স্বপ্নের ভেলায় নারী ফুটবল
রুবেল রেহান
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ২১:১৪ পিএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৫ ১৬:২৮ পিএম
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের একটা সংলাপ- ‘বীজ রোপণের পর মহীরুহ হয়েছে কি না, ডালপালা মেলে ধরেছে কি না সেটি দেখে যাওয়া বড় কথা নয়। বীজ রোপণ করাটাই বড় কথা।’ ঠিক এখানে নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন যারা নারী ফুটবলের শুরুর দিকে স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন। আজ সেই স্বপ্নের বীজটি শাখায়-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে ফুলে-ফলে শোভিত হয়ে ধারণ করেছে মহীরুহ আকার। আমাদের বীরকন্যাদের স্বপ্নযাত্রা দক্ষিণ এশিয়া ছাপিয়ে বিস্তার লাভ করেছে এশিয়ান পর্যায়ে। আর এই গৌরব অর্জনের রূপকার ঋতুপর্ণা চাকমা, মারিয়া মান্দা, তহুরা খাতুন ও আফঈদা খন্দকাররা।
বুধবার এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে মিয়ানমারকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। ‘সি’ গ্রুপ থেকে দিনের পরের ম্যাচে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ড্র করে বাহরাইন। দুই খেলায় ছয় পয়েন্ট নিয়ে মূলপর্বে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। এবারই প্রথম এশিয়ান কাপে খেলবে নারী দল। তবে নারী ফুটবলের এই যাত্রা মোটেও মসৃণ ছিল না। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, লড়াই সংগ্রামের পর আজ এই পর্যায়ে দেশের মেয়েরা। শুরুর দিকে যেখানে নারীদের খেলাটাই মেনে নিত না সমাজ। ২০১০ সালে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলা শুরু মেয়েদের।
বাংলাদেশ নারী ফুটবলের শুরুর দিকে লড়াই করে মাঠে নামাদের মধ্যে অন্যতম জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তার। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের নিয়মিত ফুটবলার ছিলেন ডালিয়া। ২০১৪ সালে ফিফার কোচেস কোর্স করা ডালিয়ার হাতে গড়ে ওঠে বিজেএমসির মেয়েদের ফুটবল দল। তার অধিনায়কত্বে প্রথম করপোরেট লিগের শিরোপাও জিতেছিল বিজেএমসি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডালিয়া জানালেন ঋতুপর্ণাদের এমন সাফল্যে কতটা খুশি তিনি, ‘আলহামদুলিল্লাহ। দলের প্রত্যেক সদস্যকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। এই স্বপ্নটা আমরা শুরু থেকে দেখেছি। ফুটবলের শুরুর দিনগুলো থেকে আমি বলে এসেছি, যে পুরুষ ফুটবল টিমকে একটা জায়গায় নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। কিন্তু মহিলা দলকে যদি ১০-১৫ বছর যদি দলটাকে খুব ভালোভাবে গাইডলাইন করতে পারি, দেখা যাবে এশিয়ান লেভেলে পরাশক্তির দল হয়ে যাবে। এ রকম একটা আশা ব্যক্ত করেছিলাম সেই ২০০৮ সালের দিকে। আলহামদুলিল্লাহ এখন মনে হচ্ছে সেটি দেখতি পাচ্ছি।’
মাত্র ১৫ বছরেই শূন্য থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের মেয়েরা আজ ক্রীড়াঙ্গনে আলো ছড়িয়েছেন। তাই বলা-ই যায় ডালিয়াদের স্বপ্ন আজ বাস্তব। যে কারণে অনুভূতিটাও ভাষায় প্রকাশের মতো নয় বলে জানান ‘কেউ যখন কোনো গাছ লাগায় এরপর সেই গাছ বড় হলে, ফল ধরলে সেটি ওই ব্যক্তির কাছে যেমন সুমিষ্ট লাগে সেটা কেবল সে-ই বুঝতে পারবে। আমার অনুভূতিটাও এই মুহূর্তে ঠিক তেমনই।’
এই স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায় ছিলেন দলের সাবেক অনেক খেলোয়াড়। যারা ভেবেছিলেন এবার না হলে পরেরবার। কিন্তু ২০২২ সালে দেশকে সাফ জিতিয়েও পরেরবার আর এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে খেলা হয়নি বাংলাদেশের। ওই টুর্নামেন্টে দেশের জার্সিতে ৪ গোল করেছিলেন সিরাত জাহান স্বপ্না। পরের বছরই হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দেন এই ফরোয়ার্ড। এশিয়ান কাপে বাংলাদেশকে দেখে অনুভূতি প্রকাশ করেন এভাবে, ‘একজন ফুটবলার হিসেবে এটা বড় একটা আনন্দের খবর। এই দেশের ফুটবলার হিসেবে আমাদের সবার মধ্যে একটা স্বপ্ন থাকে যে আমরা একদিন এশিয়ার মঞ্চে যাব, সেটা যখন বাস্তবায়ন হয় তখন তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না খুশিটা কত বড়। এটা দেখে আমি আনন্দিত এবং খুশি হয়েছি। হয়তো আমি দলে নেই কিন্তু এই মেয়েরা তো আমাদেরই একটা অংশ, তারা আজকে এটা করতে পারছে তো আমি এটা দেখে সত্যি খুব বেশি।’
এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ পুরুষ দল একবারই খেলেছিল, সেটি ১৯৮০ সালে। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। ৪৫ বছর পর সেই একই মঞ্চে বাংলাদেশের মেয়েরা। মেয়েদের এমন সাফল্যে খুশি কিংবদন্তি স্ট্রাইকার, ‘যে উন্নতি হয়েছে মেয়েদের চিন্তার বাইরে। একই সঙ্গে এই দলটাকে এতদিন ধরে রেখেছে যারা শাবাশি দিতে হয় তাদের। টিমটাকে সুন্দর জায়গায় নিয়ে গেছে এজন্য ওদের প্রশংসা করতে হয়। ডায়মানিক লিডারশিপের জন্য এরা এত ভালো খেলছে। তবে আমার একটাই দাবি, এরা অনেকেই গ্রাম থেকে উঠে এসেছে, তাদের ভবিষ্যৎটা যেন নড়বড়ে না হয়ে যায়। কারণ ফুটবলারদের যৌবন চলে গেলে আর কেউ চিনবে না। বিশেষ করে নারী ফুটবলারদের জন্য আমার একটাই দাবি এরা যেন সামাজিকভাবে ভালো একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে।’
নারী দলের সাবেক এবং দুইবারের সাফজয়ী কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ‘এটার জন্য আমার অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম, যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি এখন এশিয়ান অঞ্চলে খেলব। মেয়েরা তো খুব ভালোভাবেই এবং বলব খুব তাড়াতাড়িই এটি করতে পেরেছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন। যেহেতু এই দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ছিলাম সেই দিক থেকে এটা অবশ্যই সুখকর এবং আনন্দের ব্যাপার। নিজেকে তো মনে হয় এই দলেরই একজন সদস্য। কেননা এই দলটার শুরু থেকেই তাদের সঙ্গে ছিলাম। যারা গতকাল (বুধবার) পারফর্ম করল তাদের ছোটবেলা থেকে সঙ্গে ছিলাম আমি। ধারাবাহিক একটা প্রক্রিয়াতেই এসেছে এই সাফল্য। তাদের আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।’