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে পারে না!
সকালে হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি নাশতা লুচি-মটর-আলুর ডাল আর চা খেয়ে আমরা বের হলাম ঝরনা দেখতে। গাড়ি যত এগুতে থাকল, ঘন কুয়াশার মতো মেঘ পুরো পথঘাট ঢেকে দিতে থাকল। চারপাশের পাহাড়, বন, ঝরনা কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সেভেন সিস্টার্স ফলস, কেইনরেম ফলস--সব যেন ঘন মেঘের চাদরে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে। আমাদের চালক শংকর কেইনরেম ফলসের সামনে গিয়ে গাড়ি পার্ক করল। আমরা কিছুক্ষণ মেঘে ঢাকা ঝরনা দেখতে দেখতেই মেঘ কেটে গিয়ে উজ্জ্বল আলোয় পুরো ঝরনা নিজেকে মেলে ধরল। এক ঘোরলাগা অভাবনীয় সৌন্দর্যে আমরা আচ্ছন্ন হলাম। ‘চপল পায় কেবল ধাই/ উপল-ঘায় দিই ঝিলিক,/ দুল দোলাই মন ভোলাই,/ঝিলমিলাই দিগ্বিদিক।’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ঝরনার গান’ কবিতার বাস্তব রূপ যেন দেখতে পেলাম।
ভারতের সপ্তম বৃহত্তম জলপ্রপাত কেইনরেম। পাহাড়ের ওপর থেকে এক হাজার এক ফুট উচ্চতা ধারণ করে জলপ্রপাতটি ঘন অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ খেলানো পাথুরে পাহাড়গাত্রে এটি তিনটি স্তর তৈরি করেছে। প্রথম স্তর থেকে চোখ সরিয়ে দ্বিতীয়টিতে, সবশেষে এর তৃতীয়টিতে। এর জলধারা গভীর অরণ্যে গিয়ে পড়ছে। এই জলধারাকে অবাধ করতে রাস্তার ওপর বানানো হয়েছে সেতু। দুর্গম সড়কটি নাকি বাংলাদেশের হালুয়াঘাট সীমান্ত পর্যন্ত গেছে।
এখানে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম নতুন এক জায়গায়। এর নাম কোহ রামহাহ বা মোট্রপ। নামটা বেশ খটোমটো। কোহ রামহাহ আসলে দুইশ ফুট উচ্চতার এক দানবীয় গোলা আকৃতির পাথর। ওপরের অংশটা গম্বুজের মতো। তলদেশ থেকে দুইশ ফুট উঁচু গোলাকার পাথর। পাহাড়ের ঢালে তা প্রাকৃতিকভাবে স্থাপিত হয়ে আছে, যার পাশে একই আকৃতির আরও দুটি ছোট পাথর, মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি উচ্ছল ঝরনা। জঙ্গলে ঘেরা গিরি থেকে অবিরাম নেমে আসছে এই জল। কোহ রাহমাহ বা পিলার রকের পাশ গড়িয়ে পড়ছে কয়েক হাজার ফুট নিচে। নিচে ঘন জঙ্গলময় প্রাকৃতিক নিসর্গ। অদূরে বাংলাদেশের সমতলে বয়ে যাওয়া নদী। মেঘ কখনও সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। আবার কখনও উন্মুক্ত করছে।
পাহাড়-জঙ্গল-ঝরনার এই লোকেশন থেকে আমরা যাই পার্শ্ববর্তী থাংখারাং পার্কে। শহরের মধ্যেই ফুলের বাগান, অর্কিড দিয়ে সাজানো মনোরম ইকো পার্ক। সামনে দিগন্তবিস্তৃত ভ্যালি গিয়ে মিশেছে বাংলাদেশের সমতলভূমিতে আর পায়ের নিচে বয়ে চলছে ছোট ছোট জলধারা, যেগুলো রূপ নিয়েছে জলপ্রপাতে।
বড়সড় চত্বরের পাশে গুটিকয়েক হস্তশিল্পের দোকান। চা-পিঠার দোকান। সেখানে চা খেয়ে টিকিট কেটে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। পাঁচ হেক্টরের বেশি আয়তনের থাংখারাং পার্কের শেষ মাথায় লুকআউট ডেক। এর বেষ্টনীগুলো বাংলাদেশের পতাকা লাল-সবুজ রঙে রঞ্জিত। আছে ঘন অরণ্যে বিচরণ করবার পথ। এখান থেকেও নাকি বাংলাদেশ দেখা যায়। কিন্তু ঘন মেঘের ওড়াউড়ির কারণে আমরা সেই সৌন্দর্য দেখতে পাইনি।
