× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বালুখেকো সেলিমের ৮৭ প্লট ফ্ল্যাট বাড়ি ক্রোক

আলাউদ্দিন আরিফ

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৪৭ এএম

বালুখেকো সেলিমের ৮৭ প্লট ফ্ল্যাট বাড়ি ক্রোক

আশপাশে আধাপাকা বাড়ি, তার মাঝখানে শোভা পাচ্ছে এক সুরম্য অট্টালিকা। দশতলা বাড়িটির চারদিক মোটা গ্রিল আর কাঁটাতারে ঘেরা। বাড়ির সামনে প্রতিদিন এসে থামে বিলাসবহুল সব গাড়ি। এসব গাড়িতে থাকেন সিনেমা ও শোবিজ জগতের বহু চেনা-অচেনা মুখ। বাড়ির নিরাপত্তায় চারপাশে বসানো রয়েছে সিসি ক্যামেরা, আছে অস্ত্রধারী প্রহরীও। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এটি এক রহস্যঘেরা বাড়ি। রাতদিন ব্যস্ত থাকা এ বাড়ি ও এর বাসিন্দাদের ঘিরে এলাকাবাসীর কৌতূহলের অন্ত নেই। এখানে চলে সিনেমা ও নাটকের শুটিং। স্টুডিও, জলসাঘর, মিনিবারসহ অনেক কিছুরই সমারোহ এখানে। নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার কুতুবপুর ইউনিয়নের ভূঁইগড় মৌজায় এ বাড়ির অবস্থান। বহুল আলোচিত এ বাড়িটি চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সেলিম খানের। সবার কাছে যিনি বালুখেকো হিসেবেই বেশি পরিচিত। 

আলোচিত বাড়িটিতে রয়েছে সেলিম খানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ার কার্যালয়। আছে ভয়েস টিভি ও ভয়েস অনলাইনের অফিস। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেলিম খানের এই বাড়িটিসহ তার মোট ৮৭টি প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি ক্রোক করেছে। আরও ক্রোক করেছে তার বিলাসবহুল তিনটি গাড়িসহ অনেক সম্পদ। দুদকে সেলিম খানের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে এসব স্থাবর সম্পত্তির দাম ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ৪১ হাজার ৩৬১ টাকা এবং অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৩ কোটি ৫ লাখ ৫৯ হাজার ১০ টাকা দেখানো হয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী দুদক তার ৩৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬১ টাকার সম্পত্তি ক্রোক করেছে।

সম্প্রতি এসব সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের। এ ছাড়া তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। 

দুদকের নথি অনুযায়ী ভূঁইগড় এলাকায় সেলিম খানের সুরম্য বাড়িটি সাড়ে ১২ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত। দশতলা এ ভবনের নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা। আর জমির দাম ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। নির্মাণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এরকম একটি ১০ তলা বাড়ি তৈরিতে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা। জমির দামও ৫ কোটি টাকার বেশি হবে। 

রাজধানীর কাকরাইলে আজিম ভবনটিও সেলিম খানের। সেখানে আরও কয়েকটি বাড়ি, ফ্ল্যাট রয়েছে তার। দুদকের নথিতে সিটি জরিপ ৩৪-এ ভবনের তৃতীয় তলার দাম দেখানো হয়েছে ৯০ লাখ টাকা। চতুর্থ তলার দাম দেখানো হয়েছে ১ কোটি টাকা। নিচ ও দোতলার দাম দেখানো হয়েছে ৯০ লাখ টাকা করে। পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা। সিটি জরিপের ১৪৪-এ কাকরাইলের ৫ তলা ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। 

অবৈধ অর্থে অর্জিত সেলিম খানের এরকম ৮৭টি স্থাবর সম্পদ ক্রোক করেছে দুদক। যার অধিকাংশই চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম খান রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করিয়ে ৩৬০ কোটি টাকা আত্মসাতেরও চেষ্টা করেন। পরে বিষয়টি জেলা প্রশাসনের তদন্তে ধরা পড়ে। তিনি মেঘনা নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করেন। নদীর তীর দখল করে তৈরি করেছেন বিভিন্ন স্থাপনা। দুদকের তথ্যমতে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। তদন্তে তার ৮৭টি স্থানে প্লট, ফ্ল্যাট, ও জমি ক্রয়ের তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া তার ৪টি ড্রেজার ও তিনটি গাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। 

দুদক সূত্র জানায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডারবাজি, নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলনসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সেলিম খান শতকোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে ৬৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০২২ সালের ১ আগস্ট মামলাটি করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান সরকার। তিনিই মামলাটি তদন্ত করেন। মামলার চার্জশিট তৈরির কাজ চলছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলিম খানের সহায়-সম্পত্তির বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি। এসব সম্পত্তি তিনি ‘গোপনে’ হস্তান্তর করতে পারেন এমন আশঙ্কা থাকায় গত ৩১ আগস্ট সেগুলো ক্রোক করতে ঢাকা মহানগর স্পেশাল জজ আদালতে আবেদন করে দুদক। আদালত শুনানি শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর সব সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দেন। ক্রোককৃত সম্পত্তি বেহাত হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে সম্পত্তি পরিচালনায় রিসিভার নিয়োগের জন্য গত ৩১ আগস্ট আদালতে আবেদন করে দুদক। আদালত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলার জেলা প্রশাসককে ‘রিসিভার’ হিসেবে নিয়োগ দেন।

আদালতের আদেশে বলা হয়, দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন ও তদন্তকারী কর্মকর্তা আতাউর রহমান সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ সেপ্টেম্বর সেলিম খানের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ক্রোক করা সম্পত্তিসমূহ বেহাত হয়ে যাচ্ছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন। তাই ক্রোক করা সম্পত্তি পরিচালনার জন্য রিসিভার নিয়োগ করার দরকার। নিযুক্ত রিসিভারকে বর্ণিত সম্পত্তির আয়-ব্যয়ের হিসাব দুই মাসের মধ্যে আদালতকে অবহিত করাসহ অর্থ আদায় ও তা তফসিলি ব্যাংকে জমা দিয়ে ছয় মাস পরপর বিষয়টি কমিশনের মাধ্যমে আদালতে লিখিতভাবে জানাতে হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদ হোসেন বলেন, দুর্নীতির মামলায় সেলিম খানের সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। এসব সম্পত্তি পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে রিসিভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর সেলিম খানের প্রায় ৩৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। মামলার তদন্তকালে সেলিম খান, তার ছেলে শান্ত খান, মেয়ে প্রিয়াঙ্কা খানসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরসহ দেশের ৮৭টি স্থানে জমি, প্লট, ফ্ল্যাট থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি মূল্যবান গাড়ি এবং নদী থেকে বালু উত্তোলনকারী চারটি ড্রেজারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পত্তির মূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে সেলিম খানের আর কী কী সম্পদ আছে, সেগুলো জানার চেষ্টা চলছে। 

সেলিম খানের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি জানান, সেলিম খান যে রেঞ্জ রোভার গাড়িতে চড়ে বেড়ান, সেটি দুদকের জব্দ তালিকায় নেই। এ ছাড়া তার অনেক সম্পদেরই হিসাব নেই। তিনি মেঘনা ও পদ্মা নদী থেকে কমপক্ষে ৬৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ঘনফুট বালু তুলে হাজার কোটি টাকায় অবৈধভাবে বিক্রি করেছেন। অধিকাংশ অর্থই পাচার করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। 

কে এই সেলিম খান 

চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের হতদরিদ্র এক পরিবারে জন্ম নেওয়া সেলিম খান একসময় ছিলেন রিকশাচালক। ছিঁচকে চুরির অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। মেঘনায় অবৈধ ড্রেজিং আর একচেটিয়া বালু ব্যবসায় তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বর্তমানে এলাকায় তার পরিচিতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ঠিকাদার, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতাও।

২০১১ সালে তিনি চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে রাতারাতি শত-শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। উচ্চ আদালতের আদেশে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত বালু উত্তোলনের বিপরীতে র‌য়্যালটি হিসেবে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে নির্দেশ দেয় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ৪ বছরে সেলিম খানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ কী পরিমাণ বালু তুলেছে, এর বিপরীতে সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা দিতে হবে, তা নির্ধারণ করতে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে উপকমিটি চার বছরে সেলিম খান কী পরিমাণ বালু তুলেছেন, তা নির্ধারণ করে।

ওই উপকমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২১টি মৌজা থেকে সেলিম খান ৬৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৯ হাজার ৫৮৫ ঘনফুট বালু তুলেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি রিট আবেদনের রায়ের ভিত্তিতে প্রতি ঘনফুট বালুর বিপরীতে ৪০ পয়সা রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। এই হিসাবে সেলিম খানকে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ ৩১ হাজার ৮৩৪ টাকা জমা দিতে বলেছে জেলা প্রশাসন। চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সেলিম খান ওই টাকা পরিশোধ করেননি। তার বিষয়ে বিধি অনুযায়ী পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সেলিম খানের মোবাইলে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। তার মোবাইলে এসএমএম পাঠানো হলেও তার কোনো উত্তর তিনি দেননি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা