নারী ফুটবলার
খোকন বিকাশ ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:২৬ পিএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৯ পিএম
মনিকা চাকমা।
পাহাড়ের মেয়ে মনিকা চাকমা। আলোচিত এ ফুটবল কন্যার বাড়ি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার সুমন্ত পাড়ায়। ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কৃষক পরিবারে জন্ম মনিকার। মনিকার বাবার ফুটবল পছন্দ ছিল না। তাই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে ফুটবল খেলতেন মনিকা। তার সঙ্গী ছিলেন, বড় বোন অনিকা চাকমা।
প্রথমে গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে লক্ষ্মীছড়ির মরাচেগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিমের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা পর্যায়ে খেলেন মনিকা। পরে জাতীয় পর্যায় খেলার ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। এ দলটি ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসির টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান করে নেয়। ওই আসরে মনিকা গোল করেছিলেন ৩টি। ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে গোল করে পরিচিতি পান মনিকা। ফিফা তার এ গোলকে ‘জাদুকরী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার নাম প্রচার পায় ‘ম্যাজিকেল মনিকা’ হিসেবে।
দেশের আলোচিত এ ফুটবলারের বাড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিমি দূরে। বাবা পেশায় কৃষক, আর মা গৃহিণী। বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা নেই। একটি ছড়া পার হয়ে যেতে হয়। বর্ষায় সেটা পার হওয়া যায় না।
মনিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমি আমার মেয়ের সাফল্যে গর্বিত। মনিকা শুধু এলাকারই নাম উজ্জ্বল করেনি, সারা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্য পু মারমা বলেন, অভিনন্দন মনিকা চাকমাকে, অভিনন্দন বাংলাদেশ টিমকে। মনিকা আমাদের লক্ষ্মীছড়ির গর্ব। লক্ষ্মীছড়ির ফুটবল কন্যা মনিকা চাকমার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা ও ছড়ার ওপর ব্রিজ
নির্মাণ হয়নি এখনও, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান তার ভক্তরা।
প্রথমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর মনিকার বাড়িতে গিয়েছিলেন তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্ৰতাপ চন্দ্ৰ বিশ্বাস। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মনিকার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটি হবে। কিন্তু আজও হয়নি।
মনিকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা-মা, চাচাসহ কয়েকজন প্রতিবেশী বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কিন্তু গ্রামে একটুও নেই সাফ জয়ের আনন্দ। বরং দেখা গেল সবার চোখেমুখে হতাশার ছাপ। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তবে লম্বা বাশের মাথায় রাউটার স্থাপন করতেই মনিকার বাবার মোবাইলে রিং হলো। অপর প্রান্তে মনিকা। মনিকা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ছড়ার কারণে আমার বাড়িতে মানুষজন যেতে পারে না। বর্ষা হলে তো আরও সমস্যায় পড়ে। রাস্তাটি করা প্রয়োজন। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। তবে আমি কী পাব আর পাব না, সেটা বড় কথা নয়। আমি দেশের হয়ে বিদেশের মাটিতে ফুটবল খেলে বিজয় অর্জন করতে পেরেছি,
দেশের গৌরব অর্জন করতে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। আমি ক্রীড়াঙ্গনকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। এজন্য সবার কাছে আশীর্বাদ চাই।’
মনিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা বলেন, কই কিছুই তো হলো না। মেয়ের সাফল্য অর্জনে ঘরে অনেক ক্রেস্ট আছে। সার্টিফিকেট আছে। সঙ্গে সান্ত্বনাও আছে। তাই নিয়ে সময় পার করি। সরকার একটি ঘর দিয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে। সেই ঘরের পরিধি একটু বাড়িয়েছি। সেখানেও আলাদা অর্থ খরচ করতে হয়েছে। ব্রিজ, রাস্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, তৎকালীন জেলা প্রশাসক বলেছিলেন ব্রিজটি করে দেবেন, রাস্তা হবে, বিদ্যুৎ আসবে, মোবাইল নেটওয়ার্ক পাব। কিন্তু আজও কিছুই হয়নি। যে আশা আমরা করেছিলাম, সেই আশার গুড়ে বালি।
প্রতিশ্রুতি নয় বাস্তবায়নই চাই।
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা বলেন, প্রতিশ্রুতির যদি বাস্তবায়ন না হয়, মানুষ তো হতাশায় ভুগবে। আমি মনে করি সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। উপকৃত হবে মনিকার পরিবার ও তার প্রতিবেশীরাও। গ্রামবাসী চায় আর প্রতিশ্রুতি নয়, এবার বাস্তবায়ন হবে।
প্রতিশ্রুতির বিষয়ে লক্ষ্মীছড়ি উজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ছেনমং রাখাইন বলেন, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার তা করা হবে। মনিকার বাড়ির রাস্তা, ব্রিজসহ এলাকার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা থাকবে।
মনিকা ঢাকা থেকে ফিরলে জেলা প্রশাসন ও ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান ও খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া অফিসার মো. হারুনুর রশিদ কাজল।