× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ই-কমার্স

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব

মুহিন তপু

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ২২:৫২ পিএম

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত এক দশকে যে রূপান্তর এসেছে, তার অন্যতম চালিকাশক্তি ই-কমার্স খাত। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় মোবাইল ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের প্রসার এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের উন্নয়নের ফলে দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত গড়ে উঠেছে একটি নতুন ধরনের বাজার ব্যবস্থা। এ খাতের বিকাশ যেমন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তেমনি কিছু কাঠামোগত ও বাস্তব চ্যালেঞ্জও সামনে এনেছে।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা মূলত ২০১২-১৩ সালের দিকে হলেও ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় তা ব্যাপকতা পায়। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (e-CAB) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের ই-কমার্স খাতের আকার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বর্তমানে দেশে ৫ হাজারের বেশি রেজিস্টার্ড ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স প্লাটফর্মে সক্রিয় পেজের সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। এই খাতে সক্রিয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী, যারা ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

অর্থনীতিতে ই-কমার্সের বহুমাত্রিক প্রভাব

চাকরি সৃষ্টি ও নতুন দক্ষতা : ই-কমার্স খাতে সরাসরি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরোক্ষভাবে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি, ভিডিও এডিটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কাস্টমার সার্ভিস, ডেলিভারি ও কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা খাতে দক্ষতার চাহিদা তৈরি হয়েছে। শিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র খুলেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন : ই-কমার্সে নারীর অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক নারী উদ্যোক্তা পরিবার সামলানোর পাশাপাশি ঘরে বসে ব্যবসা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে এটি নারীনির্ভর পরিবারে আর্থিক স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ নারীরাও ফেসবুক বা মোবাইল অ্যাপে ভিত্তি করে ব্যবসা শুরু করেছেন।

দেশীয় পণ্যের ডিজিটাল বাজার : ই-কমার্স দেশীয় পণ্যের জন্য একটি নতুন ও বিস্তৃত বাজার তৈরি করেছে। কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প, হাতে বানানো প্রসাধনী, দেশীয় পোশাক, বই, স্থানীয় খাবার ইত্যাদি এখন অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু উদ্যোক্তাদের আয় বাড়াচ্ছে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে চালিত করতেও সাহায্য করছে।

উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি : ই-কমার্সের সহজ প্রবেশাধিকার ও কম মূলধন নির্ভরতার কারণে তরুণ সমাজ উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ফলে উদ্ভাবনী চিন্তা, নতুন ব্যবসার মডেল ও প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ একটি নতুন উদ্যোগ-ভিত্তিক অর্থনীতির পথে এগোচ্ছে।

ট্যাক্স ও রাজস্ব : বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরকার এখন রাজস্ব পাচ্ছে। ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা বাড়ছে, ফলে ভ্যাট ও আয়কর আদায় সহজ হচ্ছে। এই খাতকে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় আনলে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা আরও বাড়বে।

অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য হ্রাস : ই-কমার্স শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে দিচ্ছে। গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ এখন শহরের মতোই অনলাইন থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ পণ্য শহরে কিংবা বিদেশেও বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রবণতা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহায়তা করছে।

ব্যবসার ডিজিটাল রূপান্তর : প্রচলিত খুচরা দোকানগুলোও এখন অনলাইন প্লাটফর্মে আসার চেষ্টা করছে। ফলে ব্যবসা চালানোর ধরন বদলে যাচ্ছে। POS সফটওয়্যার, অনলাইন ক্যাটালগ, ডিজিটাল মার্কেটিংÑ এসব ব্যবহারের হার বাড়ছে।

বিনিয়োগ ও ফান্ডিং : ই-কমার্স খাতে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। স্টার্টআপ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফান্ডিং প্লাটফর্ম থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। এই বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতিতে আস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

সফল ই-কমার্স স্টার্টআপ ও উদ্যোগ

দারাজ বাংলাদেশ : আন্তর্জাতিক গ্রুপের অংশ হলেও স্থানীয় লজিস্টিক ও পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করে বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চালডাল : ইনভেন্টরি-ভিত্তিক মডেলে গ্রোসারি ডেলিভারির বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।

রকমারি : শুধু বই বিক্রির মাধ্যমে অনলাইন পাঠকদের একটি বড় সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে।

Pickaboo, PriyoShop, Ajkerdeal : মধ্যবিত্ত ও তরুণ ক্রেতাদের কাছে প্রযুক্তিপণ্য ও লাইফস্টাইল পণ্যের জনপ্রিয় বিকল্প।

চ্যালেঞ্জের বাস্তবতা

বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট : ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকার ইত্যাদি প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড জনমনে গভীর আস্থার সংকট তৈরি করেছে। অনেকেই এখন অনলাইনে কেনাকাটায় দ্বিধাগ্রস্ত।

আইনি কাঠামোর দুর্বলতা : ২০২১ সালের ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালনা নীতিমালা কার্যকর হলেও এর প্রয়োগ ও তদারকির ঘাটতি রয়েছে। প্রতারণার শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় অপেশাদার প্রতিষ্ঠান টিকে যাচ্ছে।

সাইবার নিরাপত্তা : গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এখনও অধিকাংশ প্লাটফর্মে দুর্বল। SSL না থাকা, নিরাপদ পেমেন্ট না থাকা এসব সমস্যার জন্ম দেয়।

লজিস্টিক ও ডেলিভারি সমস্যা : বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে অনেক বেশি। পণ্য হারানো ও ক্ষতির অভিযোগও রয়েছে।

রিফান্ড ও কাস্টমার সার্ভিস দুর্বলতা : বেশিরভাগ প্লাটফর্মে পণ্য ফেরত বা অর্থ ফেরতের কার্যকর ব্যবস্থা নেই, যা ভোক্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা : PayPal না থাকায় ফ্রিল্যান্সিং বা ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সে সমস্যা হচ্ছে।

নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার 

AI ও মেশিন লার্নিং : পণ্যের সাজেশন, চ্যাটবট কাস্টমার সাপোর্ট, ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনাÑ এসব জায়গায় AI ব্যবহার শুরু হয়েছে।

ডেটা অ্যানালিটিকস : গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ করে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং বাড়ানো হচ্ছে।

মোবাইল ফার্স্ট অ্যাপ : বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় অংশ মোবাইল-নির্ভর, তাই মোবাইল অ্যাপ ও মোবাইল-ফ্রেন্ডলি ওয়েবসাইটের চাহিদা বাড়ছে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ

ডিজিটাল কমার্স সেল (DCC) : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠিত এই সেল নীতিমালা, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও প্লাটফর্ম যাচাইয়ে কাজ করছে।

ICT Division ও Startup Bangladesh : তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন, পরামর্শ ও নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।

পোস্ট অফিস ও লজিস্টিক সহযোগিতা : গ্রামীণ এলাকায় পণ্য পৌঁছানোর জন্য ডাক বিভাগের মাধ্যমে একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর ডেলিভারি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স : দেশীয় হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য বা ফ্যাশনের বৈশ্বিক বাজার রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সম্ভব।

গ্রামীণ ই-কমার্স হাব : প্রতিটি উপজেলায় ডিজিটাল সেন্টার ও ট্রেনিং দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় পণ্য অনলাইনে বিক্রির সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।

ডিজিটাল সরকারি কেনাকাটা (e-GP) : সরকারি ক্রয়বিক্রয় প্রক্রিয়া আরও ডিজিটাল হলে ই-কমার্সের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুযোগ বাড়বে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

সুনির্দিষ্ট আইন প্রয়োগ ও শাস্তির বিধান কার্যকর করা

SSL সনদ বাধ্যতামূলক করা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

পণ্যের ফেরত ও অর্থ রিফান্ড প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা

উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া

দেশীয় পেমেন্ট গেটওয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনে সক্ষম করা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রয়োগ জোরদার করা

শেষের আগে 

ই-কমার্স খাত বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যা অর্থনীতিতে নতুন গতিপ্রবাহ আনতে সক্ষম। তবে এ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন সুসংহত নীতি, প্রযুক্তি-সহযোগিতা, উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভোক্তার আস্থা অর্জনের কার্যকর উদ্যোগ। ই-কমার্স কেবল ব্যবসার পরিবর্তন নয়, এটি একটি নতুন অর্থনৈতিক সংস্কৃতিÑ যেখানে সুযোগ, উদ্ভাবন এবং স্বচ্ছতার সমন্বয় থাকলেই কেবল সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা