× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রোমাঞ্চকর মারায়ন তং জাদি

নাকিব নিজাম

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২২ ১৪:২৬ পিএম

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২২ ১৫:০৮ পিএম

রোমাঞ্চকর মারায়ন তং জাদি অভিযানে গিয়েছিল চার বন্ধু। ছবি তুলেছেন ইকরামুজ্জামান

রোমাঞ্চকর মারায়ন তং জাদি অভিযানে গিয়েছিল চার বন্ধু। ছবি তুলেছেন ইকরামুজ্জামান

ছবি : ইকরামুজ্জামান

ছবি : ইকরামুজ্জামান

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৬০ ফুট বা প্রায় ৫০৬ মিটার অথবা প্রায় অর্ধ কিলোমিটার উপরে দাঁড়িয়ে যেকোন অভিজ্ঞতা পাবার আকাঙ্ক্ষা কেবলই রোমাঞ্চকর নয়, বরং খানিকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। পাহাড়প্রেমী যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর মনে প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় সয়ংক্রিয়ভাবে। নতুন নতুন পাহাড়ের চূড়ায় উঠার তীব্র লালসায় নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে এবার আমরা চার কিশোর চলে যাই বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার পাহাড় রাজ্যের সর্ব গহীনে থাকা মারায়ন তং জাদি পাহাড়ে।

প্রেক্ষাপট ১: ঘড়ির কাটায় রাত ৩ টা ছুঁই ছুঁই, তাবুর ভেতর থেকে মাথা বের করতেই হিমশীতল একটা বাতাস প্রাণে স্পন্দন জাগিয়ে চলে গেলো। মাটি থেকে খানিকটা উপরে তাকাতেই চোখে ধরা দিচ্ছে আকাশে হরেক রকম তাঁরায় সুবিন্যস্ত ছায়াপথ। চারদিক রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে তারাগুলোর দিকে তাকালে লাগছে আমি মহাশূন্যে অবস্থান করছি , চারপাশে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার বিন্দুমাত্র আলোর নাম নিশানা নেই। কিছুদূরে গিয়ে একতা পাথরের উপর এক পা উঁচু করে দাঁড়াতেই পায়ের নিচ দিয়ে শীতল একটা কিছু ছুঁয়ে দিয়ে গেল। কেমন যেন একটা প্রবত স্পর্শকাতর অনুভূতি। পায়ের পাতায় হাত দিয়ে বুঝা গেলো একখন্ড মেঘ এসে দারুন একটা অনুভূতি দিয়ে চলে গেল।   

প্রেক্ষাপট ২:  প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে যখন আমরা প্রার্থনা করছি এক পশলা বৃষ্টির জন্য, ঠিক তখনই আমাদের সামনে দেখতে পেলাম বড় আকারের একখন্ড ঘন কালো মেঘের অস্তিত্ব , আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে সূর্যের খাড়া কিরণের প্রখর তাপ । কিছুদূরে হাতের বা পাশে আকাশ থেকে নেমে আসা একরাশি মেঘপুঞ্জ হতে বৃষ্টির প্রবল ধারা বইছে এবং উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস সেই বৃষ্টির ফোটাগুলোকে আমাদের শরীরে এনে লাগাচ্ছে । হাতের ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়বে বিশাল সমুদ্রের রাজকীয়তা । কান পেতে থাকলে শোনা যাবে বঙ্গপোসাগরের গর্জন , যেন প্রবল আওয়াজ তুলে এক্ষুনি আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় । কেবল একটা মাত্র জায়গায় একই সাথে চারদিকের চার রকম প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়াটা একইসাথে দিশেহারা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা সৃষ্টি করে অন্যদিকে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলারও অপেক্ষা রাখে। 

