সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৩৮ এএম
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৩ পিএম
ডোর টু ডোর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চিত্র। ফটো সংগৃহীত
বুধবার। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১০টা ৩০ মিনিটের দাগে। সাভার উপজেলা তথ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এসেছেন ষাটোর্ধ্ব ডলি পারভিন। ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করালেন তিনি।
ডলি বলেন, ‘ফার্মেসিতে গিয়ে এসব পরীক্ষা করাতে বেশ টাকা লাগে। আমি গরিব মানুষ। নিয়মিত এত টাকা কই পাব। তাই তথ্যকেন্দ্রে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই।’ এখানকার কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক বলে তিনি জানান।
তার কিছুক্ষণ পর আসেন উপজেলার ব্যাংক কলোনি এলাকার শান্তা খাতুন নামে এক তরুণী। তিনি এসেছেন টেইলারিং প্রশিক্ষণের খোঁজ নিতে।
শান্তা বলেন, তিনি আগে তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে আবেদন করে পার্লারের কাজের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন টেইলারিংয়ে প্রশিক্ষণ নিতে চান। তাই আবেদন করতে এসছেন তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের রাজনগরে গিয়েও দেখা মিলেছে একই চিত্রের। সেখানে কথা হয় নাসরিন আক্তার নামের এক ষাটোর্ধ্ব নারীর সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন তার স্বামী। তখন নাসরিনের চোখে নেমে আসে অন্ধকার। এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন উপজেলা তথ্যকেন্দ্রে ‘তথ্য আপার’ মাধ্যমে ভিডব্লিউবি (দুস্থ মহিলা উন্নয়ন) কার্ডের আবেদন করা যায়।
নাসরিন বলেন, ‘তথ্য আপা আন্তরিকভাবে আমার ভিডব্লিউবি কার্ডের আবেদন করে দেন। আমি বয়স্কভাতা পেয়ে এখন মোটামুটি স্বচ্ছন্দে আছি।’
শুধু সাভার ও রাজনগর নয়, সারা দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদের তথ্যকেন্দ্রে গেলেই প্রতিদিন দেখা মেলে এই চিত্রের। প্রান্তিক অঞ্চলের সুবাধিবঞ্চিত নারীরা বিভিন্ন সেবা নিতে হাজির হন। তাদের সেবা দিতে দিনভর ব্যস্ত সময় পার করেন তথ্য আপারা।
চলমান এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছর জুনে। মেয়াদ ঘনিয়ে আসায় সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে হাতাশা।
তারা বলছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারীরা নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন। তাদের কথা বিবেচনা করে যেন প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
তথ্য আপা প্রকল্প সভারের কর্মকর্তা সাবিহা কাওসার বলেন, ‘আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে সাধারণ মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক নানা সেবা সম্পর্কে অবগত করে থাকি। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অসহায় নারীরাও আসেন আমাদের কাছে চাকরি, প্রশিক্ষণ, ভিডিজি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা ও পরামর্শ নিতে।’
প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) এসএম নাজিমুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, গত সাড়ে চার বছরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ তথ্যকেন্দ্র থেকে সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই একাধিক সেবা নিয়েছেন।
এ ছাড়া সারা দেশে ৩১ হাজার ৫৬০টি উঠান বৈঠক করে ১৪ লাখ ১৬ হাজার নারীকে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন সেবা সম্পর্কে জানানো হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) কেয়া খান বলেন, এটি একটি ইউনিক প্রকল্প। পিছিয়ে পড়া নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া। লক্ষ্য ছিল এক কোটি নারীকে সেবার আওতায় নিয়ে আসার। প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই লক্ষ্য পূরণ করেছেন তারা।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রকল্পের যে প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল, মেয়াদ শেষের পরও এখান থেকে কিছু টাকা বেঁচে যাবে। সেই টাকা দিয়ে আরও বছর দেড়ের প্রকল্পটি চলমান রাখা সম্ভব। এটি যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প, তাই মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে তিনি আশা করেন।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমি মোটেও প্রকল্পের পক্ষে নই। প্রকল্পের মেয়াদ এমন সময় শেষ হয়েছে যখন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। আবার লক্ষ্য অর্জিত হলেও পরে থাকে না। তাই সব প্রকল্পই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে নেওয়া উচিত।
গ্রামীণ, পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে ২০১১ সালের জুলাই মাসে সীমিত পরিসরে যাত্রা শুরু ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটির। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দৈনন্দিন সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা।
২০১৫ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের ১৩টি উপজেলায় স্থাপন করা হয় তথ্যকেন্দ্র। ২০১৭ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ৫৮৫ কোটি ৭৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়, যার মেয়াদ চলতি বছর জুন পর্যন্ত। এর মাধ্যমে দেশের ৪৯২টি উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় তথ্যকেন্দ্র।
প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও দুজন তথ্যসেবা সহকারী রয়েছেন। তারাই প্রকল্প এলাকায় ‘তথ্য আপা’ নামে পরিচিত।
তথ্য আপারা তথ্যকেন্দ্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, উপজেলার সরকারি সেবাসমূহের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, ভিডিও কনফারেন্স, ই-লার্নিং, ই-কমার্স ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের সহায়তা করে থাকেন।
এ ছাড়া তথ্য আপারা ল্যাপটপ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, ব্যবসা, জেন্ডার ও কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্যসেবা দেন। তা ছাড়া জেন্ডার ও কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন এবং স্কাইপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে সেবাগ্রহীতার কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার দ্রুত ও কার্যকর সমাধান করে থাকেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, তথ্যকেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা, ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ, ডায়াবেটিস পরীক্ষা, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ পরীক্ষা ও শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা যায়।