এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১০:৩২ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১০:৪২ এএম
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবার সিরিজ জয়ের আনন্দে উদ্বেল তাসকিন আহমেদ ও নাজমুল হোসেন শান্ত। রবিবার মিরপুরে - আ. ই. আলিম
সাকিব শূন্য রানে আউট হতে পুরো স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে নীরবতা! ড্রেসিংরুমেও খানিকটা টেনশন। তখনও ম্যাচ জিততে চাই ২০ বলে ১৮ রান। হাতে জমা ৫ উইকেট। খানিক বাদে জোফরা আর্চারের বলে আফিফ হোসেন বোল্ড। টেনশনের পারদ তখন দ্বিগুণ। হিসাব জানাচ্ছে জিততে শেষ ১২ বলে চাই ১৩ রান। জমে থাকা সেই টেনশনের পাহাড় সরিয়ে জয়োল্লাসের ফুল ফোটাল নাজমুল হোসেন শান্তর ‘ধীরশান্ত’ ব্যাটিং। আর অপর প্রান্তে ব্যাট হাতে তাসকিন তখন ‘ঝড়’ তুললেন; ৩ বলে দুই বাউন্ডারিতে অপরাজিত ৮ রান। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল ৪ উইকেটে। সেই সঙ্গে টি- টোয়েন্টি সিরিজ। দারুণ, দুর্দান্ত, দাপুটে ও ধারাবাহিক সাফল্য! ১১৮ রান তাড়া করতে নেমে শান্ত অপরাজিত থাকলেন ৪৭ বলে ম্যাচজয়ী ৪৬ রানে।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই প্রথম দ্বিপক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলল বাংলাদেশ। আর তাতেই টইটম্বুর সাফল্য। তিন ম্যাচের সিরিজে প্রথম দুটোতে জিতে ট্রফি বাংলাদেশের। ওয়ানডে সিরিজের হারের শোধ নিয়ে হিসাব চুকিয়ে দিল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে জিতে সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। আর মিরপুরে দ্বিতীয় ম্যাচে সিরিজের ট্রফি নিজেদের করে নিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হারিয়ে।
উইকেট যেমনই হোক, মিরপুরে ১১৭ রানে ইংল্যান্ডের গুটিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো অজুহাত নেই। ব্যর্থতা একটাই- বাজে ব্যাটিং। এই উইকেটে বোলারদের কেমনভাবে সামাল দিতে তার কোনো জবাবই খুঁজে পায়নি ইংল্যান্ড।
জয়ের জন্য ১১৮ রানের মামুলি স্কোরের জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটাও খুব একটা ভালো হয়নি। তবে একপ্রান্ত আঁকড়ে নাজমুল হোসেন শান্ত যে ব্যাটিং করলেন সেটাই এই উইকেটে আদর্শ ব্যাটিংয়ের নমুনা। আর ব্যাটিংয়ে প্রমোশন পেয়ে মেহেদি হাসান মিরাজ আরেকবার দেখালেন ব্যাটিংও তার বড় শক্তি। শান্ত-মেহেদির চতুর্থ উইকেটে ৩২ বলে ৪১ রানের জুটি বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ের কাজটা সহজ করে দেয়। দারুণ বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও দক্ষতা দেখিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে নতুন ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ।
ব্যাট হাতে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এই ম্যাচে শূন্য রান করলেন। কিন্তু পুরো ম্যাচে তার নেতৃত্ব এবং চিন্তাশক্তিটা ছিল দারুণ এক মাস্টারস্ট্রোক! একাদশ নির্বাচন। বোলিং বিতরণ। ফিল্ড সেটআপ। সবকিছুতেই অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যে সিদ্ধান্তগুলো নিলেন তা কাজে লাগে প্রায় শতভাগ।
আগের ম্যাচের একাদশ থেকে একটা বদল নিয়ে নামে বাংলাদেশ। ব্যাটার শামীম পাটোয়ারীর বদলে অফস্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ সুযোগ পেলেন। সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, সেই উদাহরণ এই ম্যাচে তৈরি করলেন মিরাজ। ৪ ওভারে ১২ রানে ৪ উইকেট শিকার। টি-টোয়েন্টিতে নিজের ক্যারিয়ারসেরা সাফল্য পেলেন মেহেদি এই ম্যাচে। গোটা ম্যাচে মেহেদি বল হাতে ইংল্যান্ডকে যেন তার ইচ্ছে অনুযায়ী নাচালেন! প্রথম ৩ ওভারে তার বোলিং বিশ্লেষণ ছিল এমন- ৩ ওভার ৭ রান ৩ উইকেট। মেহেদির ৪ ওভারের মধ্যে কোনো অতিরিক্ত রান নেই। কোটার ২৪ বলের মধ্যে তার ১৩ বল থেকে ইংল্যান্ড কোনো রানই নিতে পারেনি! ইংল্যান্ড একাদশে বাঁহাতি ব্যাটারদের আধিক্য দেখে এই ম্যাচে অফস্পিনের ওপর সাকিব জোর দেন। এমনকি অনিয়মিত অফস্পিনার নাজমুল হোসেন শান্ত ও আফিফ হোসেনকেও বোলিং আক্রমণে আনেন।
শক্তিমান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হলে বড় একটা কৌশল হলো এমন কিছু করো যাতে তারা চমকে যায়। ইংল্যান্ডকে সেই চমকই দিল বাংলাদেশ। আটজন বোলারকে ব্যবহার করেন সাকিব এই ম্যাচে। শুরুর ১২ ওভারের মধ্যেই পেসার, অফস্পিন, বাঁহাতি স্পিনার- আক্রমণের ঝুলিতে যত অস্ত্র ছিল সব নিয়ে ঝাঁপালেন সাকিব। পাওয়ার প্লের সময়টায় ইংল্যান্ড যা একটু স্বাছন্দ্যে ছিল। এই সময় ইংল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে জমা হয় ১ উইকেটে ৫১ রান। পরের ১৪ ওভারে মিরপুরের স্পিন উইকেটে ইংল্যান্ড যে ব্যাটিং করল তা এই সিরিজে ‘ইংলিশ দুঃস্মৃতি’ হয়ে থাকবে। শেষের ১৪ ওভারে আর মাত্র ৬৭ রান যোগ করে বাকি ৯ উইকেট হারাল ইংল্যান্ড। ১২০ বলে মাত্র ১১৭ রানেই শেষ ইংল্যান্ডের ইনিংস। এই উইকেটে স্পিন কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেই প্রাথমিক শিক্ষাই যেন ভুলে গেল তারা। স্পিনারদের দাপটের দিনে তিন পেসার তাসকিন, মুস্তাফিজ এবং হাসান মাহমুদও বল হাতে আগুন ঝরালেন। জায়গা বদলে এই ম্যাচে ওপেনার হয়ে নামা ডেভিড মালান পেসার তাসকিনের দুর্দান্ত পেস এবং সঠিক লেন্থের কাছে খেই হারিয়ে বসেন। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানের পর এই ম্যাচেও সিঙ্গেল ডিজিটেই শেষ মালানের ইনিংস।
ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এই ম্যাচে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নামে ইংল্যান্ড। ওয়ান ডাউনে এলেন মঈন আলি। তবে ব্যাট হাতে তাকেও মনে হচ্ছিল সাঁতার না জেনে পানিতে নেমে পড়া বেচারা সাঁতারুর মতো! বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ওপেনার ফিল সল্টকে নিজের প্রথম ওভারেই ফেরান সাকিব ফিরতি ক্যাচ নিয়ে। নিজের প্রথম ওভারে সাফল্যের নজির রাখেন হাসান মাহমুদ এবং মেহেদি হাসান মিরাজও। ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলারকে যে দুর্দান্ত ইয়র্কারে বোল্ড করলেন হাসান মাহমুদ, সেটা যেকোনো পেসারের জন্য ড্রিম ডেলিভারি!
এমন স্পিনট্র্যাকে স্পিনের বিপরীতে শট খেলা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সেই ঝুঁকি নিয়ে মেহেদির বলে ফিরলেন মঈন আলি। খানিক বাদে দুই বলের ব্যবধানে স্যাম কারান ও ক্রিস ওকসকে স্টাম্পড আউট করে মেহেদি মিরাজ বাংলাদেশকে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখান।
ডেথ ওভারের জন্য নিজের ও মুস্তাফিজের ওভার জমা রাখেন সাকিব। শেষের এই সেশনেও ‘পুরো ডেড’ ইংল্যান্ডের ব্যাটিং। শেষ ওভারে বাকি তিন উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড গুটিয়ে গেল মাত্র ১১৭ রানে।
প্রতিপক্ষ যখন ইংল্যান্ড তখন একটা দীর্ঘকালীন দুঃখ ছিল বাংলাদেশের। অনেক দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতা হয়নি। এবারের ওয়ানডে সিরিজের আগেও সেই দুঃখ জানিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। ওয়ানডে সিরিজ বাংলাদেশ জিততে পারেনি। কিন্তু টি- টোয়েন্টিতে জিতে সেই দুঃখ তো কাটিয়ে ওঠা গেল।
এখন সিরিজটা ৩-০ করলে আরেকটি বড় কাণ্ডও সম্পন্ন হয়ে যাবে। মিরপুরে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে সেটা খুবই সম্ভব- সেই আত্মবিশ্বাসও কিন্তু পেয়ে গেছে বাংলাদেশ।
তো হয়ে যাক বাংলাদেশ ৩, ইংল্যান্ড ০! জানেন নিশ্চয়ই ইংল্যান্ড কিন্তু টি-টোয়েন্টির চলতি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!