প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২১ এএম
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৬ এএম
সাকিব আল হাসান
আরও একটি ভরাডুবির বিশ্বকাপ শেষ করে দেশে ফিরেছেন ক্রিকেটাররা। দশ দলের বিশ্বমঞ্চে সেমিতে খেলবে কী! টাইগারদের শেষ আটে থাকা নিয়েই দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা। শেষমেশ শ্রীলঙ্কা আর নেদারল্যান্ডসের হারে সাকিবদের কপালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টিকিট জুটেছে কোনোমতে। লাল-সবুজ প্রতিনিধিদের ব্যর্থতা নিয়ে চলছে এখন কাটাছেঁড়া। দেশের ক্রিকেটারদের জঘন্য পারফরম্যান্সের ময়নাতদন্তে নেমেছিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ। সেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কঙ্কালসার। পাঠকদের জন্য বিস্তারিত তুলে ধরা হলো টাইগারদের ব্যর্থতার কারণ-
ক্যাপ্টেন-কোচদের দ্বন্দ্ব : বিশ্বকাপে এমনিতেই দলের পারফরম্যান্স ভালো হয়নি। ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান ও প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সম্পর্কটা ঠিক ছিল না। কোচ সব সময় চেয়েছেন একাদশ নির্বাচন ও অন্যান্য বিষয়ে নিজের খবরদারি জিইয়ে রাখতে। কড়া হেডমাস্টারের ভূমিকা রেখে যেতে। কিন্তু তাতে নাকি সায় দেননি সাকিব। লাল-সবুজের কাপ্তানও দলের অনেক ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করেছেন। থেকে গেছেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল। কোচ-ক্যাপ্টেনের ‘দ্বন্দ্ব’র কারণে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ আর বোলিং আক্রমণ পাল্টে গেছে বারবার। ঠিক ছিল না কোনো ম্যাচেই, যা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে শুরু থেকে। সাকিবের সঙ্গে নাকি মতবিরোধ ছিল বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডেরও। প্রোটিয়া কোচ তিন পেসার খেলাতে চাইলেও সাকিব সেটা মানতে চাননি। তার ইচ্ছে ছিল স্পিনারদের মাঠে নামাতে। ডোনাল্ডের পরামর্শে সায় ছিল আবার হাথুরুসিংহের। সব মিলিয়ে দলের মধ্যে একটা ভজকট অবস্থা বিরাজ করেছে সব সময়। হাথুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব লেগেছিল দলের বাকি কোচিং স্টাফদের মধ্যেও। শেষ ম্যাচের আগে ‘স্বেচ্ছাচারী’ হাথুরুকে নেটে রেখে বাকি কোচরা অনেক দূরে গিয়ে ক্রিকেটারদের নিয়ে অনুশীলন করান।
চোট সমস্যা : বিশ্বকাপের মূল লড়াই মাঠে গড়ানোর আগে অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে একবার চোট পান সাকিব আল হাসান। নিউজিল্যান্ড ম্যাচ খেলে বাঁ ঊরুতে চোট পান বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। পরে চোট কাটিয়ে অনুশীলন সারলেও ভারত ম্যাচে ছিলেন দর্শক হয়ে। পুরো আসরে ইনজুরি জ্বালিয়ে মেরেছে তাকে। এ কারণে ব্যাটে-বলে এবারের বৈশ্বিক আসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি সাকিব। শেষে শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ৮২ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলার পথে ফের বাঁ হাতের তর্জনীতে চোট পান। তাই তো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের শেষ ম্যাচ না খেলেই দেশে ফেরেন সাকিব। ইনজুরি জ্বালিয়ে মেরেছে তাসকিন আহমেদকেও। আর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে তারকা এ পেসারকে রাখা হয়েছিল বিশ্রামে। পুরোনো কাঁধের চোট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় পেস আক্রমণে তেমন কিছুই করে দেখাতে পারেননি তিনি।
ব্যাটিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা : সবাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশ্বকাপের আগের সিরিজে। অথবা সেটা হতে পারে বিশ্বমঞ্চের ওয়ার্মআপে। কিন্তু বাংলাদেশ হেঁটেছে উল্টোপথে। কোনো ম্যাচেই ব্যাটিং লাইনআপ ঠিক ছিল না। মেহেদি হাসান মিরাজ আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে তো রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। মিরাজ ওপরের দিকে খেললেও তার ব্যাটিং অর্ডার ঠিক ছিল না। আর মাহমুদউল্লাহকে নিচের দিকে খেলানোয় দেশ-বিদেশে কম সমালোচনা হয়নি। থিতু একটা ব্যাটিং অর্ডার না থাকায় ব্যাটিংয়েও ব্যর্থতার মহাকাব্যই লিখেছেন কেবল টাইগাররা। তার সঙ্গে ঠিক ছিল না বোলিং অর্ডারও। নির্বিষ বোলিংই করে গেছেন দেশের বোলাররা। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং হয়েছে যাচ্ছেতাই।
বাজে বোলিং : বল হাতে বাংলাদেশের বোলাররা নিজেদের চেনা রূপটা দেখাতে পারেননি। না পেস বোলিংয়ে না স্পিনে। বোলিংয়ে না ছিল পেস-তোপ, না ছিল ঘূর্ণিজাদু। দুটো ডিপার্টমেন্টেই চরম ব্যর্থ টাইগাররা। এ কারণেই সবচেয়ে বাজে এক বিশ্বকাপ কাটিয়েছে বাংলাদেশ, যা কি না শুধু ভরাডুবিতে পূর্ণ। অথচ বিশ্বকাপের আগে দেশের সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছিলেন তাসকিন আহমেদ-মুস্তাফিজুররা। বিশ্বকাপে গিয়ে সেই পেসাররাই হারিয়ে ফেলেছেন খেই। গতি, সুইং, ইয়র্কার, লাইন-লেন্থ কোথাও ছিল না কোনো আগ্রাসনের ছাপ। নির্বিষ আর ধারহীন বিশৃঙ্খল বোলিংয়ে হারের তেতো স্বাদই হজম করেছে দল।
মিরপুরের উইকেট : সাকিবরা মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলতে অভ্যস্ত। টার্নিং আর লো স্কোরিং উইকেটে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে কুপোকাত করার অবিস্মরণীয় স্মৃতিও নিজেদের জাদুঘরে রেখে দিয়েছেন। আর এ কারণে দেশের বাইরে বিশেষ করে বৈশ্বিক আসরে ব্যাটিং-বোলিংয়ে আর নিজেদের দারুণ পারফরম্যান্সের ছন্দটা ধরে রাখতে পারেননি। এটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবারের বিশ্বকাপেও।
বৃহত্তম কোচিং বহর : বাংলাদেশের কোচিং বহর ছিল সবচেয়ে বড়। স্বাভাবিক কারণে তাদের কাছ থেকে দারুণ কিছুই প্রত্যাশা করেছিলেন ক্রিকেটকর্তারা। সেমির স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেট অনুরাগীরাও। কিন্তু কথায় আছে অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। লাল-সবুজ প্রতিনিধিদের বেলায় সেই কথাই ফলে গেছে। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ বসায় স্থানীয় একজন কোচ নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি। টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট শ্রীধরন শ্রীরামের কোনো পরামর্শই বলতে গেলে কাজে আসেনি। ভারতের কোচ হয়েও উইকেট পড়তে ম্যাচের পর ম্যাচ ভুল করেছেন তিনি। তার পরামর্শ মেতে টস জিতে ব্যাটিং-বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই অনেকবার ভুল করেছে দল। আর প্রধান কোচ হাথুরুসিংহে তো ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত ছিলেন। তার ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে ক্যাপ্টেন সাকিব আর টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন বলতে গেলে তার কাছে একরকম পাত্তাই পাননি।
পরিকল্পনার অভাব : বিশ্বকাপ সামনে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা সাজাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। আসলে দলের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্যহীন ছুটে চলার চড়া মূল্যই দিতে হয়েছে টাইগারদের। দলের সবাই শুধু মুখে বলে গেছেন সেমিফাইনালে খেলতে চাই। শেষ চারে ওঠার জন্য যে রণকৌশল থাকা দরকার ছিল, সেটার অভাব টের পাওয়া গেছে পুরো আসরে। প্রতিপক্ষের ব্যাটার-বোলারদের নিয়ে আলাদাভাবে কোনো কাজই করেননি টাইগাররা। সেরে নেননি পর্যাপ্ত অনুশীলনও। আর ফিটনেসের বিষয়টা না হয় বাদ দেওয়া যাক। মাঠের লড়াইয়ে শারীরিক ভাষায় ক্রিকেটাররা ছিলেন না আক্রমণাত্মক।
তামিম ইস্যু : মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে তো বিশ্বকাপ দলে রাখতেই চাননি নান্নু-বাশাররা। শেষে জায়গা পেয়ে নিজের সামর্থ্য দেখিয়েছেন তারকা এ অলরাউন্ডার। হয়েছেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা স্কোরার। বাদ পড়ে যান তামিম ইকবাল। তাকে নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। দেশসেরা ওপেনারকে দলের বাইরে রাখার কারণে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন সাকিব ও কোচ হাথুরু। সিনিয়রদের ছাড়া তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে বাজে একটা বিশ্বকাপই উপহার দিয়েছেন বাংলার দামাল ছেলেরা।