এবার উপরের প্রেক্ষপটদ্বয়কে ভাবা যাক কোনো এক পাহাড়ের চূড়া থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৬০ ফুট বা প্রায় ৫০৬ মিটার অথবা প্রায় অর্ধ কিলোমিটার উপরে দাঁড়িয়ে উক্ত প্রেক্ষাপটদ্বয়ের অভিজ্ঞতা পাবার আকাঙ্ক্ষা কেবলই রোমাঞ্চকর নয় , বরং খানিকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। পাহাড়প্রেমী যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর মনে প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় সয়ংক্রিয়ভাবে। নতুন নতুন পাহাড়ের চূড়ায় উঠার তীব্র লালসায় নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে এবার আমরা চার কিশোর চলে যাই বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার পাহাড় রাজ্যের সর্ব গহীনে থাকা মারায়ন তং জাদি পাহাড়ে যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার এবং এটির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে আমাদের গুনতে হবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পাহড়ি ঢালু রাস্তা, যেখানে কোথায় এক সেকেন্ডের জন্য কোনো রাস্তা নিচে নামেনি। যেখান থেকে ট্রেইল শুরু করতে হবে, ওখান থেকে একদম চূড়া পর্যন্ত পুরোটা খাড়া ৭০ ডিগ্রী উঁচু রাস্তা। সম্পূর্ণ নতুন গন্তব্য যেখানে আমরা আগে কখনও যাইনি এবং তেমন একটা জনমানব ও দেখা যায়না সেখানে। আছে সাপ কিংবা অজানা ভয়ানক রকমের কীতপতঙ্গের আক্রমনের ভয় । মুখোমুখি হতে হবে অজানা বিভিন্ন রকমের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভয়। এত কিছু মাথায় রেখেও মারায়ং তং বিজয়ের কৌতুহল আমাদের চার কিশোরকে আটকে রাখতে পারেনা। লিখছি চারজনের মারায়ন তং পাহাড় স্থানীয়ভাবে মেরাই থং পাহাড় অভিযানের কথা। ঢাকার কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ আর যানজটে অতিষ্ট হয়ে ওঠা অবাক করার মত বিষয় না হলেও এত শত ভীড়ের মাঝে চায়ের দোকানে বসে ফেসবুকে উঁকি মারতে মারতে মারায়ং তং জাদি পাহাড়ের খোঁজ পাওয়া এবং সাথে সাথে দিনক্ষন ঠিক করে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে বের করে ফেলাটা খানিকটা অবাক  করার মত বিষয়। ঠিক করা হলো বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার মারায়ং তং জাদি পাহাড় সামিট করবো আমরা, আশেপাশে বোনাস হিসেবে পেলাম আলী গুহার খোঁজ। প্রথমে আলী গুহা তারপর যাব পাহাড়ে। যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা শুরু হওয়ার ৮ ঘন্টার মাথায় আমরা পৌছে গেলাম আলীকদমে। বাসস্ট্যান্ড থেকে সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হলো অমানসিক পরিশ্রমের একটা অভিযানের জন্যে। আলীকদম যাওয়ার রাস্তাগুলো এতটা আঁকাবাঁকা, ৫০ ডিগ্রী বাঁক থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯০ ডিগ্রী পর্যন্ত বেঁকে গিয়েছে রাস্তা। তবুও এখানে এত বড় একটা বাস চালাতে চালক বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্থ না হওয়ায় অনায়াসেই ধারনা করে নেওয়া যায় তিনি উক্ত রাস্তার পাঁকা খেলোয়ার। 

পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্যের বর্ণনা নাহয় পরেরটুকু পড়েই বুঝা যাক? দুপাশে গিরি খাদ আর আঁকাবাঁকা রাস্তায় যেখানে নিজের সিটে বসতে হলেও সামনের সিটকে ধরে বসতে হয় , সেখানে আমি সৌন্দর্যের মোহে আকৃষ্ট এতটাই হয়ে গিয়েছিলাম কোন জানালা দিয়ে কোন দিকে দেখবো বুঝতে পারছিলাম না। ডানে যেভাবে পাহাড় আকড়ে ধরে আছে একই ভাবে বাঁ পাশেও পাহাড়ের সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই বুঝা যায় এখান থেকে এক চুল পরিমান পিছলে গেলে কারো বাঁচার কোনোপ্রকার উপায় থাকবেনা। একদম হাজারফুট নিচে পড়ে যাবার মরণঝুঁকি মাথায় নিয়ে ড্রাইভার সাহেব নিশ্চিন্তে আমাদের অবাক করে দিয়ে ৫০-৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা স্পীডে নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছেন। 

প্রথমত, আমরা আলীগুহার রাস্তা চিনিনা। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করায় একটা সরু রাস্তা দেখিয়ে দিলেন যেটা চলে গেছে সোজা ৮০ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেল করে নিচের দিকে। দ্বিতীয়ত, আগেরদিন রাতে বৃষ্টি হওয়ায় মাটিগুলো এতটাই পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল, বুট পড়েও গ্রিপ পাওয়া যাচ্ছিলোনা । একপাশে মাটিতে হালকাভাবে শিকড় গেড়ে ওঠা কিছু গাছকে অবলম্বন করে যে নামবো নিচের দিকে তাও সম্ভব হচ্ছিলোনা। ওগুলোতে হাত দেওয়ার সাথে সাথে পুরো গাছটাই উঠা আসছিল শিকড়সহ। হাতের অন্যপাশে খাদ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র উপায় বাকি থাকলো জুতা খুলে , কাধের ব্যাগ মাটিতে গড়িয়ে গিয়ে আমরা নেমে যাব এবং যথারীতি তাই করা হলো। নিচে নেমে দেখা গেলো চিকন একটা বাঁশের সাঁকো পার করতে হবে যেটার দৈর্ঘ্য খুব একটা বেশি না হওয়া স্বত্বেও আমাদের পিচ্ছিল পা দিয়ে পার হওয়াটা একরকম ঝুঁকি হয়ে যাবে। সাঁকো পার করার পর আসলে বুঝতে পারলাম প্রকৃতি আর আল্লাহর সৃষ্টি কি দুর্দান্ত বিষয়। বাইরের প্রচন্ড তাপে যেখানে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, সাঁকো পার করে ঝিরিতে ঢোকার সাথে সাথেই শরীর একদম বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করল। আমরা প্রশান্তি পেতে শুরু করলাম । জানিনা আমাদের সামনে তখনও কি অপেক্ষা করছে, সামনের রাস্তা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে , শুনেছিলাম ঝিরিতে সাপ বাঁ জোকের উপদ্রব খুব বেশি পরিমানে থাকে, এসব আতংককে মুহুর্তেই গায়েব করে দিতে যথেষ্ট ছিল দুপাশে পাথরের পাহাড়ের রাস্তা আর এর ভেতরকার শীতল পরিবেশ। ক্রমশই রাস্তা চিকন হওয়া শুরু করলে আমরা যেখান দিয়ে এসেছি একটা করে চিহ্ন ছুড়ে দিতে থাকি যেন ফেরার সময়ে কোনো অসুবিধা না হয়। রাস্তা একদম সোজা গিয়ে এতটাই চিকন হয়ে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে আমাদের সেখান থেকেই ফিরতে হয়েছে। হাতে সময় না থাকায় এবং গুহায় একজন মানুষের দেখা না পাওয়ায় আমরা ভেতরের দিকে যাইনি। পরবর্তীতে চিহ্নগুলো অবশ্য কাজেও লাগেনি তবে আফসোস হয়েছে বাধা ডিঙিয়ে ভেতরে গেলে হয়ট প্রকৃতি আমাদের আরো অবাক করে দিতো কিংবা আমাদের সাথেই ঘটে যেতে পারতো বড় রকম কোনো দূর্ঘটনা। 