থাংখারাং থেকে আমরা যাই সেভেন সিস্টার্স ফলস। এটাকে চেরাপুঞ্জির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ধরা হয়। সাতটি ঝরনাধারা একসঙ্গে ঝরে পড়ছে, সাত বোনের মতোই। সকালে মেঘে ঢাকা থাকলেও এখন রোদের আলোয় পুরো এলাকাটা ঝলমল করছে। তবে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় আমরা কেবল পাঁচ বোনেরই দর্শন পেয়েছিলাম। বর্ষাকালে যখন পাহাড়ের চূড়া থেকে সাতটি ধারাই বইতে থাকে তখন এর সৌন্দর্য নাকি অবর্ণনীয়। কিন্তু খরার কারণে আমরা সেই রূপ দেখতে পাইনি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই জলপ্রপাতের উচ্চতা ১ হাজার ৪৮৪ মিটার।
সবুজ পাহাড়ের গায়ে ক্ষীণ ধারার যে ‘পাঁচ বোন’কে আমরা দেখলাম, সেটাও নয়নাভিরাম। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা বিনুনির মতো সরু জলধারা হারিয়ে গেছে নিচে। চারদিক উন্মুক্ত। দূরে দেখা যায় শুধু পাহাড়ের সারি। নিচের দিকে তাকালে দেখা যায় না ঝরনার প্রবাহপথ। পাহাড়ের সবুজ গাছপালার মাঝে ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে পড়েছে এ জলপ্রপাতটি। এর পানি চুনাপাথরের ওপর আছড়ে পড়ায় পানি পড়ার গর্জন শোনা যায় অনেক দূর থেকেও।
এরপর চেরাপুঞ্জি বাজারে ‘গোল্ডেন স্পুন’ হোটেলে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। মেঘালয়ের সব হোটেলেই ভাত, ডাল, রুই মাছ, সবজি, মুরগি, ডিম ইত্যাদি পাওয়া যায়। দেড় থেকে দুইশ রুপির মধ্যে একজন পেট ভরে খেতে পারবেন। রান্নাও ভালো। খাওয়ার পর আমরা গেলাম নোহকালিকাই ফলস দেখতে। খাসি ভাষায় এর নাম ‘Jump of Ka Likai’। এই ঝরনাকে ঘিরেও একটা গল্প রয়েছে। উল্লেখ্য, মেঘালয় হচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিপ্রধান রাজ্য। খাসি সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, এখানে মায়ের নামেই সন্তানের পরিচয়। সম্পত্তি পায় সবচেয়ে ছোট মেয়ে। তারপরও অলিখিতভাবে মামা বা পুরুষের কর্তৃত্ব চলে। মেয়েরা শেষ পর্যন্ত প্রান্তিকই থেকে যায়। যা হোক, Ka likai নামের এক নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরে তার আগের পক্ষের মেয়েকে তার স্বামী হত্যা করলে নারীটি রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে ওই জায়গায় নোহকালিকাই।
প্রায় ১০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে অনেক নিচে সটান আছড়ে পড়ছে ঝরনার জল। বিশাল উন্মুক্ত অঞ্চল। বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে পাহাড়ের পাথুরে শরীরটার মাথাটা সবুজ চাদরে ঢাকা। নিচে জমাট বাঁধা সাদা মেঘ। অনেক নিচে সৃষ্টি হয়েছে ছোট জলাশয়। স্নিগ্ধ নীল তার রঙ। হাজার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া যায় জলাশয়ের কাছে। বর্ষায় ঝরনাটি নাকি যৌবনে ভরপুর হয়ে ওঠে।
নোহকালিকাই ফলসের কাছেই আছে বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট। পরিষ্কার আবহাওয়ায় দেখা যায় বাংলাদেশ। এখানে ট্যুরিস্টদের জন্য দারুচিনি আর মধু নিয়ে বেচতে বসেছেন অনেক বয়স্ক খাসি নারী। আছে আরও কিছু পণ্য। আমরা কিছু দারুচিনি কিনে পাহাড়ের শেষপ্রান্তে চলে যাই। এখানকার দৃশ্য যে কত সুন্দর, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবুজ পাহাড়ে মোড়ানো এমন প্রশান্তির সমতলে সবুজ ঘাসের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে বা বসে সম্ভবত অনন্তকাল কাটিয়ে দেওয়া যায়!
[আগামীকাল থাকছে তৃতীয় পর্ব]
প্রবা/জিকে