নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৫২ পিএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৫০ পিএম
মাশরাফি বিন মর্তুজা ও নাজমুল হোসেন শান্ত
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। শিরোপার অন্যতম দাবিদার ভারত। দলটিতে তারকার মেলা। শচীন টেন্ডুলকার, বিরেন্দর শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলী, যুবরাজ সিং, হরভজন সিং, মাহেন্দ্র ধোনি, অজিত আগারকার, জহির খানদের মতো বিশ্ববরেণ্য তারকা। বিপরীতে তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ দল। বৈশ্বিক আসরে একমাত্র প্রমাণিত নাম মোহাম্মদ আশরাফুল। যদিও তার ধারাবাহিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা আন্তর্জাতিক আঙিনায় অচেনা নাম। এই দলটিতে ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। ১৭ মার্চ পোর্ট অব স্পেনে ভারতের মুখোমুখি হওয়ার আগে হার না মানা মানসিকতার মাশরাফি বড় মুখ করে বললেন, যদি উইকেটে কিছু থাকে তাহলে ‘ভারতকে ধরে দিবানি’।
এই একটি কথাই হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের আত্মবিশ্বাসের দর্শন। প্রতিপক্ষ যেই হোক হারার আগে হারতে জানে না টাইগাররা। মাশরাফির ‘ধরে দিবানি’ আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল পুরো দলের মধ্যে। এরপর যা ঘটল তা সবারই জানা। ক্যারিবীয় মুলুকে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বিশ্বকাপকে নিজেদের রঙে রাঙাল টাইগাররা। ভারতকে ৫ উইকেটের ব্যবধানে হারাল বাংলাদেশ।
এই ক্যারিবীয় অঞ্চলেই বেজে উঠেছে আর একটি বিশ্বকাপের দামামা। জুনের শুরুতেই মাঠে গড়াচ্ছে নবম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। এই বিশ্বকাপ ঘিরে বাকি সব দেশের মতোই সাজ সাজ রব। দলে কারা খেলবেন, কারা বাদ পড়বেন- এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এমন একটা সময়ে আসন্ন ক্যারিবীয়-মার্কিন বিশ্বকাপ মিশনে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বলেছেন অনেক কথাই। তবে সেই ‘ধরে দিবানি’ তেজ যেন অনেকটায় ম্লান।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে নিজের বিশ্বকাপ ভাবনা নিয়ে প্রত্যাশার সীমানাকে ছোট করে রাখতে বলেছেন টাইগার কান্ডারি নাজমুল হোসেন শান্ত। তার ভাষায়, ‘বিশ্বকাপের আগে প্রতিবারই দেখি, এটা করব, সেটা করব- অনেক কথাবার্তা হয়। একটা অনুরোধ থাকবে আপনাদের কাছে, বেশি প্রত্যাশা করার দরকার নেই। সবার মনের মধ্যেই থাক সেটি।’ প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মেলে না, বিষয়টাকেই বড় করে দেখেছেন বাংলাদেশের এই তরুণ অধিনায়ক। বেশিরভাগ সময়ই প্রত্যাশা চুপসে যায় বায়ুশূন্য বেলুনের মতো। এতে করে তীব্র সমালোচনার কাঠগড়ায় ওঠেন ক্রিকেটাররা। প্রত্যাশার এই চাপ নিতে ইচ্ছুক নন তরুণ অধিনায়ক শান্ত।
কথাগুলো বেশ গুছিয়ে শান্ত মেজাজেই বলেছেন টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অভিযাত্রী দলের এই নেতা। বিশ্বকাপে টানা ব্যর্থতার মধ্যে থাকা দলের উত্তরাধিকারী হিসেবে বাস্তবতার কথাটিই হয়তো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শান্ত। আর এটা করতে গিয়ে মাঠের লড়াইয়ের যে অন্তর্নিহিত দর্শন, ‘ফাইটিং স্পিরিট’ সেটাকেই যেন পাশ কাটাতে চা্ইছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। হারার আগে হেরে না যাওয়ার মানসিকতাই খেলার মাঠের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। হোক না সে পরাশক্তি! জানবাজি রেখে লড়াই করতে কোনো বাধা নেই। চোখের পলকে সব হিসাব বদলে দেওয়ার ঘটনাই তো খেলার মাঠের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ধরা যাক ১৯৯৬ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার কথাই। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ টানা পাঁচ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল অনেক দূরের ব্যাপার একবারও নকআউট পর্বে পৌঁছাতে পারেনি লঙ্কানরা। সেই শ্রীলঙ্কাই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে কৃতিত্ব দেখায় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। ফুটবলে অচেনা জনপদ মরক্কোও সব হিসাব পাল্টে দিয়ে জায়গা করে নেয় বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। গোটা দুনিয়াকে চমকে দেওয়ার এই যে অভাবনীয় ঘটনাগুলো তার মূলে আছে প্রবল আত্মবিশ্বাস। সর্বোপরি লড়াকু মানসিকতা।
২০১৫ বিশ্বকাপে প্রবল প্রতাপ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছিল মাশরাফির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। আমরাও পারি, এই বিশ্বাসটাই সবার আগে, এরপর বাকিটা সামর্থ্য কিংবা দক্ষতার প্রশ্ন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আর এ সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা তুলনা দেওয়া যাক। ওই সময় কালে-ভদ্রে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত টাইগাররা। প্রধান কোচ, স্পেশালিস্ট ব্যাটিং কোচ, স্পেশালিস্ট পেস বোলিং কোচ, নামিদামি ফিল্ডিং কোচ, বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল মেডিকেল সার্ভিস- এসব তো তখন ভাবনারও অতীত। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জমজমাট টি-টোয়েন্টি আসর বিপিএলের আয়োজনও ছুঁয়েছে দুই অঙ্কের ঘর। তারপরও দেড় যুগ আগের সেই আত্মবিশ্বাস কেন নেই বর্তমান দলের মধ্যে।
সুদীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান আছেন এই দলে। বিশ্বসেরাদের মধ্যে আইপিএল মাতাচ্ছেন কাটার মাস্টারখ্যাত মোস্তাফিজুর রহমান। বিশ্বসেরা প্লেয়ারদের সঙ্গে নিয়মিতই খেলছেন দেশের ক্রিকেটাররা। তবু কেন প্রবল আত্মবিশ্বাস টাইগার দলপতি পারছেন না, এবার সময় আমাদের। আমরা নিজেদের হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভাগ্য গড়ে নেব।
বৈশ্বিক আসর মানেই যে প্রচণ্ড চাপ, এটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। এই চাপকে তারুণ্য অগ্রাহ্য করবে, নতুন কিছু করতে চাইবে, এটাই তো তারুণ্যের ধর্ম। যেমনটা ২০০৭ তরুণ বিশ্বকাপে করেছিলেন মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিবরা। বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত সেই ঝাঁঝ ধরে না রেখে, বেছে নিলেন নিরাপদ পথটাকেই। তার কথায়, ‘প্রতিটি ম্যাচ জেতার জন্যই খেলব। কিন্তু আগে থেকেই অনেক আশা করছি, এমনটা যেন না করি।’