এবারের গন্তব্য মারায়ন তং জাদি। স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের একটি তীর্থস্থান ও বলা যায় পাহাড়ের চূড়াটিকে। চূড়ায় দুটো বৌদ্ধ মন্দির আছে যার দেখাশোনা করেন সেখানকারই একজন স্থানীয় কেয়ারটেকার যাকে ‘মন্ত্রী’ বলা হয়। তাঁর ভাষ্যমতে তিনি এই জায়গাটাকে পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে রেখেছেন তা না হলে এটা জঙ্গলে পরিনত হয়ে যেত। উপরে নেই প্রাকৃতিক কাজ সারবার কোনো শহুরে ব্যবস্থা, নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি কিংবা রান্না অথবা থাকার কোনো সুব্যবস্থা। এসব কিছুর মানসিকতা নিয়েই আমাদেরকে চূড়ায় আরোহন করতে হবে। আবাসিক বাজার থেকে রাতে খাবারের জন্য শুকনো কিছু খাবার , চার জনের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমান পানি কিনার পরে জানা গেল পাহাড়ের চূড়ায় রাতে অসহনীয় ঠান্ডা পরে। আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা হিসেবে কাঠ এবং কেরোসিন কিনে নিয়ে আমরা চূড়ায় উঠা শুরু করলাম। ইট বিছানো খুব সুন্দর রাস্তা দেখে ভাবা যেতেই পারে উঠতে তেমন কষ্ট হবেনা যা সম্পুর্ণ ভুল এবং আমাদের অনেকতা ভুগিয়েছে। আমাদেরকে পারি দিতে হবে এমন প্রায় পাঁচ কিলমিতারের মত পথ। ১ কিলোমিটার  উঠতেই আমাদের অবস্থা এতটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো যে নিস্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। 

দেড় কেজির ব্যাগটাকেও কাধে নিতে মনে হচ্ছিলো দেড় টনের বোঝা উঠাচ্ছি। অবশেষে দেখা মিললো মুরং পাড়ার কতগুলো বালকের যারা জানালো ওরা পর্যটকদের ব্যাগ চূড়া পর্যন্ত নিয়ে যায়। মারায়ন তং এ উঠতে উঠতে পথিমধ্যে কয়েকবার থামতে হয়েছে আমাদের। কখনও ছবি তোলার জন্যে, কখনও পেছনে ফিরে উপর থেকে নিচের এবং আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। যত উপরে উঠছিলাম মনে হচ্ছিলো চারপাশ আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠছে। সৌন্দর্যের মোহে আমরা থেমে থেমে উঠে গেছি প্রায় ২ কিলোমিটার। অন্তত হাতে পড়া রিস্টব্যাণ্ড এটাই ঘোষনা দিচ্ছিলো। ভর দুপুরে রোদের মাঝে ছায়ার সাথে অবিরাম পা মিলিয়ে চলতে থাকা চার কিশোরের অবস্থা তখন ভয়ানক খারাপ। সাথে নিয়ে আসা ৪ লিটার পানি এবং ১০টা স্যালাইনেই মধ্যে ৮টা প্রায় শেষের দিকে। উপরে উঠে কিভাবে পানি খাবো সে চিন্তা তখন কারো মাথায় নেই। চূড়ায় উঠতে আমাদের গুনতে হবে সর্বমোট ৬ টি উঁচু ট্রেইল যার মধ্যে সবচেয়ে খাড়া ট্রেইলটা ৭২ ডিগ্রী কোনে ভূমি থেকে চূড়ায় দিকে চলে গিয়েছে। এই খাড়া পথ বেয়ে উঠতে উঠতে আমাদের চক্ষুচড়কগাছ। ক্রমেই সকলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম, উঠতে পারব কি পারবোনা, নেমে আসবো কিভাবে, আরো ৪ টা খাড়া ট্রেইল পারি দিতে হবে ভেবেই আমাদের অবস্থা করুন হয়ে যাচ্ছিলো। যখনই ৩০০ মিটারের এই ট্রেইলটা শেষ করলাম বালকরা আমাদের বললো, “ভাই আপনাদের বোতলগুলা  দেন পানি ভইরা আনি” তাদের জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম পাশেই আছে একটা ঝর্ণার সামান্য একটা ঝিড়িপথ যেখান থেকে পানি নিয়ে পাহাড়ের আদিবাসীরা বাস করে। 

আমাদের নাকাল অবস্থায় সামান্য পানির খোঁজ পাওয়াটা যেন আমাদের কাছে অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। অপেক্ষা না করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে চলে গেলাম ঝর্ণার কাছে। ঝর্ণায় গিয়ে হাত মুখ ধুঁয়েই ভিজিয়ে দিলাম শরীরকে। প্রখর তাপের মধ্যে ঝিড়ি বেয়ে আসা পানি টুকু যে এতটা প্রশান্তি দিবে ভাবতেও পারছিলাম না। সেখানে প্রায় আধা ঘন্টা বিরতি নেওয়ার পর সবাইকে মোটামুটি খুইয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে ফিলাম। এবার বেশ ভালো লাগছে সবার শরীর। পায়ের পেশীতে টান লাগলেও মনে হচ্ছে উঠতে পারবো। এই ঝিড়ির পানি টা আমাদের পরবর্তী পথ পারি দিতে অনেক বেশি সাহায্য করেছে।  

পরবর্তী ২টা ট্রেইল উঠতে বেশ খাটাখাটনি গেলেও আমরা বেশ উৎসাহের সাথেই শেষ করলাম। উপরে উঠে কিছুটা সমতল পেয়ে প্রাচীন অশ্বুথ গাছের নিচে খানিকটা বিশ্রাম নিতে নিতে উপলব্ধি হলো বাংলাদেশ কতটা সুন্দর এবং সৃষ্টিকর্তা কত সুনিপুণভাবে এসব তৈরি করেছে। এই ট্রেইলেও পরেই মারায়ং তং এর চূড়া একদম স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তখনও প্রায় ৮০০ মিটারের মত পথ বাকি। এখানেই থমকে দাঁড়াতে হলো আমাদেরকে। সামনে থেকে বড় বড় ঘন কালো মেঘের হুংকার দেখে আমরা ক্রমশই বিচলিত হয়ে পড়তে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাগুলোতেই বৃষ্টি বাগড়া দিবেনা তো? সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুট করেই বাঁ পাশে শুরু হয়ে গেলো মুশল ধারে বৃষ্টি এবং উত্তর থেকে বয়ে যাওয়া বাতাসে বৃষ্টির ফোটাগুলো আমাদের গায়ে ছিটে আসতে থাকলো। তখনও আমরা যেখানে  দাঁড়িয়ে আছি এখানে প্রচন্ড উত্তাপের রোদ। আরো কিছুদূর আগাতেই বড় বড় বৃষ্টির ফোটা আমাদের গায়ে এমনভাবে আঘাত করতে থাকলো যেন মনে হচ্ছিল শীলাবৃষ্টি হচ্ছে এবং শীলগুলো পিঠে কাঁটার মত এসে বিঁধছে। ক্যামেরা মোবাইল এসব পলিথিনে পেঁচিয়ে আমরা চলা শুরু করলাম কোনো বিরতি ছাড়া। বর্জ্রপাতের মুখে আমাদের সকল ভয় হারিয়ে যেতে থাকলো । চারিদিকে এতটাই অন্ধকার হয়ে গিয়েছে তখন, মনে হচ্ছিলো রাত নেমে এসেছে এবং বড় কোনো ঘূর্ণিঝপড় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে , আমরা এক্ষনি মারা যাব হয়ত। বৃষ্টির মধ্যেই মারায়ন তং জাদির চূড়ায় উঠে গেলাম আমরা। ব্যাগ, তাবু সবকিছু ততক্ষনে ভিজে গিয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের টিনের চাল ছাড়া তখন বৃষ্টি থেকে বাঁচার কোনো উপায় ছিলোনা। অতবড় একতা পাহাড়ের চূড়ায় কেবল ৪ জন কিশোরের একা হয়ে যাওয়াটা অনেকটা দু;সাহসিক দেখাচ্ছিল। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন আমরাই চূড়ায় সর্বপ্রথম উঠেছিলাম। 

ঘন্টাখানেরক পর বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হতেই দেরী না করে আমরা তাবু লাগানোর কাজ শুরু করে দিলাম। ততক্ষনে ১২ জনের আরেকটা টিম চূড়ায় উঠে এসেছে। তাদেরকে দেখে কিছুটা সাহস পেলা। এরপর সন্ধ্যার আগমুহুর্তে  ৯ জনের আরো একটা দল চূড়ায় সামিট করলো। তাদেরও পড়তে হয়েছিল বৃষ্টির কবলে। বিকেলবেলা সূর্য যখন পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে যাচ্ছিলো, প্রকৃতির অনন্য একটা রূপের দেখা পেলাম আমরা। মনে হচ্ছিলো পাহাড়া নিজের ছায়াতলে খুব সযত্নে আলতো করে সূর্যটাকে লুকিয়ে রেখে দিচ্ছে। বিকেলের স্নিগ্ধ আলো আর সন্ধ্যার রক্তিম আকাশের মিষ্টি একটা পরিবেশ পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সবাইকে গভীরভাবে আলীঙ্গন করে নিচ্ছে। চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে আর চূড়ায় থাকা আমরা সবকিছুকে খুব গভীরভাবে অনুভব করছি , খুব কাছ থেকে প্রকৃতির হিংস্র রূপ দেখে আসা আমরাই আবার প্রকৃতির করুণাময় দৃশ্যগুলো উপভোগ করছি। আবছা আলোতে যখন অন্ধকার হবে হবে ভাব, পাহাড়ের চারপাশে তখন মেঘেরা বাসা বাঁধতে শুরু করলো। তুলার মত নরম মেঘগুলোর রূপ এতটাই সুন্দরভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছে, আমরা ক্রমশই হারিয়ে যেতে থাকলাম। ততখনে ছবি তোলার ইচ্ছে কারোই নেই। শুধুমাত্র উপভোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো চারপাশটাকে, থমথমে পরিবেশটাকে। 

অন্ধকার যখন নেমে আসলো , রাতের আকাশে সুবিন্যস্ত তারকারাজির ছায়াপথের অমায়িক একটা দৃশ্য ক্রমশই আমাদের ভুলিয়ে দিতে থাকলো দিনের বেলার সকল পরিশ্রম , সকল ভয়াবহতা , সকল প্রকার ক্লান্তি – গ্লানি কে। তাবুর ছাদ খুলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা জিনিসই বারবার চাইছিলাম, সকাল যেন না হয়। এই মধুর পরিবেশ, এই প্রকৃতি ছেড়ে যাবার ইচ্ছা আমাদের কারো করছিলোনা। তারাগুলো বারবার ভুলিয়ে দিচ্ছিলো পাহাড়ের সকল নিষ্ঠুরতাকে। শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সকল অত্যাচারকে। পায়ের নিচে মেঘগুলো যখন ছুয়ে দিচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো সৃষ্টিকর্তা তুমি ভীষন অপরূপ। এই অনুভূতিগুলোর কোনো তুলনা হতে পারেনা। 

পরদিন সকালে বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখন চারজন একসাথে ছবি তুললাম, সত্যি মনে হচ্ছিল আমাদের কষ্ট স্বার্থক। আমরা সফল। চূরায় দাঁড়িয়ে নিজের দেশের পতাকা উড়ানোর অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার মত না। বাংলাদেশ এতটা সুন্দর একমাত্র পাহাড়ের চূড়া থেকেই পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায়। এমন সব মধুর অভিজ্ঞতার কারনেই বারবার পাহাড় আমাদেরকে টানে, হয়ত অন্য কোনোদিন চলে যাব অন্য পাহাড়ে। আবার বাংলাদেশের পতাকা উড়াবো সগর্বে, বুক ফুলিয়ে । এরকম শ’ খানেক মধুর স্মৃতি নিয়ে পর দিন সকালে সূর্যোদয় দেখেই নেমে এলাম আমরা সমতল ভূমিতে, আমাদের জায়গায়। অবশ্য এই মধুর স্মৃতিগুলো কুড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমাদেরকে। আগেরদিনের বৃষ্টি ইট বিছানো রাস্তাগুলোকে প্রচুর পিচ্ছিল করে দেওয়ার নামতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমাদের। একমাত্র বুট ছিল সুস্থভাবে নেমে আসার একমাত্র অবলম্ববন। নামতে নামতে চিন্তা করেছি উঠেছিলাম কিভাবে, এই পথ যেন খুব বেশি কঠিন। এই পথে উঠা যেন জীবনকে বাজি ধরে উঠা। অত:পর একটি সফল অভিযানের মাধমে শেষ হলো আমাদের মারায়ন তং জাদির অভিযান। পাহাড়ে গেলে বুঝা যায় ছোটবেলায় পড়া ভাবসম্প্রসারনের মর্ম, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। পাহাড় দূর থেকে অনেক সুন্দর, কাছ থেকে কয়েকগুন বেশি ভয়ঙ্কর সুন্দর। 

প্রবা/জিকে 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা