বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি
মুহিন তপু
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:০৯ পিএম
তথ্যপ্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের শক্তিশালী হাতিয়ার।
তথ্যপ্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের শক্তিশালী হাতিয়ার। ১৭ কোটি মানুষের এ দেশটি জনসংখ্যার চাপ, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল স্রোতে যুক্ত হচ্ছে। ফিনটেক, এডটেক, অ্যাগ্রিটেক, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, হেলথটেক, গেমিং আর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতো খাতগুলো বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে, যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য হতে পারে একটি রোল মডেল।
বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বর্তমান প্রবণতা
১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও স্বয়ংক্রিয়তা
বিশ্বজুড়ে AI এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
বিভিন্ন খাতে AI স্বয়ংক্রিয়তা আনছে, যা প্রচলিত চাকরির ধরন বদলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে AI-ভিত্তিক সমাধান এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এর প্রভাব গভীর হতে পারে।
২. ব্লকচেইন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি
আর্থিক লেনদেন, চুক্তি এবং ডেটা ব্যবস্থাপনায় ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
বাংলাদেশে এখনও এ খাত নিয়ে কঠোর নীতিমালা রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এর ব্যবহার বাড়তে পারে।
৩. ৫জি ও উচ্চগতির ইন্টারনেট
উন্নত বিশ্বে ৫জি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে, যা তথ্যপ্রবাহ ও সংযোগ সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ৫জি প্রযুক্তি চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে রয়েছে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ।
৪. সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য সুরক্ষা
বিশ্বজুড়ে সাইবার আক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ব্যক্তি, ব্যবসা এবং রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল, যা ডেটা লিক ও হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
৫. রিমোট ও হাইব্রিড কাজের পরিবেশ
কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে অনেক প্রতিষ্ঠান রিমোট ও হাইব্রিড কাজের মডেলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও এ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে, তবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব এ ক্ষেত্রে বড় বাধা।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসমূহ
ফিনটেক : আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন
বাংলাদেশে ফিনটেক খাত গত দশকে অর্থনৈতিক গতিশীলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৪ সালে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) লেনদেনের পরিমাণ ১০.৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিকাশ ও নগদের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো দৈনিক গড়ে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন পরিচালনা করছে। ফিনটেক স্টার্টআপ ‘শপআপ’ ২০২৪ সালে ৫০ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।
সমস্যা
সম্ভাবনা
৬০% গ্রামীণ নারী এমএফএস ব্যবহার করে আত্মনির্ভর হচ্ছেন।
আইএমএফের ধারণা, ফিনটেক সেবা রপ্তানি করে বাংলাদেশ ২০৩০ সালে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে।
এডটেক : দক্ষতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উত্থান
বাংলাদেশে এডটেক শিক্ষার গতিপথ বদলে দিচ্ছে। ‘১০ মিনিট স্কুল’ প্রতিদিন ৫ লাখ শিক্ষার্থীকে ১ হাজার কোর্স সরবরাহ করছে। ২০২৫ সালে এডটেক ব্যবহারকারী ২২ লাখ ছাড়িয়েছে।
সমস্যা
সম্ভাবনা
অ্যাগ্রিটেক : কৃষি থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি
বাংলাদেশের অর্থনীতির ১৩% কৃষি থেকে আসে। অ্যাগ্রিটেক এ খাতে নতুন গতি এনেছে। ‘আইফার্মার’ ৫৫ হাজার কৃষককে সংযুক্ত করেছে। ২০২৫ সালে কৃষকের আয় বেড়েছে ২২%।
সমস্যা
সম্ভাবনা
ই-কমার্স : বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রবেশ
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দারাজ বছরে ২.২ কোটি অর্ডার এবং পাঠাও ফুড দৈনিক ১ লাখ ২০ হাজার ডেলিভারি দিচ্ছে।
সমস্যা
সম্ভাবনা
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ১২ লাখ ফ্রিল্যান্সার ১.২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন। আপওয়ার্কে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং ফাইভারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সমস্যা
সম্ভাবনা
হেলথটেক : স্বাস্থ্য থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
‘প্রহরী’ ও ‘ডক্টর কল’ ২০২৪ সালে ৫ লাখ রোগীকে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছে।
সমস্যা
সম্ভাবনা
গেমিং : বিনোদন থেকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বাংলাদেশের গেমিং শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থান গড়ে তুলছে। ২০২৪ সালে স্থানীয় ১০০ গেমিং স্টার্টআপ ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা এ শিল্পের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
সমস্যা
সম্ভাবনা
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট : প্রযুক্তির মূল শক্তি
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট খাতে ২০২৪ সালে দেশের ৫০০ সফটওয়্যার ফার্ম ৮০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা এ শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
সমস্যা
সম্ভাবনা
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ফিনটেক সেক্টরের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এডটেক খাতে ১০ লাখ ট্যাব বিতরণ করা হচ্ছে। অ্যাগ্রিটেক খাতে ১ হাজার কৃষককে ড্রোন প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বেসরকারি খাতেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংক এবং গ্রামীণফোন ১০০ ফিনটেক স্টার্টআপে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ‘১০ মিনিট স্কুল’ ৫ হাজার শিক্ষককে ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইটিইউর মতো সংস্থাগুলোও গেমিং শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করছে।
২০২৪ সালে দেশের ৫০০ সফটওয়্যার ফার্ম ৮০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা এ শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
পরিশেষে
তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান ও চর্চা বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করছে। ফিনটেক, এডটেক, অ্যাগ্রিটেক, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং হেলথটেক, গেমিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতো খাতগুলোর মাধ্যমে সম্ভব অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন।