দীপক দেব
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৪৮ পিএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২২ ২১:৩৪ পিএম
শহীদ নূর হোসেন
আজ ১০ নভেম্বর। শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে গণতন্ত্র পুণ:প্রতিষ্ঠার মানবপোস্টার হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন ২৪ বছরের টগবগে যুবক নূর হোসেন। তার জীবন দানের মধ্যদিয়েই সেদিন স্বৈরাচারের ভীত কেপে উঠেছিল। সেদিন নূর হোসেন জীবন দিয়ে গণতন্ত্র পুণ:প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন।
৩৫তম নূর হোসেন দিবসের প্রাক্কালে তার ভাই দেলোয়ার হোসেন ও বোন শাহানা বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে শুনিয়েছেন নূর হোসেন সম্পর্কে অনেক অজানা কথা।
তারা জানান, ব্যক্তিজীবনে সহজ সরল ছিলেন নূর হোসেন। তবে ছিলেন সাহসী। গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন। নান্দনিক ফুটবল খেলার কারণেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তার এসব গুণ অনেকের থেকেই তাকে আলাদা করেছিল। জীবনে এমন কিছু করবেন যেন সবাই এটা নিয়ে কথা বলবে।
ব্যক্তিজীবনে নূর হোসেন কেমন ছিলেন জানতে চাইলে নূর হোসেনের থেকে চার বছরের ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা কাউকে ভালোবাসলে ঠিক মতো বলতে পারে না। কিন্তু নূর হোসেন সেই সময় একটা মেয়েকে ভালোবাসতেন। সেই মেয়েকে বলার ভঙ্গিই ছিল ভিন্ন। তার উপস্থাপনটা এমন ছিল যে কেউ তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারবে না।
তিনি বলেন, নূর ভাই গান গাইতে ভালোবাসতেন। নান্দনিক ফুটবল খেলতেন। এ জন্য সবাই তাকে চিনত। ছোটদের কীভাবে ভালোবাসতে হয় তাকে না দেখলে বোঝান যাবে না। কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। যখন যেটা দেখতেন, তা ভালো লাগলে নিজের ডাইরিতে লিখে রাখতেন।
তিনি বলেন, ম্যাচের কাঠি নিয়ে একটা সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন, যদিও এখন মনে নাই। অনেক প্রতিভা ছিল। আল্লাহ ভাইকে নিয়ে যাবেন বলেই হয়তো এতো প্রতিভা দিয়েছিলেন। আল্লাহ তো তার প্রিয় মানুষকে দ্রুতই নিয়ে যান।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, তার ভেতরে বিন্দুমাত্র ভয় ছিল না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কখনো পিছপা হননি। তিনি একাধারে ছিলেন সাহসী, বিনয়ী এবং নমনীয়। ছিলেন রাগিও। তবে কাওকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে দেখিনি। কারো বিপদ দেখলে ঝাপিয়ে পড়তেন।
তিনি বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলেন। রাজনীতি নিয়ে কোনো দিন কারো সঙ্গে আপস করেননি। লোভ ছিল না, লোভ থাকলে জীবনে অনেক কিছুই করতে পারতেন। নেত্রী (শেখ হাসিনা) সেদিন ভাইকে বলেছিলেন, কী করেছো, তারাতারি শার্টটা গায়ে দাও। এ কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, নেত্রী আমাকে দোয়া করে দেন, আজ আমি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে ফিরব।
তিনি বলেন, ৮৮’র বন্যা না হলে এরশাদের পতন এতো দেরি হতো না, ডা. মিলনকেও জীবন দিতে হতো না। নূর হোসেন স্বৈরাচারের পতনের ভীত রচনা করে দিয়ে গেছেন। সেদিন আনেকেই জীবন দিয়েছেন, অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। কিন্তু নূর হোসেনের লাশ গুম করতে পারেনি। কারণ তার বুকের সেই লেখা, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন না করা নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই নূর হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, নূর হোসেন মানুষের হৃদয়ে রয়েছেন, এক দিনের জন্য পতাকা উড়িয়ে সারাবছর খবর নাই এমন মর্যাদার দরকার নেই। জামায়াত বাদে সব দল নূর হোসেনকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। আমি নূর হোসেনের ভাই- এটা কেউ শুনলে আমাদের সম্মান করে, ভালোবাসে। আমাদের মতো গরীব ঘরের সন্তানদের জন্য এটাই অনেক বড় পাওয়া। সময় আসলে নূর হোসেনকে রাষ্টীয় ভাবেই সম্মান জানানো হবে বলেও বিশ্বাস করেন তিনি।
বোন শাহানা বেগমের চোখে বড় ভাই নূর হোসেন ছিলেন এক আতঙ্ক। তিনি বাসায় আসলেই চুপ করে, মাথা নিচু করে থাকতেন শাহানা। তার ভাষায়, ভাই সব সময় আমাকে লেখাপড়ার কথা বলতেন। যেদিন ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনতে পাই সেদিন বারবার মনে হয়েছিল, কেন ভাইয়ের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলিনি। কেন আমি ভাইয়ের দিকে ঠিক মত তাকেইনি, কেনই বা ভয় পেতাম। কেন ঠিক মতো পড়তাম না।
ভাই সম্পর্কে এসব কথা বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন শাহানা বেগম। তিনি বলেন, ১০ নভেম্বর দিনটি আসলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় ভাইয়ের জন্য।
নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে গুলিস্তানের নূর হোসেন চত্ত্বরে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো।
এছাড়া প্রতিবারের মতো এবারও পরিবারের পক্ষ থেকে মিলাদ ও দোয়া মহফিল ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়।