× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বজ্রপাতে জীবন বাঁচাবে প্রযুক্তি

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫ ১০:৩৭ এএম

আপডেট : ০১ জুন ২০২৫ ১১:৫৪ এএম

বজ্রপাতে জীবন বাঁচাবে প্রযুক্তি

প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার মধ্যে বজ্রপাতে মারা যায় সবচেয়ে বেশি। বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষ প্রাণ হারায়। যাদের বড় অংশই কৃষক-শ্রমিক। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। তবে এ খাতে শনাক্তকরণকে (ডিটেকশন) অধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও সুরক্ষায় (প্রটেকশন) নেই বাড়তি নজর। ফলে বিশেষজ্ঞরা শনাক্তকরণের সঙ্গে সুরক্ষাকেও প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 

দুর্যোগ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশের ১৫টি জেলায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ অন্যতম। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান গবেষণা করছেন বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে। তিনি এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘হাওর অঞ্চলের নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে) বেশি বজ্রপাত হয়। বর্ষা মৌসুমে (জুন-জুলাই-আগস্ট) বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে বর্ষা মৌসুমের পর (অক্টোবর-নভেম্বর) বেশি বজ্রপাত হয়। এমনকি সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালীতে শীতকালেও বজ্রপাত হয়।

বজ্রপাত নিয়ে পিএইচডি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ফারুখ। তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক কারণে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হয়। হাওরের প্রধান ফসল বোরো ধান। বোরো ধানে প্রচুর পরিমাণ সেচ দিতে হয়। সেচের পানি থেকে মিথেন ছড়িয়ে পড়ে। এই পানিতে তাপমাত্রাও বেশি থাকে। মিথেন বাতাসে মিশে গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করে। সে তাপ শোষণ করে। তাপ শোষণ করলে তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রা বাড়লে মেঘ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর মেঘে বজ্রপাত হয়।’

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আবহাওয়া অধিদপ্তর বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের আওতায় সরকার প্রধানত শনাক্তকরণ ও সচেতনতামূলক কাজ করছে। তাতে সুরক্ষামূলক কাজের ঘাটতি প্রকট দেখা যাচ্ছে। 

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা বিটিআরসি, বিএমডি ও এলজিআরডির সঙ্গে মিলে সচেতনতামূলক কাজের অংশ হিসেবে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় মোবাইলে এসএমএস প্রেরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালিয়ে থাকি। এর সঙ্গে আমরা বজ্রপাত নিরোধক স্থাপনাও তৈরি করছি। যাতে বজ্রপাতের সময় কৃষক, শ্রমিক, জেলেরা সে সময় ঘরে আশ্রয় নিতে পারেন।’ 

বজ্রপাতে বিশ্বের ৪ ভাগের ১ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. এসএম ফারুখ বলেন, ‘আলস্কা ও কানাডায় বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি হলেও সেখানে প্রচুর সেন্সার রয়েছে। এসব সেন্সার দিয়ে বজ্রপাত সরাসরি মাটিতে নামিয়ে আনা হয়, যা তারা বিদ্যুতে রূপান্তর করে গৃহস্থালি ও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করে। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে মানুষের সুরক্ষায়। বজ্রপাতে সচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’ 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দেশে বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দুটি ইউনিয়নে দুটি ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ যন্ত্র স্থাপন করেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৭৫০টি যন্ত্র স্থাপন করে। জানা যায়, যন্ত্র স্থাপনের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বজ্রপাতে কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি। 

সম্প্রতি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদে সরেজমিন দেখা যায়, এলাকাটিতে একটি ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ নামক বজ্রপাত নিরোধক একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এর পাশেই ধানক্ষেতের নালা থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন মো. সুবেল মিয়া। তিনি বলেন, ‘হবিগঞ্জে অনেক বজ্রপাত হয়। অনেকে মারা যায়। তবে আমার জমির পাশে এই যন্ত্র বসানোর পর গত দুই বছরে এ এলাকায় কেউ বজ্রপাতে মারা যায়নি।’ 

জানা যায়, আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল নামক যন্ত্রটি তার চারদিকে ৪০০ মিটারের মধ্যে বজ্রপাত সৃষ্টি হলে নিজের দিকে টেনে মাটিতে পাঠিয়ে দেয়। এতে সেই স্থানের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা পায়।’ 

একই ইউনিয়নের গোবরখলা গ্রামের শিক্ষার্থী জুবায়ের তালুকদার বলেন, ‘যন্ত্রটি বসানোর আগের বছরও খোয়াই নদে বজ্রপাতে একজন জেলে এবং পাশের গ্রামে দুটি গরুসহ একজন মহিলা মারা যান। বজ্রপাতে এলাকার ২০-২৫টি গাছও নষ্ট হয়। তবে যন্ত্রটি স্থাপনের পর এ অঞ্চলে বজ্রপাতে কেউ মারা যায়নি।’ 

চুনারুঘাট উপজেলার শানখলা ইউনিয়নে আরেকটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এতে স্থানীয় লোকজন সুরক্ষিত আছে বলে জানিয়ে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বছরে যন্ত্রটি একটি বজ্রপাত নিজের দিকে টেনে এনেছে। আমাদের এই বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে এ ধরনের যন্ত্র স্থাপনের কারণে মানুষসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত রয়েছে।’ 

এ ব্যাপারে চুনারুঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তা নুর মামুন বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে দুই বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি স্থানে ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে। যন্ত্রটি স্থাপনে মাত্র একটি খুঁটি প্রয়োজন হয়, ফলে কৃষকের জমি নষ্ট হয় না।’ 

কী বলছেন সরবরাহকারীরা

বজ্রপাতের এ দুর্যোগে আগে কোন ডিটেকশন নিয়ে কাজ করেনি। প্রোটেকশন নিয়েই টিআর, কাবিখার বরাদ্দ দিয়ে পাইলটিং করেছে। তবে বর্তমানে তারা ডিটেকশন কে প্রাধান্য দিচ্ছে যা হয়তো সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হবে কিন্তু জীবন বাঁচাতে প্রটেকশনের কোন বিকল্প নাই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে প্রযু্ক্তি প্রতিষ্ঠান আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড‘ আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ নামে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রটি সরবরাহ করছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, এ ডিভাইসটির চারদিকে ৪০০ মিটার এলাকায় বজ্রপাত হলে তা নিজের দিকে টেনে নিয়ে মাটিতে নামিয়ে ফেলে। এটি সঠিকভাবে যত্ন নিতে পারলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। আমরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৯ সালে প্রায় ৭৫০টি স্থানে এ যন্ত্র স্থাপন করেছি। এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা তৈরি হয়নি। 

তিনি বলেন, ফ্রান্সের তৈরি ইন্ডিলেক এসেট (INDELEC ESEAT) সিস্টেম, যা এখন বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একটি বজ্রনিরোধক রড নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট ডিভাইস। এর ভেতরে সংযুক্ত রয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক (আইওটি) তথ্য বিশ্লেষণ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণের সুবিধা।

তিনি বলেন, যন্ত্রটি সোলার থেকে চার্জ নেওয়ায় আলাদা বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে না। ই-সিমের কারণে সরাসরি ডাটাগুলো পাওয়া যায়। যেকোন স্থানে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারে এর কার্যক্রম মনিটরিং করা যায়। 

তিনি বলেন, আইওটি সলিউশন ও জেনারেল দুই ধরনের যন্ত্রই রয়েছে। আমরা দেশের প্রতিটি বিমানবন্দরে, ওয়াসা, পিডব্লিউডি ও বিমানবাহিনীর অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে এ সিস্টেম স্থাপন করেছি। তা ছাড়া দুর্যোগ অধিদপ্তরও তারা কিছু কিছু স্থানে এই যন্ত্র স্থাপন করেছে। এ ডিভাইসটি আলাদা আলাদ ৬টি মডিউল দিয়ে একটি ডিভাইস। তার মধ্যে ৫টি বিকল্প হয়ে গেলেও একটি দিয়ে পুরো কাজ চলবে। এটির প্রটেকশন নিজের মধ্যেই রয়েছে। 

আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিজনেস হেড শেখ হাসিনা আক্তার বলেন, আমাদের ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ বজ্রপাত হলে ড্যাস বোর্ডে ই-মেইলে সকল ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আর তথ্য জমা থাকে ৫ বছর পর্যন্ত। এ প্রযুক্তি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপন করেছে। সেখানে তারা ভালো ফলাফল পাচ্ছে। 

তিনি বলেন, সরকার বজ্রপাতের সময় ও স্থান চিহ্নিত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। অথচ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন বজ্রপাতে কৃষক, শ্রমিকদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তা করা যায়।

কী চায় জনপ্রতিনিধিরা

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও মাবধপুর উপজেলার সাবেক সংদস্য শাম্মি আক্তার বলেন, দেশের ৫টি জেলায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। তার মধ্যে হবিগঞ্জ অন্যতম। এ অঞ্চলে দুর্যোগ ও বজ্রপাত বেশি। আমাদের উপজেলায় দুটি বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এই দুটি দিয়ে অল্পকিছু এলাকা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু আমাদের এখানকার কৃষকরা বর্ষা মৌসুমে মাঠে কাজ করে। তাদের ঘরে থাকার সুযোগ কম। তাই আরো বেশি করে যন্ত্রটি স্থাপন করা দরকার। কেননা এ পর্যন্ত যতগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে বজ্রপাত নিরোধনে সেখানে এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করছে।  

তিনি বলেন, বজ্রপাতে আরেকটি প্রাণও যেন না ঝরে সেজন্য এসব এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ডিভাইস স্থাপন করা দরকার। কেননা এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষক কাজ করে সেখানে কোন ধরনের শেল্টার থাকে না বা সুযোগও নেই। আর এসব যন্ত্র যেহেতু প্রায় আধা কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে কাজ করে তাহলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা