ব্লকচেইন প্রযুক্তি
মুহিন তপু
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১২:৩৬ পিএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১২:৪৪ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা, তথ্য সংরক্ষণ, লেনদেনের স্বচ্ছতা এবং বিকেন্দ্রীভূত অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এটি কেবল ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য, সরকারি নথি সংরক্ষণ, সরবরাহ চেইন, শিক্ষা, ভোটিং সিস্টেমসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্লকচেইনের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি
ব্লকচেইন একটি বিকেন্দ্রীভূত ডিজিটাল লেজার, যেখানে প্রতিটি তথ্য ব্লকের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় এবং প্রতিটি ব্লক পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে ক্রিপ্টোগ্রাফিকভাবে সংযুক্ত থাকে। এটি একটি পরিবর্তন-অযোগ্য ও স্বচ্ছ পদ্ধতি যা তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি সাম্প্রতিক সময়ের অভিনব উদ্ভাবন। ব্লকচেইন তথ্য সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে নিরাপদ ও উন্মুক্ত পদ্ধতি। সাতোশি নাকামতো ছদ্মনামের এক ব্যক্তি বা গ্রুপকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উদ্ভাবক মনে করা হয়। অনলাইন পরিসংখ্যান পোর্টাল, Statistaর মতে ২০৩২ সাল নাগাদ ব্লকচেইন প্রযুক্তির মার্কেট সাইজ হবে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
• বিকেন্দ্রীকরণ : কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক নেই, নেটওয়ার্কের সব অংশগ্রহণকারী একই ব্লকচেইন কপি সংরক্ষণ করে।
• স্বচ্ছতা : প্রতিটি লেনদেন নেটওয়ার্কের সব অংশগ্রহণকারীর জন্য দৃশ্যমান।
• নিরাপত্তা : প্রতিটি ব্লক ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে, যা হ্যাকিং রোধে কার্যকর।
• পরিবর্তন-অযোগ্যতা : একবার কোনো ব্লকে ডেটা সংরক্ষণ হলে তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাস্তব উদাহরণ
ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স
ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যাংকিং খাতে নিরাপদ এবং দ্রুত লেনদেন নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। SWIFT এবং JPMorgan Chase ব্লকচেইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন আরও দ্রুত ও স্বচ্ছ করেছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল ইউয়ান চালু করেছে, যা একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে কাজ করছে। এটি আর্থিক লেনদেনের খরচ কমানো এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
সরকারি নথি ও ভূমি রেজিস্ট্রি
ব্লকচেইন প্রযুক্তি সরকারি তথ্য সংরক্ষণে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এস্তোনিয়া সরকার নাগরিকের তথ্য সংরক্ষণে ব্লকচেইন ব্যবহার করছে, যা পরিচয় চুরি এবং নথির জালিয়াতি রোধে সহায়তা করছে। দুবাই সরকার ঘোষণা করেছে ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের সব সরকারি লেনদেন ব্লকচেইনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যা কাগজভিত্তিক লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা কমাবে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও দক্ষ করে তুলবে।
স্বাস্থ্য খাত
স্বাস্থ্যসেবার তথ্য সংরক্ষণে ব্লকচেইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের Mayo Clinic ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর মেডিকেল রেকর্ড নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করছে, যা রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করছে। ভারতের Apollo Hospitals ব্লকচেইনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা আরও উন্নত করছে, যার ফলে তথ্য সংরক্ষণ আরও নিরাপদ ও দ্রুত হচ্ছে।
শিক্ষা ও সার্টিফিকেট যাচাই
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্লকচেইন ব্যবহার করে জালিয়াতি রোধ করা হচ্ছে। MIT (যুক্তরাষ্ট্র) তাদের শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করা যায়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট জালিয়াতির আশঙ্কা দূর হয় এবং চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করতে পারে।
সরবরাহ চেইন ও খুচরা বাজার
ব্লকচেইন প্রযুক্তি সরবরাহ চেইনে পণ্যের গতিপথ অনুসরণ করতে সাহায্য করছে। Walmart, Nestlé ও Unilever খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্লকচেইন ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে পণ্যের উৎপত্তি ও গুণগত মান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা খাদ্যদ্রব্যের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
বিনোদন ও কপিরাইট সংরক্ষণ
বিনোদনশিল্পে ব্লকচেইন ব্যবহার করে কপিরাইট সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে। Sony Music ও Universal Music গানের স্বত্ব সংরক্ষণে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এর ফলে শিল্পীদের স্বত্ব ও রয়্যালটি সুরক্ষিত থাকে এবং পাইরেসির সমস্যা কমে। একইভাবে চলচ্চিত্র ও ডিজিটাল কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলোও তাদের স্বত্ব সংরক্ষণে ব্লকচেইন গ্রহণ করছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডিজিটাল সম্পদ
ব্লকচেইনের সবচেয়ে সুপরিচিত প্রয়োগ হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি, যেমন বিটকয়েন ও ইথেরিয়াম। ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক লেনদেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ব্যাংকিংব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ও দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, যদিও এটি আইনগত ও নিয়ন্ত্রক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া NFT (Non-Fungible Token) এবং ডিজিটাল সম্পদের বিক্রয়েও ব্লকচেইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে ব্লকচেইন প্রযুক্তির সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ব্লকচেইন প্রযুক্তির সম্ভাবনা বহুমুখী, বিশেষ করে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তর, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা খাতে। সরকারি পর্যায়ে ভূমি রেজিস্ট্রি, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থাপনায় ব্লকচেইন ব্যবহারের পরিকল্পনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) ব্লকচেইনের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও ব্লকচেইনের প্রচলন শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষণা কেন্দ্র ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। দেশে এ প্রযুক্তি শেখার জন্য কিছু অনলাইন ও অফলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। Web Institute এবং GoEdu ব্লকচেইন উন্নয়ন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি-সংক্রান্ত কোর্স প্রদান করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (BCC) এবং আইসিটি ডিভিশন ব্লকচেইন প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
এ ছাড়া কিছু বেসরকারি সংস্থা ও স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নথিপত্র সংরক্ষণ, ডিজিটাল পরিচয় যাচাই এবং স্মার্ট চুক্তির মতো বিভিন্ন সমাধান তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আইনগত বিধিনিষেধ
বাংলাদেশে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বৈধ হলেও ক্রিপ্টোকারেন্সি-সংক্রান্ত কার্যক্রম এখনও নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংক বিটকয়েন এবং অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেনের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করেছে। তবে নীতিনির্ধারকরা ব্লকচেইনকে আর্থিক লেনদেন ও সরকারি কার্যক্রমে ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছেন।
পরিশেষে
ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সক্ষম একটি উদ্ভাবন। বিশ্বজুড়ে এর প্রয়োগ সম্ভাবনা ব্যাপক, তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। সরকার, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।