মেঘের দেশে পাঁচ দিন
চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২২ ১৬:৪৪ পিএম
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২২ ১৯:১৮ পিএম
ইমিগ্রেশন-পর্ব শেষ করে আমরা ৬ জন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকা শংকরের নতুন টাটা সুমোতে উঠে বসলাম। ডাউকি বাজারে এটিএম বুথ থেকে কিছু রুপি তুললাম। এরপর যাত্রা শুরু হয়ে গেল। দেশের সমতল ভূমিকে বিদায় দিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে থাকল গাড়ি। সামনে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা।
বামে ডাউকি নদী। জয়ন্তী এবং খাসি পাহাড়ের মাঝে এই নদী। যদিও নদীর নাম উমগট (Umngot), কিন্তু মানুষের কাছে এই নদী পরিচিত ডাউকি (Dawki) নামেই। নদীর জল খুবই পরিষ্কার।
কিছুদূর যাওয়ার পর ডাউকি ঝুলন্ত ব্রিজ চোখে পড়ল, বাংলাদেশের জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে এই ব্রিজ দেখা যায়। ব্রিজে ছবি তোলা নিষেধ। আমাদের গাড়িচালক কাম গাইড শংকরও সাবধান করে দিল, 'ডোন্ট টেক ফটো'! ডাউকি ব্রিজের ওপর থেকে সোনাংপেডেংয়ের জলাধারের দেখা পেলাম! এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির জলাধার বলা হয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে আমরা মেঘালয়ের যত ভেতরে প্রবেশ করতে থাকি, ততই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলায় মুগ্ধ হতে থাকি। আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি-ইমিগ্রেশনের ভোগান্তি সব উবে যেতে থাকে। চারদিকের দৃশ্য দেখে মনে হয়, যারা দেশ ভাগ করেছে, তারা কী নিপুণভাবেই না বাংলাদেশকে চরম বঞ্চিত করে ভারতের হাতে সব সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান তুলে দিয়েছে! আমাদের সৌভাগ্য, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভাগে পেয়েছিলাম।
রাস্তা দিয়ে চলার পথে ওপারে সিলেটের গ্রামগুলো দেখা যায়। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। ’৪৭ সালের আগেও আমরা ছিলাম এক দেশ। কাঁচি চালিয়ে এই ভূখণ্ডকে টুকরো করা হয়েছে। অভাব এবং দারিদ্র্য যে দেশের ছায়াসঙ্গী, নিঃসঙ্গতা যে দেশের মানুষের জীবনপথের সহযাত্রী, সে দেশের মানচিত্রে কাঁচি চালানো হলে জনসাধারণের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। যখনই একটি ভূখণ্ড ভাগ হয়, তখনই ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবনে ‘এ পার’ এবং ‘ও পার’ এ দুটি শব্দ এক নতুন অর্থ নিয়ে আসে। ‘এ পার’-এর সঙ্গে ‘ও পার’-এর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে ওঠে। যারা সীমান্ত এলাকায় বসবাস করে, তারা জানে এই শব্দ দুটোর শরীরে মানবাত্মার কী মারাত্মক মর্মযন্ত্রণা লেগে আছে!
দীর্ঘকাল একই জায়গায় বসবাস করলে এক ধর্মের মানুষের সঙ্গে আরেক ধর্মের মানুষের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এক ভাষার মানুষের সঙ্গে আরেক ভাষার মানুষের মিলনে গড়ে ওঠে বৈচিত্র্য। এসবই তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে মানচিত্রের ওপর আঁকা একটি দাগের কারণে!
যাই হোক, ব্রিজ পার হওয়ার পর থেকেই ছোট ছোট ঝরনা বা ঝিরি চোখে পড়তে থাকল। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হলো বোরহিল ঝরনা। এটার বাংলাদেশি নাম হলো পানথুমাই ঝরনা। বিছানাকান্দি থেকে এই ঝরনা দেখা যায়। কাছ থেকে না দেখলে এর আসল রূপ বোঝা যাবে না। এই ঝরনার রূপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। নির্জন এই পাহাড়ি রাস্তায় জলের শব্দে এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়।
এবার সোজা চললাম মাউলিনং গ্রামের দিকে। এটা এশিয়ার সব থেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি বাড়িতে আছে চমৎকার ফুলের বাগান। এখানের রাস্তা-বাড়ি-বাগান সবকিছু অনেক পরিষ্কার। প্রতিটি বাড়ির সামনেই সরু রাস্তায় পর্যটকদের জন্য ইটের সিঁড়ি, আর সব জায়গাতেই রাখা আছে বেতের তৈরি ময়লা ফেলার ঝুড়ি। ইচ্ছা করলেও ঝুড়ির বাইরে ময়লা ফেলার উপায় নেই!
সেখান থেকে আমরা গেলাম রিওয়াই ভিলেজ। ততক্ষণে বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে। এখানে Kay Kay Restaurant-এ আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। পরিচ্ছন্ন এ হোটেলটিতে আমরা ডিম, সবজি, রুই মাছ, ডাল আর ভাত খেলাম।
খাবার শেষ করেই গেলাম লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে। এই ব্রিজের কথা অনেক শুনেছি। ছোট্ট পাহাড়ি নদী থাইলং-এর ওপরে এই লিভিং রুট ব্রিজ। প্রাকৃতিকভাবেই গাছের শিকড় জোড়া লাগিয়ে এই ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। এখানে ফাইকাস ইলাস্টিকা নামে বিশেষ প্রজাতির রাবার গাছ আছে। এই গাছ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মূল শেকড় থেকে বের হয়, শাখা-প্রশাখাগুলো মাটির ওপর উঠে আসে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। খাসি আদিবাসীরা ফাইকাস ইলাস্টিকা বৃক্ষের এই বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তৈরি করে এসব জীবন্ত সেতু। নদীর দুই প্রান্তের দুটি গাছের শিকড়কে পরস্পরের দিকে জুড়ে দেওয়া হয়। এই বিশেষ প্রক্রিয়া প্রায় ১৫ বছর ধরে চলতে থাকে। গোটা প্রক্রিয়াটিতে ছোট-বড় নানা জীবন্ত শেকড়ের বন্ধনে একটি আশ্চর্য রকমের সেতু তৈরি হয়।
এই সেতুতে উঠতে এবং সেতুর নিচে স্বচ্ছ জলে পা ভেজাতে কিন্তু অনেক কসরৎ করতে হয়। অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা, আবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা--কাজটা অনেক কষ্টের।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলল চেরাপুঞ্জির দিকে। রাস্তার চারপাশের পাহাড়ঘেরা সবুজ আবহ আর নির্জনতা। ক্রমেই রাস্তা ধোঁয়ার মতো সাদা মেঘে ছেয়ে যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছলাম আমাদের হোটেলে। হোটেলে গিয়ে স্নান সেরে হোটেল লবিতে দাঁড়িয়ে যখন জোছনার প্লাবন দেখলাম, তখন মনে হলো, সত্যি যেন আমরা কোনো রূপকথার জগতে পৌঁছে গেছি!
[আগামীকাল থাকছে দ্বিতীয় পর্ব]
প্রবা/জিকে/এমজে