× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইস্ট এন্ডের ‘অন্তিম দশা’

রুবেল রেহান

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩২ এএম

আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৯ পিএম

ধুপখোলা মাঠের পাশেই ইস্ট এন্ড ক্লাবের ভবন। কিন্তু নিজেদের অবস্থান হারিয়ে ধুকছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। ছবি : আ. ই. আলীম

ধুপখোলা মাঠের পাশেই ইস্ট এন্ড ক্লাবের ভবন। কিন্তু নিজেদের অবস্থান হারিয়ে ধুকছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। ছবি : আ. ই. আলীম

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের শতবর্ষী ক্লাবগুলোর সোনালি অতীত হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার দায়ও অনুভব করেনি কেউ। শতবর্ষী ক্লাবগুলোকে নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ তৃতীয় পর্ব। 

রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় প্রায় সাড়ে সাত একর জমির ওপর ধূপখোলা মাঠ। এক সময় মাঠটির ছিল তিনটা অংশ। এক অংশ বরাদ্দ ছিল জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) জন্য। একটি অংশ সাধারণ মানুষের এবং অন্যটিতে খেলতেন ইস্ট এন্ড ক্লাবের খেলোয়াড়রা। কয়েক বছর আগে সব একত্রে নিয়ে আসে সিটি করপোরেশন। মাঠে নিজেদের অবস্থান হারিয়ে এখন ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। যদিও খেলাধুলায় পিছিয়ে পড়েছে আরও আগেই। ধারণা করা হয়, এই মাঠকে কেন্দ্র করেই ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় ইস্ট এন্ড ক্লাব। এখন কেবল মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় একটি ভবন রয়েছে ক্লাবের। তার পাশেই ক্লাবের বাস্কেটবল কোর্ট।

ঢাকার ফুটবলে তখন আবাহনী, মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, বিজেএমসি ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো বাঘা বাঘা দল। তাদের সঙ্গে বড় নাম হয়ে আবির্ভাব ঘটে ইস্ট এন্ডের। এই দলগুলোর সঙ্গে ইস্ট এন্ডের খেলা পড়লেই দর্শকের ঢল নামত মাঠে।

গত ২৮ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, শতবর্ষী ক্লাবটির ভবন ঠিকই আছে, তবে কার্যক্রম নেই। তালা ঝোলানো ভবনের ভেতরের রুমগুলোও শূন্য। ওই এলাকায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর মোতালেব আহমেদ জয় নামে ক্লাবের একজন সদস্যকে পাওয়া গেল। তিনিই নিয়ে গেলেন ক্লাবের অস্থায়ী ভবনে। মাঠের উত্তর পাশের ডিএনসিসি ভবনের দোতলায় আপাতত ক্লাবের কার্যক্রম চলছে বলে জানান মোতালেব। রুমে ঢুকতেই পাওয়া গেল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাসান আশকারিসহ বর্তমান কোচ শাহাদাত হোসেন এবং ক্লাবের আজীবন সদস্য ও সাবেক খেলোয়াড় আতাউর রহমান খান আতাকে। আসন্ন মৌসুমে দল গোছাতে ব্যস্ত সবাই। 

ঢাকার মাঠে ইস্ট এন্ড দলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বাম পাশে (দ্বিতীয় জন) দলের অধিনায়ক সাইদুর রহমান প্যাটেল। ছবি : সাইদুর রহমান প্যাটেলের সৌজন্যে

রুমেই বসেছিলেন পঞ্চগড় এবং ফরিদপুর থেকে আসা দুজন তরুণ ফুটবলার। যাদের সঙ্গে খানিক আগেই চুক্তি সম্পন্ন করে ইস্ট এন্ড ক্লাব। তালিকা থেকে জানা গেল ১২ জন খেলোয়াড়কে তখন পর্যন্ত নিবন্ধন করেছে ক্লাবটি। ২৮ জনের দল গঠনের প্রস্তুতি চলছে। ঘরোয়া ফুটবলের প্রথম শ্রেণির লিগে অংশ নেবে ইস্ট এন্ড ক্লাব। পরে সাধারণ সম্পাদক হাসান আশকারি জানালেন, এভাবে কার্যক্রম চালাতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। ক্লাবে এখনও বসতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। কবে নাগাদ ক্লাবে বসতে পারবেন সেটিও জানা নেই। কিন্তু এমন অবস্থায় খেলোয়াড়দের কোথায় রাখা হবে জানতে চাইলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, শিগগিরই তারা ক্লাব ফিরে পাবেন। নয়তো ভাড়া করা হোটেলেই খেলোয়াড়দের রাখা হবে।

