নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৫১ পিএম
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:১৪ পিএম
বাংলা সাহিত্যের ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে রাজলক্ষ্মীর সেই মর্মস্পর্শী কথা- জীবনে এত কান্না কেঁদেছি যে সূর্য্যিদেব না থাকলে এতদিনে একটা পুকুর হয়ে যেত। বোধকরি বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের দিব্যচোখে দেখতে পেয়েছিলেন শরৎ বাবু। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সাফ ফুটবলে বাংলাদেশকে দু-দুবার শিরোপা এনে দেওয়া অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। এই কান্না ছুঁয়ে গেল সাফজয়ী চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যদেরও। সাবিনার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মাসুরা পারভিন কাঁদলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। এই কান্না সংক্রামিত হলো সাফজয়ী দলের সবার মধ্যে।
‘বিষয়টা আত্মসম্মানের বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন সাবিনা। সংবাদ সম্মেলনটি পরিণত হলো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের আর্তনাদ আর আহাজারিতে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মাসুরা জানালেন, ‘আমরা আসলে চেয়েছিলাম ফুটবলের সঙ্গে থাকতে, যদি আপনাদের সমস্যা হয় আমরা চলে যাব।’ যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন বাংলাদেশ কোন সেক্টরে দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা? এক কথায় উত্তর- একমাত্র নারী ফুটবল ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব সেক্টরে পিছিয়ে। কেননা সব জায়গাতেই ভারতের দাপট। কিন্তু একটা জায়গায় ভারতকে টেক্কা দিয়েছে বাংলাদেশ। আর সেটা সম্ভব করেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। টানা দু-দুবারের সাফ মুকুট জিতেছে সাবিনা ব্রিগেড। শুধু এটুকু বললে মোটেও সুবিচার করা হবে না সাবিনা-মনিকা চাকমাদের প্রতি। কেননা সাবিনাদের চেয়ে শতগুণেরও বেশি সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে ভারতীয় নারী ফুটবলাররা।
দারিদ্র্যপ্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থা, মোল্লাতন্ত্রের চোখ রাঙানি, সর্বোপরি ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা, সবকিছুকে মাড়িয়ে দেশকে সবচেয়ে বেশি সম্মান এনে দিচ্ছেন আমাদের নারী ফুটবলাররা। অথচ কী নির্মম পরিহাস, এতকিছু করেও অপমান আর অবজ্ঞাই কেবল জুটেছে সাবিনাদের কপালে! বাফুফের বৈতনিক কোচ পিটার বাটলারের সঙ্গে সাবিনাদের সমস্যা অনেক পুরোনো। ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অভিযানের সময়ই কোচ বাটলার আর নারী ফুটবলারদের দ্বন্দ্ব নেয় চরম রূপ। গত অক্টোবরে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল যখন নেপালে শিরোপা ধরে রাখার মিশনে ছিল, তখনই ঘটে বিস্ফোরণ। মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা জানান, কোচ বাটলার সিনিয়র খেলোয়াড়দের পছন্দ করেন না। এরপর টুর্নামেন্ট চলাকালে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ হয়ে ওঠে নৈমিত্তিক ঘটনা। এতকিছুর মাঝেও শিরোপা ধরে রাখে সাবিনা ব্রিগেড। মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোচ বাটলার জানান, তিনি আর নারী দলের সঙ্গে কাজ করতে চান না। দুই পক্ষের মধ্যে এত অস্বস্তি-অপছন্দ- অবিশ্বাসের পরও কেন বাটলারকেই আবারও মেয়েদের কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। কী উর্বর মস্তিষ্ক!
বাফুফের এমন সিদ্ধান্তে নারী ফটুবলারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্রোহের আগুন। বাটলারের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তির প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে মেয়েরা। সাবিনাদের এই বিদ্রোহ আমলেই নেয়নি বাফুফে। কোচ হিসেবে বাটলারকে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকে সংস্থাটি। বাফুফের সাফ কথা, মেয়েদের কোনো কথা চলবে না। মেয়েদের কথায় কোচ নিয়োগ হবে না। কোচ নিয়োগ দেবে বাফুফে। বাফুফের এই একগুয়েমির ফল হয় মারাত্মক।
গত সোমবার বাটলার ঢাকায় ফিরে মঙ্গলবার টিম মিটিং ডাকলে মেয়েরা তাতে অংশ নেননি। বিষয়টা গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয়নি বাংলাদেশ ফুটবল শাসক সংস্থা বাফুফে। মেয়েদেরকে শাসিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাটলারের অধীনে কোচিং করানোর কৌশল নেয় বাফুফে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেনি তারা। কোনো কিছুতেই কিচ্ছু হচ্ছে না, তখন চূড়ান্ত পথটাই বেছে নেয় সাফ চ্যাম্পিয়নরা। বলাই যায়, মেয়েদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দিয়েছে বাফুফে। সংবাদ সম্মেলনে একটা পর্যায়ে সাবিনা বলেন, ‘এখানে আমরা অনৈতিক কিছু বলব না। আমাদের কোচ রূপনাকে (গোলরক্ষক রূপনা চাকমা) বডিশেইম করেন। ওর হাইট নিয়ে কটূক্তি করেন। আমাদের সব সময় ইনসাল্ট করেন।’
কোচ তাদেরকে মানসিক চাপে রাখত বলে অভিযোগ সাফ শিরোপা জয়ের অন্যতম রূপকার ঋতুপর্ণা চাকমার, ‘আমরা অ্যাডাল্ট, আমাদের একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। রেস্ট ডে-তে কফি খেতে যেতে পারি, বন্ধুদের সঙ্গে যেতে পারি, তো বাফুফেতে কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা কোচকে কানপড়া দেনÑ কে কোথায় এসব নিয়ে। আর কোচ আবার মাঠে গিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
বাটলার থাকলে গণঅবসরের পথেই হাঁটবেন জানিয়ে সাবিনা বলেন, আমরা চাই সুষ্ঠু সমাধান। দুবার সাফ এসেছে, এটা তো খুব ফানি কিছু না। দেশবাসীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, সবাই আমাদের যেভাবে সাপোর্ট দেন তার জন্য ধন্যবাদ। আর বাটলার থাকলে আমরা কোচকে সম্মান জানিয়ে, নিজেদের সম্মান নিয়ে বিদায় নেব।
দেশকে সর্বোচ্চ সম্মান এনে দেওয়া নারী ফুটবলারদের কান্না অনুধাবন করার মতো বোধকরি কেউই নাই।