হেলাল নিরব
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:২৭ পিএম
হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন। বাদ পড়েছিলেন দল থেকেও। শরীরও তখন শুনছিল না মোহাম্মদ শামির কথা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এলো সমালোচনা। পেস বোলিংয়ের ‘ব’টাই নাকি তখনও শিখে উঠতে পারেননি। বিপদ একা আসে না— শামির নামে মামলা ঠুকে দেন তার স্ত্রী হাসিন জাহান। চাপ নিতে পারেননি। ২০১৬ সালের শুরুতে মাসখানেকের মাঝে একবার, দুবার করে তিন-তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালালেন। অবস্থা এমন হলো, শামিকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া হলো। সেই যাত্রায় শামি বেঁচে গেলেন, যখন ফিরলেন তখন বোলিংয়ে এতটা পোক্ত হলেন যে তাকে এখন প্রতিপক্ষের ব্যাটাররা ‘যমদূত’ ভেবেও বসেন।
‘যমদের দূত’ বিশেষণটা মূলত শামির ফিরে আসার গল্প বলে। খুব বেশিদিন আগেরও কথা নয়, বড়জোর মাসখানেকের। এশিয়া কাপে দীর্ঘ চোট কাটিয়ে ফেরেন জাসপ্রিত বুমরাহ, পেস বোলিংয়ে তার সঙ্গী মোহাম্মদ সিরাজ। আগ্রাসন, গতি আর সুইংয়ের রাজত্বে শামি তখন উপেক্ষিত। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি রিকি পন্টিং তো বলেই দেন, ‘এই ভারতের স্কোয়াডে জায়গা পাওয়ার যোগ্য নন শামি।’ টেস্ট বোলার তকমা পাওয়া শামিকে পরিকল্পনায় রাখাই হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের সাবেক পেসার আশিষ নেহরা। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বসা এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসরে নানান জল ঘোলা হলো, শামি ভারতেই থাকলেন। বিশ্বকাপে ফিরবেন কি না সেই নিয়েও ছিল বড় শঙ্কা।
‘বিশ্বকাপে চোট সারতে দেড় বছর লেগেছিল। ওটাই জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার অধ্যায়। অত্যন্ত হতাশাজনক সময় ছিল। যখন আমি খেলায় ফিরি তখন নতুন কিছু সমস্যা আসে। পরিবার পাশে না থাকলে আমি কাটিয়ে উঠতে পারতাম না। তিনবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম’
জমিদার বংশের ছেলে এত সহজে কি আর হাল ছাড়েন। খানদানি একটা ব্যাপার আছে তো! শামি ছুটি পেয়ে উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদের সহেসপুরে চলে আসেন। ছোটবেলার কোচ বদরুদ্দিন সিদ্দিকির কাছে নেন দীক্ষা। শামি এবার ফিরলেন আরও ক্ষুরধার হয়ে। কতটা ধারালো সেটি বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই দেখিয়েছেন। এশিয়া কাপে উপেক্ষিত শামি বিশ্বকাপে প্রথম কয়েকটি ম্যাচেও বেঞ্চ গরম করেছেন। হার্দিক পাণ্ডিয়া থাকায় বুমরাহর সঙ্গে আরেকজন পেসার হিসেবে ভারত খেলিয়ে আসছিল সিরাজকেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে চোট পেয়ে পাণ্ডিয়া বাইরে চলে যাওয়ার পর সুযোগ পান শামি। এরপর থেকে তিন ম্যাচে তার বোলিং ফিগার— নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৪ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট, ইংলিশদের গুঁড়িয়ে দিতে নিয়েছেন ২২ রানে ৪ উইকেট এবং সবশেষ শ্রীলঙ্কাকে লজ্জার রেকর্ড দিতে ১৮ রান খরচায় পুরেছেন ৫ উইকেট। দুটি ফাইফারের ম্যাচে দুটিতেই ম্যাচসেরা। পাণ্ডিয়া ফিরলে শামি কি আবারও কাবাব মে হাড্ডি হবেন?
সেই প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত যাওয়ার আগে শামির ফেরার গল্পটি বরং শুনি। ২০১৫ বিশ্বকাপের মাঝপথে চোটে পড়েন, গুনে গুনে ১৮ মাস লেগেছিল সারতে। বছরখানেক আগে শামি একটা ভিডিওতে শুনিয়েছিলেন সেই দিনের গল্প, ‘বিশ্বকাপে চোট সারতে দেড় বছর লেগেছিল। ওটাই জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার অধ্যায়। অত্যন্ত হতাশাজনক সময় ছিল। যখন আমি খেলায় ফিরি তখন নতুন কিছু সমস্যা আসে। পরিবার পাশে না থাকলে আমি কাটিয়ে উঠতে পারতাম না। তিনবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। পরিবারের কেউ না কেউ দিনের ২৪ ঘণ্টা সঙ্গে থাকত। কঠিন সময়ে পরিবারই আসলে সব।’
শামিকে ‘টর্চার শামি’ নাম দিয়েছেন দীনেশ কার্তিক। ভারতের সাবেক ব্যাটারের এমন নামে ডাকার পেছনে ছিল অনুশীলন। ম্যাচের মতো করে খেলা অনুশীলন কিংবা স্রেফ নেটে বোলিং—শামির আগ্রাসন যেন থামতই না। সেই ‘টর্চার’ শামি নিয়ে আসছেন ম্যাচ অবধি। বিশ্বকাপে মূল দলে ফিরে বাকি বোলারদের স্রেফ দর্শক বানিয়ে তুলে নিচ্ছেন একের পর এক উইকেট। বৈশ্বিক আসরে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটধারীর টর্চারের মুখে প্রতিপক্ষ ব্যটারদের কাঁপাকাঁপি অবস্থাও বটে! শামি অবশ্য মাটিতে পা রাখছেন, সাফল্যের কারণ জানাতে গিয়ে বলেছেন— ‘দারুণ বোলিং করায় কোনো রকেট বিজ্ঞান নয়; ছন্দ, ভালো খাবার, মুক্ত মনে থাকা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের ভালোবাসা।’
‘পাকিস্তানে চলে যাও’ বা ‘দেশদ্রোহীর’ মতো কটাক্ষ শোনা শামি যে জমিদার বংশের ছেলে। এতটুকুতে ভেঙে পড়েন না। গতি আর দুর্দান্ত সব সুইংয়ে নিজেকে এতটা ওপরে নিয়েছেন যে, সেই ‘দেশদ্রোহী’ বলা সমর্থকরাও মেতেছে শামিবন্দনায়। ৩ ম্যাচে ১৪ উইকেট পাওয়া শামিকে কার্তিকের মতো করে যদি ‘টর্চার শামি’ কিংবা ‘যমদূত’ বলে ডাকতে চান, তাহলে ভুল কিছু বিশেষণ হবে না। ডাকতে পারেন।