মুহিন তপু
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫ ১১:৪৮ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৫ ১৩:০১ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অনুষঙ্গ। বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রগতি সত্ত্বেও গ্লোবাল ডেটা রেফারেন্স লাইব্রেরি-ডেটা রিপোর্টালের ২০২৩ সালের গ্লোবাল ডিজিটাল ওভারভিউ রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দেশের প্রায় ১০ কোটি ৫১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ (মোট জনসংখ্যার ৬১.১%) এখনও ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ একবারেই অপ্রতুল।
এমনই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে স্টারলিংক সেবা চালুর আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি পাঠানো চিঠিতে তিনি স্টারলিংকের গুরুত্ব তুলে ধরেন, যা তরুণ উদ্যোক্তা, গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক হবে। এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনূস ও ইলন মাস্কের মধ্যে এ বিষয়ে আলাপ হয়।
স্টারলিংক : নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে
স্পেসএক্সের স্টারলিংক ইন্টারনেট পরিষেবা লো আর্থ অরবিট (LEO) স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম। স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা দেয় স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে।
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারির তথ্যানুযায়ী, স্টারলিংকের ৬ হাজার ৯৯৪টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে রয়েছে। ২০১৫ সালে স্পেসএক্স স্টারলিংক প্রকল্প শুরু করে এবং ২০১৯ সালে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে স্টারলিংক সেবা দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান প্রথম স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু করেছে।
স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
• কম ল্যাটেন্সি ও উচ্চ গতি : স্টারলিংক স্যাটেলাইট মাত্র ৫৫০ কিমি উচ্চতায় অবস্থান করায় ল্যাটেন্সি ২০-৪০ মিলিসেকেন্ড, যা ফাইবার অপটিক সংযোগের কাছাকাছি। ব্যবহারকারীরা ৫০ Mbps থেকে ২৫০ Mbps পর্যন্ত গতির ইন্টারনেট সুবিধা পাবেন।
• বিশ্বব্যাপী কভারেজ : দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়ও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে, যা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন বা চরাঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
• দুর্যোগ প্রতিরোধী নেটওয়ার্ক : ভূমিকম্প, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় যখন প্রচলিত নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে যায়, তখন স্টারলিংক জরুরি পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করে।
• সহজ স্থাপনা : ব্যবহারকারীরা একটি ছোট স্যাটেলাইট রিসিভার ও রাউটার ব্যবহার করে সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
বাংলাদেশের এখনকার ইন্টারনেট পরিস্থিতি
বাংলাদেশে এখন যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হয়, তা সাবমেরিন কেবলনির্ভর। অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে তারের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ এনে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি) মানুষকে ইন্টারনেট সেবা দেয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগের বিস্তৃতি থাকলেও রয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাÑ
• ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা : দেশের ৯৭% ফাইবার অপটিক কেবল শহরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, গ্রামাঞ্চলে এখনও স্থিতিশীল ব্রডব্যান্ড পৌঁছেনি।
• মোবাইল ইন্টারনেটের আধিপত্য : ১২.৮ কোটি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী থাকলেও 4G নেটওয়ার্ক এখনও ৮০% অঞ্চলে পৌঁছেনি, আর 5G বাণিজ্যিকভাবে এখনও চালুই হয়নি।
• উচ্চমূল্যের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট : GEO স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের ব্যয় (প্রতি Mbps ৩,০০০-৫,০০০ টাকা) অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে।
• ডিজিটাল বৈষম্য : দুর্গম এলাকাগুলোর মানুষ ডিজিটাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যবসায়িক যোগাযোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কেন স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ?
স্টারলিংক ইন্টারনেট ডিজিটাল সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত-
• গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংযোগ : পার্বত্য, চর, উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপবাসীদের উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা দিতে পারবে।
• ব্যবসা ও উদ্যোক্তা খাতে গতি আসবে : লজিস্টিক, ই-কমার্স ও আউটসোর্সিং খাতে বিশ্বমানের কানেকটিভিটি তৈরি হবে। ফ্রিল্যান্সিং ও রিমোট ওয়ার্কের প্রসার ঘটিয়ে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার আয় বাড়ানো সম্ভব।
• শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা : ই-লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম ও টেলিমেডিসিন সুবিধার উন্নয়ন ঘটবে।
• দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় জরুরি যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবে।
• সামরিক ও কৌশলগত নিরাপত্তা : সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে।
• উদ্ভাবন ও গবেষণা : উচ্চগতির ইন্টারনেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য Big Data এবং AI গবেষণা ত্বরান্বিত করবে।
• সুরক্ষিত ও সেন্সরশিপমুক্ত ইন্টারনেট : স্টারলিংকের নিজস্ব নেটওয়ার্ক গোপনীয়তা বজায় রাখে, যা সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি আনতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা
স্টারলিংক ইন্টারনেট বাংলাদেশে চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবেÑ
• নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা : বিটিআরসির লাইসেন্স, ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ ও টেলিকম আইন মেনে চলতে হবে।
• উচ্চমূল্য : স্টারলিংকের প্রাথমিক ডিভাইসের দাম প্রায় ৪৩০০০-৭৪০০০ টাকা পর্যন্ত এবং আবাসিক গ্রাহকের জন্য মাসিক সাবস্ক্রিপশন ১২,০০০-১৫,০০০ টাকা, যা বেশ ব্যয়বহুল। তবে করপোরেট গ্রাহকের জন্য স্টারলিংক কিটের দাম ও মাসিক ফি দ্বিগুণের বেশি। দেশভেদে দামে ভিন্নতা রয়েছে।
• আবহাওয়ার প্রভাব : ট্রপিক্যাল স্টর্ম ও ভারী বৃষ্টির সময় স্যাটেলাইট সিগন্যাল দুর্বল হতে পারে।
• ডেটা নিরাপত্তা : বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে ডেটা প্রবাহ নিয়ে সরকারি উদ্বেগ থাকতে পারে।
বাংলাদেশে স্টারলিংক বাস্তবায়নের কৌশল
স্টারলিংক কার্যকরভাবে চালু করতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারেÑ
• সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ প্রকল্প গ্রহণ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্টারলিংক ইন্টারনেট অন্তর্ভুক্ত করা।
• মূল্য কমানোর উদ্যোগ
বাংলাদেশে স্টারলিংক ডিভাইস অ্যাসেম্বলিং প্লান্ট স্থাপন করে উৎপাদন খরচ কমানো।
শিক্ষা খাত বা কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান।
• নীতি ও আইনি সংস্কার
বিটিআরসির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নীতিমালা তৈরি করে সহজ অনুমোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় স্টারলিংক সংযোগ সম্প্রসারণ।
• প্রযুক্তিগত অভিযোজন
সৌরশক্তিচালিত টার্মিনাল ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান।
স্থানীয় ISP-দের সঙ্গে অংশীদারি করে স্টারলিংক ব্যাকহল হিসেবে ব্যবহার করা।
শেষের আগে
স্টারলিংক ইন্টারনেট বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং ডিজিটাল অর্থনীতি ও সামাজিক সমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বোপরি, স্টারলিংক ইন্টারনেট বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের অন্যতম অংশীদার হতে পারে, যদি সরকার, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এ নিয়ে একযোগে কাজ করে।