রাজবংশী রায়
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫৪ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৪ ১২:০৪ পিএম
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে এ খাতে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে সারা দেশে অভিযান চলছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেট সদস্যদের তালিকা হচ্ছে। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন ঘোষণা দিয়েছেন এক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
গত তিন দিনের টানা অভিযানে কয়েকশ অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জরিমানাসহ দণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এ অভিযানের মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে ওষুধ ও হার্টের রিংয়ের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি। ওষুধ ও হার্টের রিংয়ের উচ্চমূল্য নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ। তিনি এ দুটি পণ্যের মূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার বার্তা দিয়েছেন। এর বাইরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ঔষধাগার সরেজমিন পরিদর্শন করে কোটি কোটি টাকা মূল্যের মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রীর তালিকা তৈরি করে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যন্ত্রপাতি, ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করে সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ। মন্ত্রীর পদক্ষেপে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ খাতের প্রধানতম সমস্যা অব্যবস্থাপনা ও কেনাকাটায় দুর্নীতি। তাদের অভিমত, এই দুর্নীতি অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে এটি সম্ভব হবে না। ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। সেটি করা গেলে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বছরের পর বছর ধরে চলা স্বাস্থ্য খাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙার কাজও দ্রুততম সময়ে শুরু হবে। বড় বড় পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সরিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সামনে আরও বড় পরিবর্তন আসবে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ চার পদে পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষ করে পরিচালক (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালনকারী আলোচিত অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলামকে সরিয়ে নিপসমের পরিচালক করার ঘটনাটি সবার দৃষ্টি কাড়ে। প্যাথলজির অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলামের পরিচালক (প্রশাসন) পদে পদায়নের ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ছিল স্বাস্থ্য বিভাগে। কারণ তার আগে এ পদে বেসিক, ক্লিনিক্যাল বিষয়ের কাউকে পদায়ন করা হয়নি। মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্বাস্থ্য প্রশাসনের চিকিৎসকরা এ পদে দায়িত্ব পালন করতেন। বছর দেড়েক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরাকে আবারও আগের পদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ওই সময় তাকে বদলি করে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক করা হয়েছিল। মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার ওই সময়ে আকস্মিক পদায়নের ঘটনায় সবাই বিস্মিত হয়েছিলেন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদে পদায়ন করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে তিনি এ পদে ছিলেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রী কেনাকাটার সঙ্গে জড়িতদের সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর অফিস শুরুর প্রথম দিনে ঠিকাদার মিঠুর এক আত্মীয়কে পদায়নের ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে তোলপাড় চলছে। অনেকের প্রশ্ন, আবারও পরোক্ষভাবে ঠিকাদার মিঠু চক্রের কবলে পড়তে যাচ্ছে কি না স্বাস্থ্য খাত।
চ্যালেঞ্জ নিতে হবে মন্ত্রীকে, মত বিশেষজ্ঞদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এমনি একটি সময়ে ডা. সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, যখন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা অনাচারে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই অরক্ষিত। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, হাসপাতাল তথা পুরো স্বাস্থ্য খাত আইনকানুন ও প্রাতিষ্ঠানিক শিকলে বন্দি। আর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ তো আছেই। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবেন, তা নির্ভর করছে তিনি স্বাস্থ্য খাতের অচলায়তন ভাঙতে কতটুকু সক্ষম হবেন তার ওপর। তবে মন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশার তালিকা অনেক বড়। আশা করি তিনি সক্ষম হবেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে চলা স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা একদিনে দূর করা সম্ভব হবে না। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডা. সামন্ত লাল সেন কাজ শুরু করেছেন। বিশেষ করে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। এর আগেও অভিযানে অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তা আবার চালু হয়ে যায়। এবার যেন সেটি না হয়।
রশিদ ই মাহবুব আরও বলেন, মন্ত্রী ওষুধ ও হার্টের রিংয়ের দাম কমানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এটি জনবান্ধব সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে সব ধরনের ওষুধের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ‘মার্ক আপ’ (মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি) সংশোধন করে যৌক্তিকভাবে নতুন ‘মার্ক আপ’ নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সব ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স পরীক্ষা চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করে রশিদ ই মাহবুব বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নিয়েও মন্ত্রী কথা বলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগে শিক্ষক নেই। তাহলে শিক্ষার্থীদের কারা পাঠদান করছেন? আর এসব মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা যখন চিকিৎসা পেশায় আসবেন তা জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী হবে তা-ও ভাবতে হবে। মানহীন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের লাগাম টেনে ধরতে পারলে দেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরি হবে। কিন্তু কতটুকু পারা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের এক নম্বর সমস্যা অব্যবস্থাপনা ও কেনাকাটায় দুর্নীতি। এই দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে এটি সম্ভব হবে না। ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। বছরের পর বছর ধরে সিন্ডিকেটের দখলে থাকা কেনাকাটার দুষ্টুচক্র ভাঙতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কতটুকু সক্ষম হবেন তার ওপর স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করবে বলে মনে করেন তিনি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি। নিজে কখনও দুর্নীতি করিনি। আর দুর্নীতি সহ্যও করব না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়লে প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করার কথা বলেছেন। সমস্যায় পড়লে আমি তাই করব। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেব না।
কাজ করতে গিয়ে এ খাতে সর্বত্রই অসঙ্গতির চিত্র চোখে পড়ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যেখানে খোঁজ নিচ্ছি সেখানেই অসঙ্গতি পাচ্ছি। এত অসঙ্গতি নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা দুরূহ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীভাবে ভালো চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হলে অসঙ্গতি দূর করতে হবে। ঢাকায় রোগীদের চাপ কমাতে স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব বলে মনে করেন দেশের খ্যাতনামা এই চিকিৎসক।