বাংলায় ধারাভাষ্য
আপন তারিক, বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:২৮ পিএম
নিখিল রঞ্জন দাস (ডানে)
প্রবীণ ধারাভাষ্যকার নিখিল রঞ্জন দাস, থাকেন চট্টগ্রামে। অনেক অপ্রাপ্তি নিয়েও যিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলা ধারাভাষ্য। ২১ ফেব্রুয়ারির বিশেষ আয়োজনে প্রতিদিনের বাংলাদেশে মুখোমুখি হয়ে খুলে দিলেন কথার দুয়ার। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিবেদক আপন তারিক
ঢাকার বাইরে থেকে রেডিওতে কমেন্ট্রি করা কতটা কঠিন?
ঢাকার বাইরে থেকে যখন আমি যাই, তখন যে সম্মানী দেয় সেটার কথা বাদই দিলাম। আমার মনে হয় টিএ-ডিএটা বাড়ানো উচিত। এখন তো ধরুন বাসের ভাড়া বেড়েছে, ট্রেনের ভাড়া বেড়েছে, প্লেনের ভাড়ার কথা বাদই দিলাম। ধরেন যে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, তারা সেখানে থাকে। কিন্তু হোটেলে থাকতে গেলে রেডিও যে টিএ-ডিএ দেয়, সেটা পর্যাপ্ত না। আমি চট্টগ্রামে আছি, এখানে কমেন্ট্রি করি, এখানে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হলো ট্রান্সপোর্ট। এখানে শহর থেকে স্টেডিয়াম আট-দশ কিলোমিটার। আমি উবারে যাই, আসা-যাওয়া মিলে প্রায় হাজার টাকা দিতে হয়। ওনারা আমাকে যে রেমুনারেশন দেয় সেখানেই অর্ধেক চলে যায়। ওনাদের একটা গাড়ি থাকলে ফিক্সড পয়েন্টে পিকআপ আর ড্রপ করলে সুবিধা হতো।
বাংলা ধারাভাষ্যে তাহলে অবজ্ঞা করা হচ্ছে...
রেডিও তবু চেষ্টা করছে। রেডিওকে আমি দোষ দেব না। ওরা চেষ্টা করছে লোকাল ম্যাচ, এবার বিপিএল করল। ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচগুলো তো করেই। কমেন্টেটর হিসেবে যা, তা সেটাই। আমি এখন ঢাকায় যাই না। অনারিয়াম যেটা দেয়, সেটা আমার এক দিনের গাড়িভাড়াই পোষায় না। তবু মাঝেমধ্যে বন্ধুত্বের খাতিরে বা শখের বশে, বাংলা কমেন্ট্রির খাতিরে বলেন আমি যাই। সবার ক্ষেত্রে তো সেটা হয় না। আমি যাই আমার ছেলে আছে, তাদের সঙ্গে থাকি, তাদের গাড়ি ইউজ করি। সবার পক্ষে তো সেটা সম্ভব না। মাগুরা থেকে ছেলেরা আসে, খুলনা থেকে একজন আসে, এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসে। তাদের পক্ষে তো এটাতে সম্ভব না। আমার মনে হয়, এটা বেতারের ভাবা উচিত।
ইংরেজি যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলা কেন পিছিয়ে পড়ল...
এটা হলো, ওনারা লিমিটেড রিসোর্সের মধ্যে দিয়ে চলে, যেটা আমরা শুনেছি। ওনারা যে বাজেটটা পান, ওনারা চেষ্টা করেন বেস্ট ইউটিলাইজ করতে। মন্ত্রণালয়ের এটা দেখা উচিত। আমি একজনকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম- তোমাদের মধ্যে আর স্টার স্পোর্টসে কমেন্ট্রি করে তাদের মধ্যে তফাত এক হাজার টাকা আর এক হাজার ডলার (১ লাখ টাকার বেশি)!
জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সম্মানীটা বাড়ছে না কেন...
আমি মোস্ট সিনিয়র ধারাভাষ্যকার, এ গ্রেডে চার-পাঁচজন বোধ হয় আছে। আমি, আলফাজ, জাফরউল্লাহ শারাফাত; আমরা পাঁচজন আছি এ গ্রেডে। আমরা ম্যাচপ্রতি দেড় হাজার টাকা পাই। চট্টগ্রামেও একই। এর বাইরে যে কনভেন্স বা অন্য যা দেয় সেটা আমরা পাই না। এটা পকেটের। আমি যখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে করি, তখন আমাদের একটা টিএ-ডিএ দেয়। ট্রেনভাড়া, এখন বোধ হয় এসি করেছে। ওয়ান অ্যান্ড হাফ দেয়। ভাড়া বোধ হয় ৮০০-৯০০ টাকা। যার জন্য আমি আজকাল আর ঢাকায় যাই না।
তারপরও মায়া কাটানো হয় না...
আমি অন রেকর্ড ১৯৬৭ থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশনে কাজ করছি। তবে অফিসিয়ালি ১৯৭২ থেকে ধরা যায়। তার আগে পাকিস্তান আমলেও আমি কমেন্ট্রি করেছি। তখন আমি ছিলাম, বদরুল হুদা চৌধুরি, খোদা বক্স মৃধা আমরা নিজেদের মধ্যে একটা আলোচনা করতাম। এখনও আমি, আলফাজ, শামসুল কথাবার্তা বলে নিজেদের মধ্যে একটা চেষ্টা করি। নতুন যারা আসছে, তাদের মধ্যে এই কালচারটা খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। মনে হয় না এই সেন্সে ওরা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতে চায়। আমার কথা হলো, একটু আগে আপনি বললেন রেডিওতে কথা বলব, আমার কথার মধ্য দিয়ে শ্রোতারা ম্যাচটা যেন দেখতে পায়। অডিও ভিজ্যুয়ালে যখন হয়, খেলাটা সে দেখছে। ফাইনাল পয়েন্টস যদি কিছু বলার থাকে তাহলে বলব। না হলে চুপ থাকব। এই ডিফারেন্সটা বুঝতে হবে। এটা আজকাল অনেকেই বোঝে না। টিভিতে যারা কমেন্ট্রি করে গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। আমার দরকারটা কী?
অনুজদের পরামর্শ...
আমি রিচি বেনাউদের একটা ইন্টারভিউতে দেখেছিলাম, চ্যানেল নাইনের ওই ইন্টারভিউতে বলেছিল, তুমি টিভিতেও করো, রেডিওতেও করো এটার মধ্যে পার্থক্য কী? তিনি বলছিলেন- যখন টিভিতে শোনো তখন টিভিতে খেলা দেখো, তখন আমার কাজ শুধু ফাইনাল পয়েন্টসগুলো বলা। এ ছাড়া আমি চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বেতারে বাংলা ধারাভাষ্য কবে থেকে শুরু হয়েছিল?
আমার জানামতে, ১৯৬৩ থেকে শুরু। তখন বদরুল হুদা চৌধুরি, ইঞ্জিনিয়ার নূর হোসেন, সিরাজদ্দৌলা, আমিনুজ্জামান, শাহাজাহান সাহেব করতেন। পরে আব্দুল হামিদ ভাই এলেন। আমি এসেছি ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের একটা ফুটবল ম্যাচে। আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ। ওই ম্যাচে কমেন্টেটর ছিলেন শহীদ প্রকৌশলী নূর হোসেন। উনি আসতে পারেননি, আমি মাঠে গিয়েছিলাম বদরুল হুদা চৌধুরির সঙ্গে। তার সঙ্গে বহুদিনের পরিচয়। তখন আমি পিডিবিতে জব করি। আমি কিছুটা অফিসিয়াল, পাওয়ার সাপ্লাইটা রেডিওটা ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, সেটাও দেখছি। ওনারা জানতেন বদরুল হুদা চৌধুরির সঙ্গে আমি মাঠে আছি। মাঝেমধ্যে স্পোর্টস অ্যানাউন্সমেন্ট করি। বদরু ভাই বললেন, নিখিল এসেছে ওকে আমার পাশে বসিয়ে দাও ও চালিয়ে নিতে পারবে। এটাই শুরু ছিল। আমি কোনো অডিশন দিয়ে বা অন্যভাবে আসি নাই। ওটা করেছি, সবাই পছন্দ করেছে। তারপর বলল, আপনি আসেন, ফরমালি একটা কন্ট্রাক্ট সই করেন। এটাই করলাম। তারপর ১৯৭২ থেকে আমি রেগুলার করে যাচ্ছি। ২০১১ সালে আমি আর আলফাজ পুরো ভারতে বিশ্বকাপ করলাম। আমরা ১১টা ভেন্যু থেকে করেছি।
কার অনুপ্রেরণায় পথচলা...
আমি মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে বলি আমি এদেশের ক্রিকেটকে জন্মাতে দেখেছি। ১৯৫৪-৫৫ সালে দেশভাগের পর যখন ইন্ডিয়া প্রথমবার এলো প্রথম ম্যাচ ছিল চট্টগ্রামে। আমি তখন স্কুলে পড়ি এবং স্কাউট ছিলাম। আমি স্কাউট থেকে মাঠে ডিউটি করেছি। বল বয় হিসেবে। এরপর থেকে স্কুলে, চট্টগ্রাম কলেজে ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তাম, তখন স্পোর্টস অ্যানাউন্সমেন্ট করতাম। নাটক করতাম, এসব করতাম সেখান থেকে স্পোর্টস অ্যানাউন্স করতাম। ১৯৬৩-এর ডিসেম্বর থেকে পাওয়ার বোর্ডে চাকরি করি। আমি চট্টগ্রামে পোস্টিং ছিলাম। বদরু ভাইয়ের সঙ্গে তখন থেকেই আমার লিংক। তখন তো উনি সিনিয়র মোস্ট কমেন্টেটর। বদরু ভাই আমাকে বলেছেন, পরে কিছু কিছু টিপস দিয়েছেন। পরে তৌফিক আজিজ খান বলতেন, এটা বলবে না, ওটা বলবে না। এটা এভাবে দেখো। এটা আমরা সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছি। কোনো ইনস্টিটিউশনাল শিক্ষা ছিল না আমাদের। আমরা একটা জিনিস চেষ্টা করতাম, যেটা আমিও সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনেছি, খেলার মধ্যে থাকার চেষ্টা করো। লোকজন শুধু খেলার জন্যই তোমাকে শুনবে, অন্য কিছুর জন্য না।
শেখার আগ্রহ কম...
আমি বলি, শেখার আগ্রহটা কমে গেছে। এখন এফএম আসছে, কারা এর জন্য উপযুক্ত তা আগে দেখে নেওয়া উচিত। যে কাউকে এনে মাইক্রোফোনের সামনে এনে দিলে তো হবে না। আপনি একটু আগে বললেন, এফএম গাড়িতে শুনছি, ফেসবুকে দেখছি, ইউটিউবে দেখছি সবই তো শোনার মতো না। অনেকে ক্রিকেটের পজিশনগুলো জানে না। অনেকে বলতে পারে না, একটা ড্রাইভ কোথায় যেতে পারে, ফ্লিক কোথায় যেতে পারে। এই জিনিসগুলোর ধারণা তো থাকতে হবে। খেলাটা সম্পর্কে পুরোপুরি নলেজ আমার থাকতে হবে। কিংবা সিনিয়রদের কাছ থেকে আমাদের শুনতে হবে। অনেকেই বলে যে বাদ দিলাম আমি ১১ জন ফিল্ডার, ফিল্ডিংয়ের স্পেসিফিক প্লেস কয়টা আছে কয়জন বলতে পারবে। ফিল্ডিংয়ে স্লিপ, পয়েন্ট, গালি, এক্সট্রা কাভার, কাভার, মিড অন, মিড অফ এগুলো নিয়ে স্পেসিফাইড কয়টা পজিশন আছে।
পেশা হিসেবে কেমন…
এটাকে আমাদের দেশে প্রফেশনালি নেওয়া যাবে না। কারণ, এখানে যে সম্মানী তাতে আমার ফুল টাইম জব হবে না। এটা আমার হতেও পারে না। ইংরেজিতে সম্ভব কারণ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে পাচ্ছে, ভালা সম্মানী পাচ্ছে, আমি আপনাকে বলে দিলাম এক হাজার ডলার আর এক হাজার টাকার পার্থক্য। তাহলে কীভাবে সম্ভব?