প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪১ এএম
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪৪ এএম
বিশ্বমঞ্চ মানেই হট ফেভারিট দক্ষিণ আফ্রিকা। সেটা ক্রিকেটের যেকোনো সংস্করণেই। এবার ভারতের মাটিতেও শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে এগিয়ে ছিল প্রোটিয়ারা। তা তো হওয়ার কথা। কেননা বৈশ্বিক আসর শুরুর আগে নিজেদের ঘরের মাঠে বেশ দাপটের সঙ্গেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে জিতে পা রেখেছিল ভারতে। অজিদের ধরাশায়ী করেছিল তারা চারশ ও তিনশ ছাড়ানো ইনিংস খেলে। ক্রিকেট মহাযজ্ঞের লিগ পর্বেও মেলে তাদের সেই বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের ঘ্রাণ।
সেসব তো হতেই পারে। কারণ সেটা তো ছিল দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। বহুজাতিক আসর তো ছিল না। প্রতিযোগিতামূলক আসর এলেই তারা জ্বলে ওঠে। আর শেষ প্রান্তে এসে যায় ধসে। কখনও নিজেদের পারফরম্যান্সের কারণে। কখনওবা নিজেদের ভুল হিসাবনিকাশে। তাই বৈশ্বিক ট্রফি আর দক্ষিণ আফ্রিকার দূরত্ব যেন কখনও দূর হবার নয়! এ কারণেই ক্রিকেট দুনিয়ায় একটা কথা প্রচলিত হয়ে গেছে, বিশ্বকাপ না জেতা সেরা দল আর কেউ নয়- দক্ষিণ আফ্রিকা। কথাটা আরও একবার প্রমাণিত হলো এবারের বিশ্বকাপে।
ওয়ানডের সবচেয়ে মর্যাদাকর আসরে প্রোটিয়াদের পথ চলা শুরু ১৯৯২ সালে। প্রথমবার ৫০ ওভারের বিশ্বমঞ্চে খেলেই কাটে তারা সেমির টিকিট। পরে আরও সাতবার নকআউটে নাম লেখায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যটা দূর করতে পারেনি। এ কারণে নিজেদের নামও লিখতে পারেনি ফাইনালে। কিন্তু বড় মঞ্চে টানা ব্যর্থতায় প্রোটিয়াদের গায়ে লেপ্টে গেছে চোকার্স দুর্নাম। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত তকমা দূর করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল এবার। এবার বিশ্বকাপের নকআউটে খেলল তারা অষ্টমবারের মতো। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জে ফের ব্যর্থতার গল্প লিখল দক্ষিণ আফ্রিকা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ইডেন গার্ডেনসেও প্রোটিয়ারা নিজেদের পুরোনো কাহিনীটাই পুনর্মঞ্চস্থ করল। লাগাতার ব্যর্থতার কারণে চোকার্স বদনাম ঘোচানোর অপেক্ষাটা বরং আরও বেড়ে গেল টেম্বা বাভুমাদের। ওয়ানডে বিশ্বকাপের বিচারে অপেক্ষা বেড়ে দাঁড়াল আরও চার বছরে। আর টি-টোয়েন্টির বিচারে দুর্ভাগ্য দূর করার সুযোগটা পাবে তারা আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসরে। অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলে মধুর প্রতিশোধ তো নেওয়াই হতো। সঙ্গে ইতিহাস গড়তে পারতেন টেম্বা বাভুমারা। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। উল্টো ক্রিকেট অনুরাগীরা প্রত্যক্ষ করলেন আরেকটি প্রোটিয়া স্বপ্নের অপমৃত্যু। যদিও এবার প্রোটিয়াদের ফাইনালে দেখেছিলেন অনেকে।
এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার মিশন শুরু হয়েছে রঙিন এক জয়ে। শ্রীলঙ্কাকে তারা হারিয়ে দিয়েছিল ১০২ রানে। যে ম্যাচে প্রোটিয়ারা গড়েছিল ৪২৮ রানের হিমালয়সম স্কোর। শেষ চার পর্যন্ত এটাই ভারত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড। মাঝে অবশ্য চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে কুইন্টন ডি ককদের। ৪২৮, ৩৯৯, ৩৮২, ৩৫৭ ও ৩১১ রানের মতো বিশাল বিশাল সংগ্রহের যেমন দেখা পেয়েছে তারা; ঠিক তেমনি ২০৭ ও ৮৩ রানে গুটিয়ে গিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করে অঘটনের জন্মও দিয়েছে পুচকে নেদারল্যান্ডস আর অপ্রতিরোধ্য ফাইনালিস্ট ভারতের কাছে। বিশ্বকাপের লিগ পর্বে শুরুতে ব্যাটিং নিয়ে প্রতিবারই রানের পাহাড় গড়েছে প্রোটিয়ারা। কিন্তু লক্ষ্য তাড়ায় নেমে বিধ্বস্ত হয়েছে তারা ডাচ ও ভারতীয়দের সামনে।
বৈশ্বিক আসরের নট আউট পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ভাগ্যের শুরু ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে। ওইবার বৃষ্টি আইনে ১ বলে ২২ রানের লক্ষ্য আগলে দাঁড়িয়েছিল প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ যাত্রার সামনে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে তাদের অভিযাত্রা থমকে যায় কোয়ার্টার ফাইনালেই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিতে অজিদের কাছে কুপোকাত হয়ে চোকার্স দুর্নামটা পুরোপুরি নিজেদের ‘সম্পত্তি’ বানিয়ে ফেলে আফ্রিকার দেশটি। মাঝে ২০০৩ বিশ্বকাপে দেশের মাটিতেও ফের বৃষ্টি আইনে কপাল পুড়ে প্রোটিয়াদের। সবশেষ ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ড ও ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে আটকে যাওয়ায় বিশ্বকাপে নিজেদের গল্পটা আর বদলানো সম্ভব হয়নি তাদের। এর আগে বৈশ্বিক আসরের শেষ চারে দুবারের মোকাবিলায় একবারও অজিদের হারাতে পারেনি প্রোটিয়ারা। গতকাল কলকাতায় তৃতীয়বারের দেখায়ও বাভুমারা বদলা নিতে পারলেন না। লিখতে পারলেন না নতুন ইতিহাস।
পারবেইবা কী করে? দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিংয়ে পুরো বিশ্বকাপে ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু সেই দল কি না সেমিফাইনালে এসে খেই হারিয়ে ফেলল। লিখল ব্যর্থতার গল্প। চারশর অধিক স্কোর যাদের কাছে মামুলি ব্যাপার, সেই দল কি না কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৪৯.৪ ওভারে ধসে গেল মাত্র ২১২ রানে।
এটাও হতো না। যদি না ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যেতেন ডেভিড মিলার। তার সেঞ্চুরির ওপর ভর করেই সম্মানজনক স্কোর পায় টেম্বা বাভুমার দল। নইলে লজ্জায় ডুবতে হতো তাদের। মিলার একা ব্যাট হাতে বুক চিতিয়ে লড়াই করে খেলেন ১০১ রানের দারুণ এক ইনিংস। ১১৬ বলের দুর্দান্ত ইনিংসটি এবারের বিশ্বকাপে তার প্রথম সেঞ্চুরি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের ষষ্ঠ শতককে সাজান ৮ বাউন্ডারি ও ৫ ছক্কায়। দলের ব্যাটারদের ব্যর্থতার মাঝে মশাল হয়ে জ্বলেছেন কেবল তারকা এ ব্যাটার। লড়াইয়ের চেষ্টা করেন হেইনরিখ ক্লাসেনও। কিন্তু দুর্বার ব্যাটিংয়ের আভাস দিয়েও ব্যক্তিগত স্কোরটা বড় করতে পারেননি। তিন রানের জন্য ফিফটির দেখা পাননি ক্লাসেন। ৪৭ রানে ফিরে যান। দুজনের বাইরে দুই অঙ্ক ছুঁয়েছেন কেবল জেরাল্ড কোয়েটজি (১৯), এইডেন মার্করাম (১০) ও কাগিসো রাবাদা (১০)। বাকি ব্যাটাররা ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে শামিল হয়ে। অস্ট্রেলিয়ান বোলিং ঝড়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আটকে থেকে তারা উড়ে যান তাসের ঘরের মতো। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মূল কারিগর তো মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্স। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেডমার্ক হলদে জার্সি গায়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পেস তোপে ঝড় তুলে দুজনেই, উপড়ে দেন প্রোটিয়াদের ছয় উইকেট। বাকি একটি উইকেটও ছাড় দেয়নি অজিরা। বাকি চার উইকেট পকেটবন্দি করে তবেই মাঠে ছাড়েন জশ হ্যাজলউড ও ট্রাভিস হেড মিলে। তাতেই প্রোটিয়াদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়ার পথটা সহজ করে ফেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলরা। ফাইনালে নাম লিখে বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া অসাধারণ ব্যাটিং দৃঢ়তায়।