চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট
মুহিন তপু
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১৬:৫৪ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বর্তমান যুগকে বলা হয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। এই বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এআইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রয়োগ হচ্ছে চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট । এই প্রযুক্তিগুলো আজ শুধু বড় প্রযুক্তি কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা, স্থানীয় দোকান ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জায়গা করে নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যেভাবে ডিজিটালাইজেশন বাড়ছে, বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এই প্রযুক্তি হয়ে উঠছে অন্যতম সহযোগী।
চ্যাটবট
চ্যাটবট হচ্ছে একটি সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে পারে। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের মতো করে প্রশ্নের উত্তর দেয়, সমস্যা সমাধান করে এবং তথ্য দেয়। চ্যাটবট সাধারণত ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ অথবা সামাজিক মাধ্যমে (যেমন ফেসবুক মেসেঞ্জার) সংযুক্ত থাকে।
চ্যাটবট প্রযুক্তির সুবিধা ও ব্যবহার
২৪/৭ গ্রাহকসেবা: চ্যাটবট অটোমেটেড হওয়ায় দিনের যেকোনো সময়Ñ ভোর ৫টা হোক বা রাত ১২টা, গ্রাহকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এতে করে ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে ও গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত হয়।
বিক্রয় ও রেভিনিউ বৃদ্ধি: চ্যাটবট বিভিন্ন প্রোডাক্ট সাজেস্ট করতে পারে, ডিসকাউন্ট জানাতে পারে এবং অর্ডার প্লেস করতে সাহায্য করে। একজন ক্রেতা যদি দ্বিধায় থাকেন, চ্যাটবটের সাজেশন তাকে কিনতে উৎসাহিত করতে পারে।
ভুল কমানো ও নির্ভরযোগ্যতা: মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু চ্যাটবট নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কাজ করে। ফলে প্রতিটি গ্রাহকই একই মানের পরিষেবা পান। এতে ব্যবসায় বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি গ্রাহকদের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে।
একসঙ্গে অসংখ্য ক্লায়েন্ট পরিচালনা: একজন মানুষ একসঙ্গে হয়তো ৪-৫ জনকে সার্ভ করতে পারেন। কিন্তু একটি চ্যাটবট একসঙ্গে হাজারো মানুষকে ইনবক্সে সেবা দিতে পারে, কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।
অর্ডার নেওয়া ও প্রক্রিয়াজাতকরণ: ক্রেতা প্রোডাক্ট পছন্দ করলে, চ্যাটবট তার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সংগ্রহ করে অর্ডার সাবমিট করতে পারে। ব্যবসায়িক কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।
গ্রাহক ফলোআপ ও মার্কেটিং: অর্ডার কনফার্ম হওয়ার পর ফলোআপ মেসেজ পাঠানো, নতুন অফার জানানো বা কার্ট অ্যাবন্ডন রিমাইন্ডার দেওয়া যায়। এটি পুনরায় বিক্রির সুযোগ বাড়ায়।
ডেটা বিশ্লেষণ ও রিপোর্ট: চ্যাটবট প্রতিটি বার্তা, প্রশ্ন ও ক্লিক ট্র্যাক করে রাখে। এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে গ্রাহকের পছন্দ-অপছন্দ বুঝে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন কমায়: একটি ছোট ব্যবসায় ইনবক্স ম্যানেজ করতে আলাদা লোক নিয়োগের প্রয়োজন হয় না। এতে খরচ ও সময় দুই-ই বাঁচে।
বহু প্লাটফর্মে কাজ করে: চ্যাটবট শুধু ওয়েবসাইটে নয়, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এমনকি ইমেইলেও যুক্ত করা যায়। ফলে ব্যবসার উপস্থিতি বাড়ে।
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট এমন এক প্রযুক্তি, যা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে নির্দেশনা বুঝে কাজ করে। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যামাজনের অ্যালেক্সা বা অ্যাপলের সিরি হলো ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তির জনপ্রিয় উদাহরণ। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবহারকারী টেক্সট টাইপ না করেই শুধু মুখে বলেই বিভিন্ন কাজ করতে পারে, যেমন কল দেওয়া, সময় জানা, রিমাইন্ডার সেট করা, পণ্য খোঁজা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে এখনও বাংলা ভাষার ভয়েস রিকগনিশন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে উন্নয়ন চলছে। বর্তমানে কিছু স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ভাষা ও উচ্চারণে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্নয়নের কাজ করছে।
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তির সুবিধা ও ব্যবহার
স্মার্টওয়ার্ক: রান্না করতে করতে, গাড়ি চালাতে চালাতে বা বাজারে কাজ করতে করেও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে তথ্য খোঁজা বা কাজ করা যায়। এতে সময় ও শ্রম দুই-ই বাঁচে।
সবার জন্য ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট: যাদের টাইপিং বা ইংরেজি জানা নেই, তারাও নিজ ভাষায় কথা বলেই প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন, এটি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করে।
দ্রুত ও কার্যকর তথ্য প্রদান: ভয়েস দিয়ে ‘আজকের আবহাওয়া কেমন?’, ‘আজকের ডলার রেট কত?’ ইত্যাদি প্রশ্ন করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাওয়া যায়।
বিজনেস রিমাইন্ডার ও ক্যালেন্ডার: ব্যবসায়ী ‘আগামীকাল ১১টায় মিটিং আছে মনে করিয়ে দিও’ বললেই অ্যাসিস্ট্যান্ট তা মনে রাখবে এবং ঠিক সময়ে রিমাইন্ডার দেবে।
পণ্য খোঁজা ও অনলাইন অর্ডার: গ্রাহক চাইলে বলতে পারে ‘এক জোড়া কেডস অর্ডার করো’, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়েবসাইট ঘেঁটে প্রোডাক্ট সাজেস্ট করতে পারে।
স্থানীয় ভাষায় ব্যবহারের সুযোগ (ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা): যদি ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট বাংলায় দক্ষ হয়, তাহলে বাংলাদেশের কোটি ব্যবহারকারী সরাসরি উপকৃত হবেন, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়ক: ভিজ্যুয়াল স্ক্রিন না দেখেই ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে মোবাইল বা কম্পিউটার চালানো সম্ভব, দৃষ্টিহীনদের জন্য এটি সুফল বয়ে আনছে।
স্মার্ট হোম ও অফিস ব্যবস্থাপনা: ভয়েস দিয়ে লাইট অন/অফ, এসি চালু, সিসিটিভি দেখতে পারাÑ সবই সম্ভব। অফিসে ভয়েস কমান্ডে প্রেজেন্টেশন চালানোও সম্ভব।
ফাইল খোঁজা ও চালানো: কম্পিউটারে সংরক্ষিত ফাইলের নাম বলে বললেই তা ওপেন করা যায়। এটি প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়।
ব্যবসায়িক ইনসাইট জানার উপায়: ভবিষ্যতে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলা যাবে, ‘গত সপ্তাহের সবচেয়ে বিক্রীত পণ্য কী?’, এবং সেটি রিপোর্ট আকারে জানাবে। এভাবে ব্যবসার সামগ্রিক ইনসাইট ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অগ্রগতি
বাংলাদেশে চ্যাটবট প্রযুক্তি ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সফলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ই-কমার্স সাইটগুলো ইনবক্স বট ব্যবহার করে অর্ডার নিচ্ছে, কাস্টমার সার্ভিস দিচ্ছে। মাইএলাইচ, যান্ত্রিক, টগুমগুর মতো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যাটবট ও অটোমেশন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গ্রাহকসেবা সহজ করেছে।
বাংলা ভাষায় ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরির কাজ করছে কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগ এবং বেসরকারি কিছু স্টার্টআপ। গুগল ইতোমধ্যে কিছু বাংলা ভয়েস কমান্ড যুক্ত করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত সেবা আসার প্রত্যাশা রয়েছে।
প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি, বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ সাপোর্ট না থাকা, গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্ট ডিভাইসের অভাব ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতে যৌথভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, বাংলা ভাষাভিত্তিক অ্যাপ উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ টুলস তৈরির মাধ্যমে এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের জন্য আরও সহজলভ্য করা সম্ভব।
বাংলাদেশে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বর্তমানে ফেসবুক বা ছোট ওয়েবসাইটভিত্তিক ব্যবসা চালাচ্ছেন। তাদের পক্ষে সার্বক্ষণিক ইনবক্স দেখা বা কাস্টমার সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তি এই সমস্যা দূর করতে পারে।
শেষের আগে
চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তি এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য কার্যকর ও লাভজনক একটি সমাধান। এর যথাযথ ব্যবহার উদ্যোক্তাদের সময়, শ্রম ও অর্থ বাঁচাতে সাহায্য করছে, বাড়ছে উৎপাদনশীলতা এবং উন্নত করছে গ্রাহকসেবা।