× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৃষ্টি খাতুন থেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

রহস্যে ঘেরা এক জীবনের গল্প

আমান নবী

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩৬ এএম

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৪ ১১:১২ এএম

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

সর্বশেষ অভিশ্রুতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের সহকর্মী তুষার হাওলাদারের সঙ্গে। কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যে অভিশ্রুতি রিপোর্টিংয়ের সুযোগ পান নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিটে। দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের প্রধান প্রতিবেদক গোলাম রব্বানী জানান, ‘কাজের প্রতি খুব সিনসিয়ার ছিল অভিশ্রুতি। অল্প সময়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিকতা এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।’

তবে জানুয়ারির শেষের দিকে অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছেড়ে দেন চাকরি। নাটকীয়তা আর বিতর্ক রয়েছে অভিশ্রুতির অসুস্থতা নিয়ে। সবশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে একটি ছোট সার্জারি হলেও পরিচিতদের কাছে প্রচার করেন তিনি ক্যানসার আক্রান্ত। আরও কিছু জটিল রোগের কথা জানালেও কোনোটিই সত্যি নয় বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি বৃষ্টি খাতুনের পরিবর্তে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাম লিপিবদ্ধ করতে আবেদন করেন নির্বাচন কমিশনে। অনলাইনে করা আবেদনটির বিষয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি জানান কমিশনের এক কর্মকর্তা। 

জানুয়ারিতে চাকরি ছাড়ার পর আরও রহস্যেঘেরা জীবন শুরু হয় অভিশ্রুতির। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নিজেকে ভারতের ভূপালকেন্দ্রিক পত্রিকা দৈনিক ভাস্করের প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুমন কুমার পাল জানান, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের ওই তরুণী সাক্ষাৎকারের সময় জানান তিনি ভারতের বানারাসের বাসিন্দা, বাংলা একদমই জানেন না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের সমস্যা নিয়ে তিনি কাজ করেন। জানান, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তার যোগাযোগ রয়েছে। এ সময় তিনি দৈনিক ভাস্কর পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।

বাংলা জানেন না অভিশ্রুতি তাই দোভাষী বিশাল ভদ্র ভাদুরির সহায়তা নেন সুমন কুমার পাল। বিশাল জানান, আলাপচারিতায় অভিশ্রুতি বানারসের গলিচত্তর এলাকার বাসিন্দা বলে পরিয় দেন। একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কুশল চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নেন অভিশ্রুতি। কুশল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ওই তরুণীর হিন্দি এক্সেন্ট শুনে ধরতে পারিনি সে ভারতীয় নয়।’

এসব সাক্ষাৎকার নিতে অভিশ্রুতিকে সরাসরি সাহায্যকারী রমনা কালীমন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহার দাবি, অভিশ্রুতিকে তিনি দৈনিক ভাস্করের প্রতিনিধি হিসেবেই চিনতেন। তবে দৈনিক ভাস্করের পক্ষে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানানো হয়, অভিশ্রুতি নামে কাউকেই চেনে না তারা। এমনকি বাংলাদেশে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। আমরা জানতে পেরেছি অভিশ্রুতির বাংলা জানার বিষয়টিও উৎপল সাহা জানতেন। বেইলি রোডে আগুনের পর এই উৎপল সাহাই হাসপাতালে গিয়ে অভিশ্রুতিকে শনাক্তের দাবি করেন।

অন্যদিকে সবুজ শেখ জানান, মেয়েটি তাদেরই সন্তান। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর জন্মগত নাম বৃষ্টি খাতুন। তবে প্রতিদিনের বাংলাদেশ খুঁজতে চেয়েছে বৃষ্টি থেকে অভিশ্রুতির যাত্রার আদি কারণ। আর তাতে সামনে এসেছে এমন এক আদি প্রভাব যা বদলে দিয়েছে গ্রামের অতিসাধারণ এক মেয়ে বৃষ্টি খাতুনের মনোজগৎ। 

আমরা কুষ্টিয়ার খোকসার সেই গ্রামে যাই। রাজমিস্ত্রি সবুজ শেখ তিন কক্ষের এক আধা পাকা বাড়িতেই বড় করছেন তিন মেয়েকে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃষ্টির দাইমা হাসিনা বেগম ছলছল চোখে ঘুরে দেখালেন বৃষ্টির জন্মস্থান। বৃষ্টির হাতেখড়ি ও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের ব্র্যাক স্কুলে। এরপর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকদের কাছে বৃষ্টির পরিচিতি শান্ত-কোমল, মেধাবী এবং ধর্মপ্রাণ হিসেবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল বৃষ্টির। সাহিত্য আর বিজ্ঞানের প্রতি ছিল বিশেষ আকর্ষণ। মাধ্যমিকের গণ্ডিতে বৃষ্টির নিবিড় তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন স্কুলের প্রবীণ বিজ্ঞান শিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তী। বিজ্ঞানের প্রতি বাড়তি আগ্রহও এই শিক্ষকের মাধ্যমে। স্কুলের শিক্ষকেরা জানান, শিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তী যখন অন্য শ্রেণিতে পাঠদান করতেন, সেখানেও চুপটি করে অংশ নিতেন বৃষ্টি। 

মেধা, মনন ও ব্যক্তিত্বে পুরো এলাকার শিক্ষক সমাজের প্রবাদপুরুষ সুকুমার চক্রবর্তী ছিলেন বৃষ্টির বাবা-মায়েরও শিক্ষক। এ কারণে তিনি হয়ে ওঠেন বৃষ্টির সব অভাব-অনুযোগের আশ্রয়স্থল। বৃষ্টিকে আদর করে ডাকতেন ‘মিষ্টি’ নামে। বিজ্ঞানের প্রতি বৃষ্টির বাড়তি আগ্রহের জন্মও এই শিক্ষকের মাধ্যমে। সুকুমার চক্রবর্তীর স্নেহাশিসও ঘিরে ছিল প্রিয় ছাত্রীকে। শিশুমনে প্রিয় শিক্ষকের এই ভালোবাসার কথা বৃষ্টি লিখেছেন ডায়েরির একটি পাতায়। কলেজ পেরিয়ে অভিশ্রুতি বৃষ্টি নামের ফেসবুক প্রোফাইলে ডাকনাম হিসেবে বেছে নেন সুকুমার চক্রবর্তীর আদর করে ডাকা নাম ‘মিষ্টি’। উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ হলেও ধর্ম-বর্ণের বাছবিচারহীন এই বিজ্ঞান শিক্ষকই হয়ে উঠেছিলেন বৃষ্টির আদর্শ। 

উচ্চ মাধ্যমিকের পর বৃষ্টির মানসিক পরিবর্তন স্পষ্ট হতে থাকে। অভিজিৎ রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন লেখকের বিশেষ কিছু বইয়ের প্রতি তৈরি হয় গভীর আগ্রহ। নিবিড় মনোযোগে এসব বই পড়ার সময়, বিশেষ অংশগুলো কলমের কালিতে চিহ্নিতও করেছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের যে গল্পের শেষ নেই বইয়ে পেন্সিলের আঁচড়ে চিহ্নিত করে রাখা একটি অংশে রয়েছেÑ ‘এই হলো ইন্দ্রজাল, সত্যিকারের জয় করবার অভাবকে কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করবার চেষ্টা।’

বৃষ্টি থেকে অভিশ্রুতি হয়ে ওঠার যাত্রায় তার বাচনভঙ্গী ও শব্দচয়নেও আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। যার অনেক মিল রয়েছে নিজের পড়া বইয়ের চিহ্নিত করা লাইনের সঙ্গে। কলেজজীবনে হিন্দি সিনেমা দেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন বৃষ্টি। বৃষ্টির ছোট বোন ঝর্ণা জানান, সিনেমা দেখেই বৃষ্টির হিন্দি শেখা।

