শনিবার ভোরে শুরু বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ
নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪ ১৪:৩৪ পিএম
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ মানেই উত্তেজনা-বারুদে ঠাসা এক রোমাঞ্চ
ক্রিকেটে বাঘ-সিংহের লড়াই মানেই বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা দ্বৈরথ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতীক বাঘ আর লঙ্কান ক্রিকেটের সিংহ। শনিবার সকালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাঘ-সিংহের লড়াই দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেটপ্রেমীরা। কাগজে-কলমে এবারের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে গত ২ জুন। এরমধ্যে খেলাও হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু সেই অর্থে বিশ্বকাপ নিয়ে এ দেশে তেমন উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। কারণও পরিষ্কারÑ বাংলাদেশ যে মাঠে নামেনি! দলের পারফরমেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন, সম্ভাবনার জায়গাও সংশয়ে ঘেরা, তারপরও টাইগাররা মাঠের ঘাষে পা না ফেলা পর্যন্ত আমাদের বিশ্বকাপ শুরু হয় কি করে! সেই অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। ‘ডি’ গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর সাড়ে ৬টায় শুরু হচ্ছে টাইগারদের বিশ্বকাপ মিশন। প্রতিপক্ষ উপমহাদেশেরই আরেক শক্তি শ্রীলঙ্কা। এই ম্যাচ উত্তাপ ছড়াবে, যাকে বলে সেয়ানে-সেয়ানে লড়াইÑ এই প্রত্যাশা অমূলক নয়।
ক্রিকেটে স্নায়ুযুদ্ধের সমার্থক ধরা হয় অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজ অ্যাশেজকে। কালক্রমে ক্রিকেটে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের এই জায়গাটিতে যুক্ত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান। এই দুই দেশের ম্যাচ মানেই বাড়তি উন্মাদনা। হালে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ ক্রিকেটে যোগ করেছে লড়াইয়ের নতুন মাত্রা। যা কেবল তুলনীয় ঐতিহ্যবহুল অ্যাশেজ কিংবা ভারত-পাকিস্তান মহাদ্বৈরথের সঙ্গে।
এ সময়ে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ যেন এক অন্যরকম যুদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে এ দুই দলের ম্যাচে বিতর্ক, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, প্লেয়ারদের মেজাজ হারানোÑ এগুলো হয়ে উঠেছে নিত্য অনুষঙ্গ। ম্যাচ শুরুর আগে থেকে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ থাকে দুই শিবিরেই। আগের ম্যাচের টেনশন আর উত্তাপ যোগ হয় নতুন ম্যাচেও। সব কথার এককথা ‘বিনা যুদ্ধে কেউ সুচ্যগ্র মেদিনীও’ ছাড় দিতে রাজি নয়।
গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে ক্রিকেটে বিরল ‘টাইমড আউট’ নিয়ে চরম বৈরিতায় জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নেমে ১৩৫ রানে চতুর্থ উইকেট হারায় লঙ্কানরা। সাজঘরমুখো হন সাদিরা সামারাবিক্রমা। নিয়ম অনুযায়ী দু মিনিটের মধ্যে নতুন ব্যাটারের স্ট্রাইক নেওয়ার কথা। কিন্তু দেরি করে ফেলেন লঙ্কান ব্যাটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ। সতীর্থ ফিল্ডারের পরামর্শে আউটের আবেদন করেন টাইগার অধিনায়ক সাকিব। ম্যাতুজকে টাইমড আউট ঘোষণা করেন আম্পায়ার। সাকিব তথা বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্রিকেট স্পিরিট অনুসরণ না করার অভিযোগ তোলে লঙ্কান শিবির। এ নিয়ে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া জড়িয়ে পড়ে পক্ষে-বিপক্ষে। পরবর্তীকালে ম্যাথুজের এই টাইমড আউট নিয়ে সাকিব বলেন, ‘এখানে ইতিবাচক-নেতিবাচক অনেক তর্ক হতে পারে। তবে আমি নিয়মের মধ্যে থেকেছি। মনে রাখতে হবে আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে ছিলাম। এখানে আমার কাছে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবনাতেই ছিল না। আর আমি আইনের মধ্যে থেকেই জিততে চেয়েছি।’ এই টাইমড আউটের জের সহজেই যে সারবে না, তা দেখা গেছে দুদেশের সর্বশেষ সিরিজেও। প্রতিটি ম্যাচেই কোনো না কোনো বিতর্কে জড়িয়েছে এই দুই দেশ। যুদ্ধের মধ্যে থাকাÑ সাকিবের কথাটিই এই দুই দেশের জন্য এক চরম সত্যি।
ঐতিহ্যে-পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের চেয়ে ঢের এগিয়ে শ্রীলঙ্কা। ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে দুদলের ১৬ দেখায় বাংলাদেশের ৫ জয়ের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার জয় ১১ ম্যাচে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মুখোমুখি লড়াইয়ে দুবারই টাইগারদের হারিয়েছে লঙ্কানরা। তবে ক্রিকেটে রেকর্ডের বাইরে থাকে অনেক কথাই। কোনো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে লঙ্কানদের এই গর্ব কিন্তু খর্ব হয়েছে গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে। ওই ম্যাচে লঙ্কানদের গড়া ২৭৯ রানের সৌধ টপকে যায় বাংলাদেশ। এর আগে সব বৈশ্বিক ইভেন্টেই লঙ্কানদের বিপক্ষে হারের তেতো স্বাদ নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় টাইগারদের। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়Ñ এটা দুদলের মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের খুব বড় একটা দৃষ্টান্ত। ক্রিকেটে বাংলাদেশের খুব বড় গৌরবের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে শ্রীলঙ্কার নাম। বাংলাদেশের শততম টেস্টে জয় এসেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সাত বছর আগে কলম্বোয় স্বাগতিকদের বিপক্ষে এই মাইলফলকের টেস্ট জেতে টাইগাররা।
সাম্প্রতিক সময়টা ভালো যাচ্ছে না দুদলেরই। অফফর্মে থেকেই বিশ্বকাপ অভিযাত্রায় এই দুই দল। প্রস্তুতিমূলক সিরিজে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে হেরেছে ক্রিকেটে নামগোত্রহীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। প্রস্তুতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কা হেরেছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। সেই দুঃস্বপ্ন থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি লঙ্কানরা। চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে শ্রীলঙ্কা। ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে মাত্র ৭৭ রানে অলআউট হয়েছে তারা। ম্যাচ শেষে উইকেটকে দায়ী করেছে লঙ্কান অধিনায়ক ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। গত বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাটিংয়ে ভুগছে দলটি। একই সমস্যায় আছে বাংলাদেশও। টপ অর্ডারে রানের দেখা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। লিটন দাস, সৌম্য সরকার, নাজমুল হোসেন শান্তরা কেউই পারছেন না নামের প্রতি সুবিচার করতে। তরুণদের মধ্যে তানজিদ হাসান তামিম, তাওহিদ হৃদয়রা মাঝেমধ্যে ঝলক দেখালেও সেভাবে ধারাবাহিক নন। দুই অভিজ্ঞ সেনানী মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিবের ওপর দল অনেকাংশেই নির্ভরশীল। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে মাত্র ৬৫ বলের ঝড়ো ইনিংসে ৮২ রান করে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। এবারে বড় মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে সাকিব। টোয়েন্টিÑবিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও তিনি। ৩৬ ম্যাচে তার শিকার ৪৫ উইকেট। এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপে সবার আগে উইকেটের হাফসেঞ্চুরির হাতছানি সাকিবের সামনে।
‘ডি’ গ্রুপে বাংলাদেশÑশ্রীলঙ্কা ম্যাচটি দুদলের জন্যই অনেকটা ফাইনালের মর্যাদায় উন্নীত। যে হারবে তাদের জন্য শেষ আটে জায়গা পওয়াটা হয়ে উঠবে ভীষণ কঠিন। কেননা ৫ দলের গ্রুপ থেকে দুটি দল সুযোগ পাবে শেষ আটে খেলার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হেরে এরই মধ্যে ব্যাকপুটে লঙ্কানরা। এদিকে লঙ্কান চ্যালেঞ্জে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ গ্রুপে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেভারিট। দ্বিতীয় দল হিসেবে পরবর্তী রাউন্ডের দাবিদার বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। আর তাই এই দুই দলের যে হারবে তাদের জন্য গ্রুপ পর্ব উতরানো হয়ে পড়বে ভীষণই কঠিন।
গত বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের শক্তির জায়গা পেস বোলিং। বেশিরভাগ ম্যাচেই ব্যাটিং ব্যর্থতা ঢেকে দিচ্ছেন টাইগার বোলাররা, বিশেষ করে পেস স্কোয়াড। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে হঠাৎ করেই টাইগার পেস স্কোয়াডে লেগেছে বড় ধাক্কা। প্রথমে ইনজুরিতে পড়েন স্পিড স্টার তাসকিন আহমেদ। সবে শেষ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজে অংশ নিতে পারেননি তিনি। তবে আপাতত সুসংবাদ যে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে খেলার মতো ফিটনেস ফিরে পেয়েছেন তাসকিন। তবে এই সুসংবাদের মাঝে দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে দলের নিয়মিত পেসার শরিফুল ইসলামের ইনজুরি। প্রথম ম্যাচে খেলতে পারছেন না এই বাঁহাতি পেসার। শরিফুলের না থাকাটা একটা ধাক্কা বলেও জানিয়েছেন তাসকিন। তবে বাংলাদেশ পেস স্কোয়াডে বিকল্পের অভাব নেই। তাসকিনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আছেন সদ্য আইপিএল মাতানো কাটার মাস্টারখ্যাত মুস্তাফিজুর রহমান, তানজিম হাসান সাকিবরা।
লঙ্কান দল মোটামুটি স্পিননির্ভর হলেও পেস শক্তিতেও তারা কম যায় না। নুয়ান তুশারা, দাসুন শানাকা ও মাথিশা পাতিরানা বিপক্ষ শিবিরকে পরীক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য ভালোই রাখেন। সবে শেষ হওয়া আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে মুস্তাফিজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপক্ষ দলকে ঘায়েল করেছেন পাথিরানা। বিশ্বকাপের মঞ্চে ফিজ-পাথিরানা আবির্ভূত হবেন একে অন্যের ঘাতক হিসেবে। দুই সাবেক অধিনায়ক অলরাউন্ডার ম্যাথুজ ও সাকিবের ডুয়েল এই ম্যাচের আরেক আকর্ষণ। টাইমড আউট বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র যে এই দুজনই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচকে ঘিরে একটা আগুনে লড়াইয়ের সব উপাদানই আছে মজুদ। কে কাকে পোড়ায় সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।