সাইবার নিরাপত্তা
মুহিন তপু
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১৬:৪৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল রূপান্তরের পথে। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন কেনাকাটা, ডিজিটাল শিক্ষা, ই-গভর্নেন্স থেকে শুরু করে প্রতিদিনকার যোগাযোগ- সবকিছুই এখন ইন্টারনেট নির্ভর। এক সময় যেসব কাজের জন্য দীর্ঘ লাইন বা অফিসে যাওয়া লাগত, তা এখন কয়েকটি ক্লিকেই সম্ভব। কিন্তু এই সুযোগ ও গতির পাশাপাশি জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ধরনের ঝুঁকি- সাইবার অপরাধ।
অনলাইন প্রতারণা, পরিচয় চুরি, অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, ভুয়া ওয়েবসাইটে অর্থ লেনদেন, সামাজিক মাধ্যমে প্রতারণা- এগুলো এখন আর শুধু প্রযুক্তিবিদদের মাথাব্যথা নয়, বরং সাধারণ নাগরিকের প্রতিদিনকার উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তি থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি সেবা ব্যবস্থাও এখন সাইবার হুমকির মুখোমুখি।
বাংলাদেশে প্রতিদিন বেড়েই চলেছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, ফেসবুক ক্লোনিং, এনআইডি চুরি, স্পাইওয়্যার অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা। অথচ এ বিষয়ে জনসচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল।
এই বাস্তবতায় জরুরি হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা, কার্যকর ব্যবস্থা ও আইনি কাঠামো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি। এই ফিচারে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশে সাইবার ঝুঁকির বাস্তবতা, প্রতারণার ধরন, করণীয় প্রতিকার এবং সুরক্ষার পথ।
বাংলাদেশের সাইবার পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল সেবা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই সুবিধার পেছনে যেমন রয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, তেমনি রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। প্রতিদিন অনলাইনে প্রতারণার নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কখনও ফোন কলের মাধ্যমে, কখনোবা লিংকে ক্লিক করিয়ে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে নেওয়া হচ্ছে।
ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাইবার ঝুঁকি
বর্তমানে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাইবার ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে একজন ব্যবহারকারীর অসতর্কতা বা সচেতনতার অভাব অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন, ফিশিং আক্রমণের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মোবাইলে বা ইমেইলে একটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়া বার্তা পাঠানো হয়, যাতে লিংকে ক্লিক করলে তার ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসওয়ার্ড, এনআইডি নম্বর ইত্যাদি চুরি হয়ে যেতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাকিং বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে প্রতারকরা ব্যবহারকারীর পরিচিতদের কাছ থেকে অর্থ চেয়ে বসে। অনেক সময় আবার এসব অ্যাকাউন্ট থেকে আপত্তিকর কনটেন্ট পোস্ট করে সম্মানহানিও ঘটানো হয়।
পরিচয় চুরি বা আইডেন্টিটি থেফটও এখন আর বিরল নয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক তথ্য, বা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ভুয়া সিম রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক ট্রানজ্যাকশন কিংবা ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। এ ছাড়া ভুয়া লটারি, পুরস্কার জয়ের নামে এসএমএস বা কলের মাধ্যমে প্রতারকরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি। বিশেষ করে ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিংবা যেকোনো ডেটা-নির্ভর প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের র্যানসমওয়্যার আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ ধরনের আক্রমণে প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য লক করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অনেক সময় এসব তথ্য চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় বা ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেওয়া হয়।
আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো ডেটা চুরি। গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে তা বিক্রি করে দেওয়া হয় বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ওয়েবসাইট হ্যাকিং কিংবা DDoS (Distributed Denial of Service) আক্রমণের মাধ্যমে কোনো ওয়েবসাইটকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক ও সেবাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়াও ইমেইল স্ক্যাম, ইনসাইডার থ্রেট, সফটওয়্যারে ম্যালওয়্যার ইনজেকশন, অননুমোদিত লগইন বা ব্রুট ফোর্স অ্যাটাকের মতো বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিভিত্তিক হুমকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাইবার প্রতারণা প্রতিরোধে করণীয় ও সুরক্ষা পদ্ধতি
ব্যক্তি পর্যায়ে করণীয়-
জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন : জন্মতারিখ বা ১২৩৪৫৬ ধরনের পাসওয়ার্ড নয়। অক্ষর, সংখ্যা ও চিহ্ন যুক্ত করে জটিল পাসওয়ার্ড দিন।
টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন চালু রাখুন : গুগল, ফেসবুক, ব্যাংক অ্যাপ ইত্যাদিতে ২এফএ চালু থাকলে এক্সট্রা নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
সন্দেহজনক লিংক ও কল এড়িয়ে চলুন : কোনো অচেনা লিংকে ক্লিক করবেন না বা ফোনে ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না।
অ্যান্টিভাইরাস ও নিয়মিত আপডেট : আপনার মোবাইল ও কম্পিউটারে অ্যান্টিভাইরাস ও সফটওয়্যার আপডেট করুন।
ভিপিএন ব্যবহার করুন : পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় ভিপিএন ব্যবহার করলে নিরাপত্তা বাড়ে।
ব্যাংক বা এনআইডি তথ্য শেয়ার নয় : ফোনে বা ফেসবুকে কারও সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ওটিপি শেয়ার করবেন না।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে করণীয়
সাইবার নিরাপত্তা অডিট : প্রতিষ্ঠানের আইটি অবকাঠামোর দুর্বলতা নিয়মিত চিহ্নিত করুন।
সাইবার সচেতনতা প্রশিক্ষণ : কর্মীদের সাইবার সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দিন।
ইনসিডেন্ট রেসপন্স প্ল্যান : হ্যাকিং বা আক্রমণের পর কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তার প্রস্তুতি রাখুন।
ব্যাকআপ ব্যবস্থা : গুরুত্বপূর্ণ ডেটা নিয়মিত ব্যাকআপ নিন।
লগ মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ : কে কখন কী করছে, তার ট্র্যাকিং রাখুন।
এ ছাড়াও
• সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ছবি ও তথ্য পাবলিক না রেখে বন্ধুর জন্য সীমাবদ্ধ করুন।
• স্মার্টফোনে অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকুন।
• অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোথাও ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না।
আইনি সহায়তা
অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক মানুষই সাইবার অপরাধের শিকার হলেও আইনি পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেন। কিন্তু যদি আপনি ফিশিং, হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইলিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানি বা অনলাইন অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধের শিকার হন, তবে দ্রুত আইনি সহায়তা নেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। নারীরা ‘ডিএমপি’র ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ ইউনিটে অভিযোগ জানাতে পারেন হটলাইনে (০১৩২০০০০৮৮৮) যোগাযোগ করে। জরুরি সাহায্যর জন্য ৯৯৯-এ ফোন করুন। পাশাপাশি, ‘BD Police Helpline’ এ অভিযোগ জানানো যায়। যত দ্রুত অভিযোগ জানানো যায়, পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট তত দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে এবং অপরাধীদের শনাক্ত ও আটক করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সচেতনতাই কার্যকর প্রতিরোধ
সাইবার অপরাধীরা সাধারণত ব্যবহারকারীর অসচেতনতার সুযোগ নেয়। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের মানুষকেও সচেতন করতে হবে।
শেষের আগে
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাইবার নিরাপত্তা একটি অত্যাবশ্যক বিষয়। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ, আইন বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা নিশ্চিত করতে পারলেই অনলাইন প্রতারণা রোধ করে একটি নিরাপদ ডিজিটাল সমাজ গঠন করা সম্ভব।