হিন্দুধর্ম রীতিতে মনোযোগী হয়ে ২০২০ সালের শেষদিকে ধর্মবিশ্বাসহীন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসেন অভিশ্রুতি। এমনকি অংশুমালিতে প্রকাশিত লেখা তুলে নিতে অনুরোধ করেন জুবায়েন সন্ধীকে। ২০২২ সালের শেষদিকে অভিশ্রুতির ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী ভারতের বানারাস থেকে ফিরলে, তার কাছে বানারাসের খুঁটিনাটি গল্প শোনেন অভিশ্রুতি। এর কয়েক মাসের মধ্যে অভিশ্রুতির মুখে বানারসে জন্মের কথা শুনতে পান ঘনিষ্ঠরা। ওই বান্ধবী বলেন, ‘সে (অভিশ্রুতির) যেসব বন্ধুর কাছে দাবি করেছে, বানারস থেকে এসেছে, তাদের সবার সাথে পরিচয় আমার বানারস থেকে ফিরে আসার পর। এর আগে আমরা যারা পুরোনো বন্ধু তারা কখনও তার মুখে বানারসের গল্প শুনিনি।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্টের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলামের দৃষ্টিতে, বৃষ্টি থেকে অভিশ্রুতির যাত্রা চমকপ্রদ এক মনোজাগতিক রূপান্তর। এই পরিবর্তনের সূচনায় তিনি দেখছেন স্কুলশিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তীকে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে বৃষ্টির জীবনে। অবচেতন মনে সনাতন ধর্মের প্রতি আকর্ষণ, ব্রাহ্মণ্য রীতির প্রতি প্রীতি, বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহের জন্মও শিক্ষকের জীবন-আদর্শের প্রভাবে। নিজের পারিবারিক ধর্মের অনুসারী অন্তত দুজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন অভিশ্রুতি, তবে সেই সম্পর্ক ছিল স্বল্পমেয়াদি অথবা তিক্ত। তাই এসব সম্পর্ক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি অভিশ্রুতির জীবনাচরণে। বরং তার মানসিক পরিবর্তনকে করেছে আরও তীব্র। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি খাতুন থেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর যাত্রাটি কোনো মনোরোগ নয়, বরং শৈশব-কৈশোরে একাকিত্বে ভোগা নিশ্চুপ-শান্ত মেয়েটি পরিবার-বন্ধুদের নিবিড় সান্নিধ্য পেলে এড়াতে পারতেন এমন অভিজ্ঞতা। নিজের অসুস্থতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যসহ বিভিন্ন সময়ে তার দ্বৈত আচরণ কাছের মানুষের মনোযোগ ও সহমর্মিতা পাওয়ার চেষ্টা বলেও মনে করছেন তারা।

জীবনের শেষ কয়েক মাসে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল। কেন তিনি দৈনিক ভাস্করের প্রতিবেদকের মিথ্যা পরিচয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কট্টর কোনো গোষ্ঠী তাকে ব্যবহার করেছে কি না, এসব নিয়েও আছে প্রশ্ন। মনোবিদ ডা. আজিজুল ইসলাম মনে করেন, অভিশ্রুতির ছিন্নমূল মানসিকতার সুযোগ নিতে পারে যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব স্বার্থে অভিশ্রুতিকে ব্যবহারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মিথ্যা পরিচয়ে অভিশ্রুতির কর্মকাণ্ড পুলিশের অজানা বলে জানান রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। তবে তিনি জানান, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হিসেবে পরিচিত বৃষ্টি খাতুনের মোবাইল ফোন রয়েছে পুলিশের জিম্মায়। সব বিষয়েই তদন্ত হবে।

মনোবিদদের মতে, একটি আদর্শ চরিত্রকে সামনে রেখে কল্পনার চরিত্রে পরিণত হওয়া অভিশ্রুতির জীবন ছিল এক ইন্দ্রজাল। বাস্তবতাকে বিসর্জন দিয়ে স্বপ্নের জগৎকে কল্পনা দিয়ে পেতে চাওয়ার একটি গল্প হয়ে মানুষের মাঝে থেকে যাবেন তিনি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা