সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৫৩ এএম
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, লাখো মুক্তিযোদ্ধার বিজয়োল্লাস আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস। ছবি : আনোয়ার হোসেন
স্বাধীনতার ৫২ বছরে দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ নির্ভুল তালিকা তৈরি করতে পারেনি সরকার। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ষষ্ঠ দফায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করলেও তা এখনও শেষ হয়নি। মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার দেড় লাখ আবেদনের মধ্যে এখনও ৪০ উপজেলার আবেদনের প্রাথমিক যাচাই-বাচাইও হয়নি। আর উপজেলা থেকে প্রাথমিক যাচাই হয়ে আসা সাড়ে ২২ হাজার আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব প্রতিবেদন পাওয়ার পর চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন সম্পন্ন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই আবেদনগুলো কখন নিষ্পত্তি হবে, তা-ও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে না পারা জাতির জন্য লজ্জাকর। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই এই ধীরগতি বলে দাবি তাদের।
যাচাই-বাচাইয়ের সর্বশেষ অবস্থা : ২০১৩ সালে ষষ্ঠ দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে জামুকা। সরাসরি জামুকায় আবেদন এবং ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়। প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন জমা পড়ে। সারা দেশে আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাই শুরু হয় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি।
এসব আবেদন যাচাই-বাচাই করার জন্য দুটি কমিটি করা হয়। একটি উপজেলা/ মহানগর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি। তিন সদস্যের এই কমিটির সভাপতি স্থানীয় এমপি। তবে এমপি মুক্তিযোদ্ধা না হলে তার পক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিত্ব করবেন। সদস্য সচিব স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার। আর অপর সদস্য হলেন জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা কিংবা ‘লাল মুক্তিবার্তা’য় তালিকাভুক্তদের অন্তর্ভুক্ত করার শর্ত রাখা হয়েছে। এই কমিটি আবেদন যাচাই-বাচাই করে নির্ধারিত তিনটি ক্যাটাগরির মধ্যে একটি ক্যারাগরি নির্বাচন করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে পাঠাবে। এই ক্যাটাগরির মধ্যে ‘ক’ হলো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট মুক্তির জন্য সুপারিশকৃত, ‘খ’ সিদ্ধান্ত প্রদানে দ্বিধাবিভক্ত এবং ‘গ’ নামঞ্জুর। অপর কমিটির নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয়ভাবে জামুকার সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সদস্য।
‘ক’ ক্যাটাগরির প্রস্তাব ফের যাচাই করে জামুকার মিটিংয়ে অনুমোদনের পর গেজেটভুক্ত করার প্রস্তাব পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। অপরদিকে ‘খ’ এবং ‘গ’ ক্যাটারিতে বাচাইকৃতরা কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে আপিল করতে পারেন।
জামুকার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাউন্সিলে আসা আবেদনের মধ্যে ‘ক’ তালিকার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার আবেদন জামুকার সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সদস্য ফের যাচাই করে চূড়ান্ত করেননি। আর ‘খ’ এবং ‘গ’ তালিকাভুক্ত ১৮ হাজার আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া তথ্য যাচাই করে পাঠায়নি এমন উপজেলার সংখ্যা ৪০। এতে আবেদনের সংখ্যা কয়েক হাজার। এসব উপজেলার ইউএনওকে গত জুন মাসেও তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জামুকার মহাপরিচালক ড. মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল বলেন, ওই ৪০ উপজেলা কমিটিকে আবেদনগুলো যাচাই-বাচাই করে দ্রুত পাঠানোর জন্য একাধিকবার চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা পাঠাচ্ছে না। তাই বিকল্প ভাবতে হবে। আর উপজেলা থেকে যাচাই-বাচাই হয়ে আসা তালিকাগুলো যাচাই শিগগির শেষ হবে।
জামুকা সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত আবেদন যাচাই করে ২৩ হাজার ৫৭১ জনকে বেসামরিক তালিকায় যুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে জামুকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৫২৮ জন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা, ৭৬১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ৯৫ জন চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মুক্তিযোদ্ধা, ২৭৩ জন মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ২১৮ জন শব্দসৈনিক, ৫২১ জন বীরাঙ্গনা, ৩৯ জন বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা, বাহিনী থেকে বাতিল করে বেসামরিক ক্যাটাগরিতে যুক্ত করার জন্য ৯১৯ জনের নাম সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৩৪ অমুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে জামুকা।
মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা : ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটি ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করেছিল। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। ১৯৯৪ সালে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চতুর্থ তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা বলছে, জামুকার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যাদি যাচাই করে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ আংশিক (কয়েক দফায়) ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নামকরণ হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার সমন্বিত তালিকা। গত আড়াই বছরে কয়েক দফায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও এর কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত সমন্বিত তালিকায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৪৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকরা : বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী আপসোস করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখন জীবনসায়াহ্নে। মারা যাওয়ার আগে যদি তারা স্বীকৃতিটা দেখে যেতে না পারেন, তাহলে স্বীকৃতি দিয়ে কী হবে?
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করবে মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের বাদ দিয়ে আমলাদের দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। বছরের পর বছর ধরে শুধু তালিকাই হচ্ছে। এর শেষ কোথায় বুঝতে পারছি না।’