শাহাদাত হোসেন অনেকটা ভালোবাসা আর মায়ার টানেই কাঁধে নিয়েছেন ইস্ট এন্ড ক্লাবের কোচিংয়ের দায়িত্ব। দূর-দূরান্ত থেকে খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজটা তিনিই করেন। ক্লাবের সঙ্গে আত্মীক সম্পর্কের টানে সময় পেলেই ছুটে আসেন সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার আতাউর রহমান খান আতা। এই দলের হয়ে ক্রিকেট খেলা আতাউর রহমান রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস অ্যান্ড সোসাইটি, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেললেও তার প্রথম ক্লাব ছিল ইস্ট এন্ড।

ক্রীড়াঙ্গনের বাইরের লোকজন ঠাঁই নেয় ক্লাবে। ধীরে ধীরে পতন হয় ক্লাবের। এ নিয়ে অনেক আক্ষেপ করলেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। বললেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‍যুগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমার ক্লাবে ঠাঁই হয়নি। 

ইস্ট এন্ড ক্লাব একটা সময় ছিল তারকাদের মেলা। দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালের বাবা ইকবাল খানও খেলেছেন এই ক্লাবের হয়ে। তার সঙ্গে আশির দশকে খেলেছেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই সংগঠক এখন ক্যানসারে আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে আছেন তিনি। যোগাযোগ করা হলে গত ২৯ মার্চ সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোবাইল ফোনে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে জানিয়েছেন অনেক গল্পই। সেসবের কিছুটা তার মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘১৯৭৫ সালে ইস্ট এন্ডের কর্মকর্তারা (খালেক স্যার) আমাকে একদিন ডেকে বললেন, তোমাকে ক্লাবের হয়ে খেলতে হবে। তুমিই ফুটবল দলের অধিনায়ক থাকবা। এরপর দায়িত্ব নিয়ে আমি দল গঠন করলাম। সান্টুর (শহিদুর রহমান চৌধুরী সান্টু) মতো গোলরক্ষক শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার মধ্যেই অন্যতম সেরা গোলকিপার তখন সান্টু। তাকে দলে নিলাম। যদিও তাকে নেওয়াটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কেননা তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের প্রধান গোলরক্ষক ছিলেন। এরপর তার সঙ্গে কথা বলে তাকে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি সেটা মেনে নিলেন।’

এ ছাড়া ১৯৭৫ সালে ইস্ট এন্ড দলে নেওয়া হয় মোকসেদ আলী, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা আফজাল, আলী ইমাম, গফুর (স্কুটার গফুর নামে বেশি পরিচিত), আবাহনীর জামিল, মঈনদের। দলের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন আলীম। যাকে রহমতগঞ্জ থেকে দলে ভেড়ায় ইস্ট এন্ড। ওই সময়ের সাড়া জাগানো ফুটবলার ইদ্রিস, হোসেন, পিয়ার আলী, ইকবাল খানদের নিয়ে গেন্ডারিয়ার এই ক্লাবটির দল গড়া হয়।

ঢাকার মাঠে ইস্ট এন্ড দলের দুর্লভ ছবি। সাইদুর রহমান প্যাটেলের সৌজন্যে

দুর্দান্ত দল গড়ে মাঠের লড়াইয়ে নামে ইস্ট এন্ড। ঢাকার ফুটবলে তখন আবাহনী, মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, বিজেএমসি ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো বাঘা বাঘা দল। তাদের সঙ্গে বড় নাম হয়ে আবির্ভাব ঘটে ইস্ট এন্ডের। এই দলগুলোর সঙ্গে ইস্ট এন্ডের খেলা পড়লেই দর্শকের ঢল নামত মাঠে। ১৯৭৫ সালে লিগের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপরাজিত ছিল ব্রাদার্স। তাদের বিপক্ষে লিগে দেখা হয় ইস্ট এন্ডের। সেই ম্যাচের গল্প বলেছেন তখনকার ইস্ট এন্ড দলের রাইট উইঙ্গার সাইদুর রহমান প্যাটেল, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ব্রাদার্স তো তুখোড় টিম। তাদের বিপক্ষে প্রথমার্ধে আমরা গোলশূন্য ড্র করি। পরের অর্ধে ইকবাল দুইটা গোল করল। গোল করার পর আমাদের সঙ্গে ইকবাল মজা করে বলল- আমি তো গোল করি কিন্তু প্যাটেল ভাই (সাইদুর রহমান প্যাটেল) আমার সামনে বলকে রসগোল্লা বানিয়ে দেয়। এরপর আমরা ম্যাচটা ২-০ গোলে জিতলাম।’

ম্যাচ শেষে ওদের (ব্রাদার্স) কান্নাকাটি দশা। তখন ব্রাদার্সের কোচ ছিলেন পাকিস্তানের গফুর বেলুচ। তিনি আমাদের ডেকে বললেনÑ আজকে কার কার ম্যাচ হয়েছে বলো? তারপর উনিই বললেন আজকে প্যাটেল-আলী ইমাম বনাম ব্রাদার্সের খেলা হয়েছে। এটা শুনে আমি তো অবাক। সত্যি বলতে আমি আমার জীবনের সেরা ম্যাচটাই সেদিন খেলেছিলাম। ওই মৌসুমে দুর্দান্ত দল গড়ে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। তাদের বিপক্ষেও জেতে ইস্ট এন্ড। পরের ম্যাচেই ইস্ট এন্ডের কাছে ধরাশায়ী হয় রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস এন্ড সোসাইটি। ওই বছরের ৮ আগস্ট ইস্ট এন্ডের প্রতিপক্ষ ঢাকা মোহামেডান। সাদা-কালোরা লিগ চ্যাম্পিয়নের পথে। ওই ম্যাচ নিয়ে সাইদুর রহমানের ভাষ্য- ‘সেদিন বৃষ্টি ছিল, তাই মাঠ ছিল ভেজা। খেলায় প্রথমার্ধে কোনো গোল হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা ‍দুই গোল দিয়ে দিলাম। খেলার ১০ মিনিট বাকি থাকতে ওরা ম্যাচে মারামারি লাগিয়ে দিল। এরপর আরও কিছু ঘটনা ঘটে সেগুলো না-ই বললাম। পরে খেলা শুরু হলো। আমরা এক গোল হজম করি। তবে ম্যাচটা ২-১ ব্যবধানে জিতি। পরের দিন একটা পত্রিকায় হেডিং হলো এভাবে- ‘ইস্ট এন্ড ক্লাব লিগ বিজয়ের পথে’। 

বাকি গল্পটা বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি করুণ অধ্যায় হয়ে আছে। সাইদুর রহমান প্যাটেলের ভাষায়, এখানে একটা ট্র্যাজেডি আছে। আমি আড়ালে চলে গেলাম। ক্লাবে রাত ২টা-৩টার সময় কারা যেন হানা দেয়। অনেক খেলোয়াড় ভয়ে পালাল। পরে আমি জেলে (শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে) গেলাম। ছয় বছর আমি না থাকায় ক্লাবে ধস নামল।’

পাশাপাশি ইস্ট এন্ড ক্লাব ও ধুপখোলা মাঠ। ছবি : আ. ই. আলীম 

ক্রীড়াঙ্গনের বাইরের লোকজন ঠাঁই নেয় ক্লাবে। ধীরে ধীরে পতন হয় ক্লাবের। এ নিয়ে অনেক আক্ষেপ করলেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। বললেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‍যুগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমার ক্লাবে ঠাঁই হয়নি। 

নিজের কর্মজীবনে ব্যস্ততা আর ক্লাবের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য আর কখনও ইস্ট এন্ড ক্লাবে আসেননি সাইদুর রহমান। সেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ কতদিন চলেছিল সেটি জানা যায়নি। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছে সেখান থেকে উঠে আসুক ইস্ট এন্ড ক্লাব, ক্রীড়াঙ্গনে আবার তাদের জয়ধ্বনি হোক- সেই চাওয়াটা যেমন সাইদুর রহমানসহ বর্তমান কমিটির, তেমনি ক্রীড়াপ্রেমীদেরও।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা