রুবেল রেহান
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ০২:১৬ এএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪ ০২:৩৬ এএম
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। ছবি : আ. ই. আলীম
২০১৬ সালে গুয়াহাটির ভোগেশ্বরী ফুকনানি ইনডোরে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। পদক নেয়ার সময় পতাকার দিকে তাকিয়ে মাবিয়ার সেই অশ্রু কাঁদিয়েছিল পুরো দেশকে। এরপর নেপালেও বাংলাদেশকে টানা স্বর্ণ এনে দেন মাদারীপুরের এই কীর্তিমান অ্যাথলেট। অলিম্পিকের মঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হয়নি। যেটা তার জীবনে বড় ক্ষত হয়ে আছে বলেই জানালেন তিনি। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আরও অনেক কিছু। ভারোত্তোলক মাবিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুবেল রেহান।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: বর্তমানে কি নিয়ে ব্যস্ততা?
মাবিয়া আক্তার: বর্তমানে আমি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত আছি। নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যস্ত বলতে পারেন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: আপনার নতুন করে প্রমাণের কি আছে?
মাবিয়া আক্তার: এই জন্যই আছে যে আপনারা ভুলে গেছেন আমার অর্জন, আমার কারণে আপনাদের পরিচিতি, আমার কারণেই নতুন জেনারেশন আসা। এখানে আমার কারণে স্পন্সর আসা। এটা ভুলে গেছেন। আবার প্রমাণ করতে যাচ্ছি। আবার যদি কিছু সাফল্য আনতে পারি, এবার নিজের জন্য সাফল্য আনবো। এতদিন তো ডিসিপ্লিনের জন্য সাফল্য এনেছি।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: আপনি অনেক রেকর্ড গড়েছেন। রেকর্ড আপনার পেছনে ছুটত নাকি আপনি রেকর্ডের পেছনে?
মাবিয়া আক্তার: দুইটাই, কারণ আমি না ছুটলে আমার পারফরম্যান্স বেটার হবে না। রেকর্ড আসে, হয়ত আমার নামের পাশে থাকলে রেকর্ডেরও ভালো লাগে (হাসি), হয়ত মানুষেরও ভালো লাগে। আমি রেকর্ডের পেছনে ছুটি, পদকের পেছনে ছুটি এবং যদি বলেন খ্যাতির জন্যও ছুটি। এই তিনটির পেছনে ছুটতে আমার ভালো লাগে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: সাফল্যে মোড়ানো ক্যারিয়ারে কোন অসন্তুষ্টি আছে? বা ক্যারিয়ার শেষে এমন কোন অর্জনটা পেতে চাইবেন?
মাবিয়া আক্তার: আমি যে অসন্তুষ্ট ক্যারিয়ার নিয়ে তা কিন্তু নয়। যেখানে ছিলাম, ২০১৬ সালের আগে যেই মাবিয়াকে চিনতেন না, যেই পরিবেশের মাবিয়াকে চিনতেন না, আলহামদুলিল্লাহ ওই পরিবেশ থেকে উঠে এসেছি। আপনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তাতে আমি সত্যি সন্তুষ্ট। তবে হ্যা ক্যারিয়ার শেষে যে লক্ষ্যটা ধরে রেখেছিলাম, বাংলাদেশ ওয়েটলিফটিং চিনবে আমার দ্বারা। আগে আমাকে বলা হতো আমি লোহা উঠাই, কিন্তু এখন ওয়েটলিফটিং বললেই সবাই চেনে। এটা পূরণ হয়েছে। এখন চাইবো ওয়েটলিফটিংয়ের তালিকায় সবার ওপরে যেন আমার নাম থাকে। আর থার্ড সাফের পর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আসবে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: যেহেতু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটা টানলেন, আরেকটু খোলাসা করেন…
মাবিয়া আক্তার: পরিবর্তন বলতে ফ্যামিলি নিয়ে ভাববো, নিজের ফ্যামিলি। মানে বাবা মা বাদে। ব্যক্তিগত জীবনে যেহেতু একা আছি, তাই সঙ্গী হিসেবে কাউকে নেব। হতে পারে এই নভেম্বরেই বিয়েটা করে ফেলবো। আসতে পারি কোচিং লাইফে। অবসরেও চলে যেতে পারি।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: অবসরের পর কি করবেন, ভেবেছেন কিছু?
মাবিয়া আক্তার: সেভাবে এখনও ভাবিনি। তবে কোচিংয়ে আসতে পারি। আবার এই জায়গাটা একদম ছেড়েও দিতে পারি।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: একদম ছেড়ে দেওয়ার কথা আসছে কেন
মাবিয়া আক্তার: আসবে না কেন? দেখেন এত বছর ওয়েটলিফটিংয়ে থাকার পর যখন আমাকে শুনতে হয় আমার ডিগ্রি কি, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি। এটা শোনার চেয়ে বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে। যখন আমার থেকে গোল্ড মেডেলগুলো নেওয়া হচ্ছিল তখন এই প্রশ্ন আসেনি যে আমার তো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তবে এখন কেন? আমাকে কোচিংয়ের জায়গা দিতে গিয়ে, অফিসিয়ালসের জায়গা দিতে গিয়ে কেন এসব শোনানো হচ্ছে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: এসব কথা কারা বলে?
মাবিয়া আক্তার: আমাদের সঙ্গে যারা থাকেন। মানে আমার আশে-পাশে যারা থাকেন তাদের কাছ থেকেই শুনি। যাদের সঙ্গে ১৪ বছর কাটিয়েছি তারা আমাকের এখন প্রশ্ন তোলে আমার ডিগ্রি কি। আমি মাঝখানে কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে কয়েকজন খেলোয়াড়কে ট্রেনিং করিয়েছি। এর মধ্যে দুইজন ন্যাশনাল রেকর্ডহোল্ডার। সেই সময় আমাকে এমনও কিছু কথা শুনতে হয়েছে যে ওর কোচগিরি ছুটাই দেবো, ও তো নন ডিগ্রি, ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা কি ও কোচ হবে। হয়ত এই শব্দগুলোর কারণে আমাকে আর এই অঙ্গনে দেখবেন না।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা বললেন, সামাজিক কিংবা ধর্মীয়ভাবে এখনও এদেশের মানুষ মেয়েদের স্পোর্টস ফিল্ডে দেখে অভ্যস্ত না, এটা নিয়ে কি বলবেন?
মাবিয়া আক্তার: স্পোর্টসের ফিল্ডটা এখনও মেয়েদের জন্য সিকিউর না। এটা শুনলে অনেকেই বলবে মেয়েরা কি আসছে না, আসছে তো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মেয়েরা এসে কি খুব সুস্থ পরিবেশ পাচ্ছে? আমি বলব যেহেতু স্পোর্টসে আসলে ডিফেন্সে একটা চাকরি পাওয়া যায়। এখানে স্পোর্টসে একটা কোটা আছে। হয়ত এ কারণে আসে। কিন্তু এখনও মেয়েরা হ্যারাজমেনট হয়, মান সম্মানের ভয়ে অনেকেই প্রকাশ করে না।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: এখানে দুইটা দিক দেখা যায়। যারা এসে সাফল্য পেয়ে গেছে তারা আর প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হচ্ছেন না। আবার একই খেলাতে যারা নতুন, সাফল্যের জন্য লড়াই করছে, তাদেরকে তীর্যক মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে…
মাবিয়া আক্তার: না না এটা মোটেও বদলায়নি। আগের চেয়ে আরও বেশি করে হচ্ছে। আমি কিন্তু আমার মামার হাত ধরে খেলায় আসছি। তার মানে এই নয় যে আমার সব আত্মীয়-স্বজনরা এটা ভালোভাবে নিয়েছে। এমনও শুনতে হয়েছে, আমার জন্য আমার মামা কখনোই বেহেস্ত পাবে না। এই ভাষাও আমাকে শুনতে হয়েছে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: এতকিছুর পরও পেশা বা ক্যারিয়ার হিসেবে ভারত্তোলনকে মেয়েদের কী বেছে নেওয়া উচিত?
মাবিয়া আক্তার: অবশ্যই নেওয়া উচিত। যারা নিতে সাহস পায় না আমি তাদেরকে বলব তারা ভয় পায়। বা তারা নিজেদেরকে কেবল নারী মনে করে। দুর্বল মনে করে। আমি মেয়ে, আপনি সব কিছু অর্জন করতে পারি। এই চিন্তাধারা নিয়ে আসলে মনে হয় ক্যারিয়ার এমনিতেই দাঁড়াবে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: আপনি তো কাউকে অনুসরণ করেন না, আপনিই বলেছেন। কিন্তু আপনাকে তো অনেকে অনুসরণ করে…
মাবিয়া আক্তার: একটা সাক্ষাৎকারে ওটা বলার পরে আমার সিনিয়ররা অনেকেই কথাটা অন্যভাবে নিয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে আমার সিনিয়রদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা অনেক বাজে। তারা আমাকে দেখতেই দেয়নি কোনো দিন। তাদের যখন ট্রেনিং করত আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, ভেতরে আসতে পারতাম না। তাইলে আমি আমি সিনিয়রদের কি করে মানব, তাদের কি করে অনুসরণ করব। কিন্তু আমার জুনিয়র যারা তাদেরকে আমার প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দিয়েছি ট্রেনিং করতে। আমি খারাপ প্ল্যাটফর্ম, খারাপ রডটা বেছে নেই, যেন তারা ভালো জায়গায় ট্রেনিং করতে পারে। এ জন্য তারা আমাকে অনুসরণ করে, তাদেরকে আমি কিছু শেখাতে চাই, তাদের ভালোটা চাই।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: স্বপ্ন কিংবা আশা বাঁচিয়ে রাখেন কীভাবে?
মাবিয়া আক্তার: ওইযে বললাম আমার… আসলে জানেন একবার সাফল্য পেয়ে গেলে সেটা ধরে রাখতে হলে নিজেকেই চ্যালেঞ্জ করতে হয়। আমি এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি না। আমি নিজেকে বিশ্বাস করি। আমার কাছে… স্বপ্ন বা আশা বাঁচিতে রাখি এটা ভেবে যে, আমি আমিই।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন কী তবে আক্ষেপ হয়েই থাকলো?
মাবিয়া আক্তার: এটা তিক্ততার জায়গা। এই জন্যই যে, জীবনে তিন তিনবার অলিম্পিকের জায়গা থেকে চলে এসছি। কোন কারণে আসছি, কেন আমি যেতে পারি নাই, এগুলির সঠিক ব্যাখ্যা এখনও আমি পাই নাই। আমার যদি ভুল থাকতো আমি মেনে নিতাম আমার ব্যর্থতা। অলিম্পিক পারপাস নিয়ে এখন আমি আর কথা বলি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাই। এটা নিয়ে আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেই এই ভেবে যে জীবনে সবকিছু পেয়ে যাই তাহলে আফসোস করব কীভাবে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: এতকিছু সামলে পরিবারকে সময় দেন কীভাবে?
মাবিয়া আক্তার: এই প্রশ্নটা আমাকে না করে আমার পরিবারকে করলে সঠিক উত্তর পেতেন। আমার বাবা বলত যে আমার একটা মেয়ে আছে আমি তো জানিই না। আমার বোন বলতেন যে…. আমারে বোনের সঙ্গে আমি একসঙ্গে কতদিন যে ভাত খাই না, সেটি আমি জানি না। আমি বলতে পারব না, আমার খারাপ লাগে। কারণ আমি ওদেরকে সময়ই দিতে পারিনা। কারণ আমাকে এখনও যদি ফোন করে বলা হয় ট্রেনিং এই টাইমে… আমি সব ফেলে চলে আসি। কদিন আগি কমনওয়েলথ গেমসের অনুশীলনের জন্য আমি আমার ভাইয়ের বিয়েতেও সেভাবে থাকতে পারিনি। কারণ আমার সময়টা সব ওয়েটলিফটিংকে দিয়েছি।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: ঝুলিতে কতগুলো পদক আছে, গুনেছেন কখনও?
মাবিয়া আক্তার: না গোনা নেই। তবে আজ থেকে দশ বছর পরে গুনবো। এখন যদি গুনতে যাই তবে মনে হবে আমি অনেক পদকব পেয়েছি। এমনটা হলে আর পদক পাওয়া হবে না। জাতীয় পদক, কিংবা সার্ভিস খেলে কয়টা পদক পাইছি, কতগুলো রেকর্ড হইছে, সেসব আমি কিছুই জানি না। খেলা ছাড়ার পর গুনবো। তবে গোল্ড মেডেল কয়টা পাইছি সেটা মনে আছে।