বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা
মুহিন তপু
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৪৯ পিএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:৫৪ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত সাম্প্রতিক দশকে উন্নতির ছোঁয়া পেলেও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দেশের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা মূলত শহরকেন্দ্রিক, যেখানে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ভারসাম্যহীনতা, স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম, ডাক্তার ও নার্সের স্বল্পতা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বড় বাধা।
তবে হেলথ টেকনোলজির ব্যবহার এ চিত্র পাল্টে দিতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারে টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল হেলথ রেকর্ড, এআইভিত্তিক রোগ নির্ণয়সহ বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ দেশে ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো দেশের অধিকাংশ মানুষের চিকিৎসার প্রধান ভরসা। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬২টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১০০টির বেশি জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল, ৫০০-এর বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর অন্যতম সুবিধা হলো বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়। তবে ওষুধের ঘাটতি, চিকিৎসা সরঞ্জামের স্বল্পতা, দীর্ঘ লাইনের সমস্যা এবং ডাক্তারের অনুপস্থিতি সরকারি হাসপাতালের বড় দুর্বলতা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সেবা তুলনামূলক ভালো হলেও চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি, যা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল।
গ্রামীণ অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলেও জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য শহরে আসতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য ৬.৩ জন ডাক্তার এবং ৩.৬ নার্স রয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মানদণ্ড অনুযায়ী খুবই কম।
স্বাস্থ্য খাতের প্রধান সমস্যা
স্বাস্থ্যসেবার অসমতা : শহর ও গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থার বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। শহরে আধুনিক হাসপাতাল থাকলেও গ্রামীণ অঞ্চলে চিকিৎসাসেবার অবস্থা তুলনামূলক খারাপ।
স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের ঘাটতি : স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ২.৩% ব্যয় করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম।
স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য কমপক্ষে ২২ জন স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, কিন্তু বাংলাদেশে তা অনেক কম।
ডিজিটাল হেলথ রেকর্ডের অভাব : বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ হাসপাতাল ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করে, যা অনেক সময়সাপেক্ষ।
টেলিমেডিসিন ও ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা সীমিত : অনেক গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হওয়ায় অনলাইনভিত্তিক চিকিৎসাসেবা এখনও পুরোপুরি কার্যকর নয়।
হেলথ টেকনোলজির সম্ভাবনা
বাংলাদেশে হেলথ টেকনোলজির প্রসার দ্রুত বাড়ছে। প্রযুক্তির সহায়তায় চিকিৎসা সহজলভ্য ও কার্যকর হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির ভূমিকা নিম্নলিখিতভাবে বিবেচনা করা যায়Ñ
টেলিমেডিসিন ও অনলাইন কনসালটেশন : এখন মানুষ ঘরে বসেই ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারছে।
মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে।
ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড : ই-প্রেসক্রিপশন, ডিজিটাল মেডিকেল রিপোর্ট সংরক্ষণ ও ডেটা অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে রোগী পরিচালনা সহজতর হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও রোগ নির্ণয় : এআইভিত্তিক সফটওয়্যার এখন রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করছে, যেমন এক্স-রে ও এমআরআই রিপোর্ট বিশ্লেষণ।
স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপ ও স্টার্টআপ : বাংলাদেশের কিছু স্টার্টআপ স্বাস্থ্য খাতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হেলথ টেক স্টার্টআপ ও অ্যাপ
ডকটাইম (DocTime)
ডকটাইম একটি জনপ্রিয় টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ২৪/৭ ডাক্তারের পরামর্শ সেবা পাওয়া যায়। রোগী মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে ডাক্তারের সঙ্গে ভিডিও কলে যুক্ত হতে পারে। (www.doctime.com.bd)
ধানসিড়ি (DhanSeeri)
বাংলাদেশের একটি হেলথ টেক স্টার্টআপ, যা হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে।
মেডিটর (MediTor)
এ অ্যাপের মাধ্যমে হোম ডায়াগনস্টিক সেবা এবং এআই-বেইসড ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়া যায়। এটি বিনামূল্যে সাধারণ চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করে।
আয়ুর্বেদিক কেয়ার (Ayurvedic Care)
বাংলাদেশে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও প্রাকৃতিক ওষুধের হোম ডেলিভারি সেবা দিচ্ছে।
সরকারি ডিজিটাল হেলথ সেবা
বাংলাদেশ সরকার ৩৩৩ ও ১৬২৬৩ নম্বরে স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র চালু করেছে, যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া যায়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে হেলথ টেকনোলজির ব্যবহার আরও বাড়ানোর জন্য কিছু করণীয়Ñ
টেলিমেডিসিন সেবা আরও সম্প্রসারণ : প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধি করে টেলিমেডিসিন সহজলভ্য করা দরকার।
স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি : সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড চালু করা : প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডিজিটাল রোগী ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
এআই ও বিগ ডেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা : রোগ নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও বিগ ডেটা ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
শেষের আগে
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়ছে, তবে এটি আরও দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বাস্থ্য অ্যাপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে আরও সহজলভ্য করা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও স্টার্টআপগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন, যাতে স্বাস্থ্যসেবা আরও স্বচ্ছ, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়। এ ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব আসতে পারে, যা দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।