নেয়ামত উল্লাহ
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩ ১২:২৩ পিএম
তিনি যেদিন ছন্দে, দুনিয়ার সব শিল্পকর্মই যেন তার সব শটের কাছে ছোট হয়ে যায়। মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো বিদগ্ধ গুণিজন বলে ওঠেন- ‘লিটন দাস এখানে মোনালিসা আঁকছেন’। তবে ধারাবাহিকতাটা ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এই বছর তিনেক আগ পর্যন্ত ভুগিয়েছে তাকে। সেই লিটন নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছিলেন গেল বছর। ধারাবাহিকতাটা রপ্ত করেছিলেন আগেই, ২০২২ সালে নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়।
নতুন বছরের শুরুতেই ইংলিশ-পরীক্ষা। সেখানেও যে তার কাছে প্রত্যাশাটা বড় কিছুরই ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখানে তিনি ছিলেন ডাহা ফ্লপ। ওয়ানডে সিরিজে তার নামের পাশে রানের সংখ্যাগুলো ছিল ৭, ০, ০। ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও তথৈবচ লিটনেরই দেখা মিলল। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ১২, এরপর দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে করলেন মোটে ৯ রান। শেষ এক-দেড় বছরের চেনা লিটনের সঙ্গে তো এ রান ছিল বেশ বেমানানই!
লিটনের মতো এমন ছন্নছাড়া নয়, তবে বাংলাদেশের আরেক ‘ম্যাচ উইনার’ মুস্তাফিজুর রহমানকেও তো চেনা ছন্দে দেখা যায়নি এই সিরিজে! ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে পাননি উইকেটের দেখা। এরপর শেষ ওয়ানডে দিয়ে ফিরেছেন উইকেটে। পরের দুটো টি-টোয়েন্টিতেই নিয়েছেন একটি করে উইকেট। তবে সে তিন উইকেটের দুটোই ছিল ম্যাচ ‘ডান অ্যান্ড ডাস্টেড’ হয়ে যাওয়ার পর। ম্যাচে যার প্রভাব সামান্যই।
দুই ম্যাচ উইনারের এমন নিষ্প্রভ থেকে যাওয়াটা তাই টানা জয়ের মধ্যেও খানিকটা দুর্ভাবনাই যেন জোগাচ্ছিল। বিষয়টা লুকাননি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। লিটনের ফর্মটা একটু বেশিই বাজে হওয়ায় কথাটা বললেন তাকে নিয়েই। বললেন, ‘লিটন রান পাচ্ছিল না, একটু দুশ্চিন্তা তো ছিলই।’
সেসব শঙ্কা, সেসব দুশ্চিন্তা আর সব ছন্দহীনতাকে শেষ ম্যাচে যেন লিটন পাঠালেন সীমানার বাইরে। শুরুতে খানিকটা নড়বড়ে ছিলেন, পুরো সিরিজে যেমন ছিলেন, কিংবা পুরো ক্যারিয়ারেই। তবে সময় একটু গড়াতেই দেখা দিলেন চেনা রূপে। স্যাম কারানকে চার মেরে তার শুরু, এরপর একে একে বোলিং প্রান্তে ইংলিশ যাকেই পেয়েছেন সপাটে সীমানাছাড়া করেছেন সবাইকেই।
ভাগ্যের ছোঁয়া ছিল একটু। একবার রান আউট হতে হতে বেঁচে-বর্তে ফিরেছেন। একবার ক্যাচ তুলে দিয়েও পেয়ে গেছেন রক্ষা। ৪১ বলে ছুঁয়েছেন ফিফটি, যা তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির ৫০-ও। ৫৭ বলে ৭৩ রান করে তিনি ফিরছেন যখন, বাংলাদেশের লড়াইয়ের পুঁজি পাওয়ার নিশ্চয়তা মিলে গিয়েছিল তখনই।
এমন ইনিংসের পরও তিনি বড় করে দেখলেন সতীর্থদের অবদানকেই। বললেন, ‘উইকেটটা একটু ট্রিকি ছিল। আমাকে তাই খানিকটা সময় নিতে হচ্ছিল। তবে ওপাশে রনি আর শান্ত যেভাবে ব্যাট করেছে, সেটাই আমার কাঁধ থেকে চাপটা সরিয়ে দিয়েছিল।’
এরপর উইকেটের পেছনেও আলো ছড়িয়েছেন লিটন। তানভীর ইসলামের ঝুলিতে প্রথম টি-টোয়েন্টি উইকেটটা যে জমা পড়ল, তাতে তো তার অবদানও থাকার কথা ৫০ শতাংশ! বুদ্ধিদীপ্ত স্টাম্পিংয়ের শিকার বানান ফিল সল্টকে।
লিটন তার কাজটা করে রেখেছিলেন, পালা ছিল মুস্তাফিজের। তবে ইংলিশরা এরপরও ম্যাচটা বের করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মুস্তাফিজের ওই ওভারটার আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল তেমনই।
ইনিংসের ১৩তম ওভারেই ১০০ ছুঁয়ে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। শেষ সাত ওভারে প্রয়োজনটা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৯ রানে। উইকেটে যখন দুই সেট ব্যাটার মালান আর বাটলার, সীমানার বাইরে যখন আরও ৭ জন, তখন ম্যাচটা বেরিয়ে গেছে আঁচ করে নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
তবে মুস্তাফিজের ভাবনায় অন্য কিছুই যেন ছিল। ১৪তম ওভারের শুরুর ডেলিভারিটা করলেন খানিকটা বাড়তি বাউন্স নিয়ে, মালানের ব্যাট ছুঁয়ে তা গিয়ে জমা লিটনের গ্লাভসে। ইংলিশদের শেষের শুরু সেখানেই।
খানিকটা চাপে পড়েই হয়তো পরের বলেই তেড়েফুঁড়ে রান নিতে গিয়েছিলেন বাটলার। মিরাজের দারুণ এক থ্রো ইতি টেনে দিল তার ইনিংসেরও। ইংল্যান্ড কোচ ম্যাথিউ মট থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান- দুজনই এক বাক্যে মেনে নিলেন, সে ওভারটাই খেলাটার গতিপথ বদলে দিয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত সিরিজটা বহু কারণেই স্মরণীয়। ‘ভয়ডরহীন মানসিকতা’ বাংলাদেশের দেখা যে টি-টোয়েন্টিতে মিলত কালেভদ্রে, সেটা এখন মিলছে নিয়মিতই। নিত্যনতুন পারফর্মারের দেখাও মিলছে। তবে মুদ্রার উল্টোপিঠে লিটন-মুস্তাফিজের ছন্দহীনতা যেন কিছুটা দুশ্চিন্তাই জোগাচ্ছিল। শেষ দিনে এসে চেনা দুই সেনানির দেখা মেলাতে সেটাও আর রইল না। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ভাষায়, ‘২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পথে নতুন শুরু’টাকে দুর্দান্ত না বলে বুঝি আর উপায়ই থাকল না এখন!