× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা জানেই না মানুষ

রাশেদুল হাসান

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:০৭ পিএম

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:২৫ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত বা আহত হলে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। এই ক্ষতিপূরণের তহবিল গঠন করতে মোটরযান মালিকদের কাছ থেকে প্রতি বছর নির্ধারিত পরিমাণে টাকাও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তহবিল সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা না থাকাসহ নানা জটিলতার কারণে আট মাসে হতাহতদের মাত্র ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছেন। আবার আবেদনকারীদের কেউই ক্ষতিপূরণের কোনো অর্থ পাননি।

বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা, তা নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এবং আবেদন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় সারা দেশে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিমাণ কম হচ্ছে।

ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন ট্রাস্টি বোর্ডের। বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদনে আহ্বান, তদন্ত ও অনুমোদন করার কাজটি করে দেওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাস্টি বোর্ডের আলাদা কার্যালয়, কর্মকর্তা ও কর্মচারী না থাকায় পুরো প্রক্রিয়া জটিল আকার নিয়েছে।

বিআরটিএ’র তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সড়কে ৮ মাসে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা মোট ৮ হাজার ৪৮৯ জন। যদিও বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী তা অনেক বেশি। এ সময়ে নিহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৩১৭ জন আর আহতের সংখ্যা ৫ হাজার ১৭২ জন। সংস্থাটির আইন শাখার তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে চলতি সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ পর্যন্ত মোট আবেদনের সংখ্যা ৩৩২টি। যা মোট হতাহতের প্রায় ৪ শতাংশ। এ বিভাগ সূত্র আরও জানিয়েছে, মোট ৩৩২ জন আবেদনকারীর মধ্যে মোট ৭৫টি আবেদনের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত একজনও আর্থিক সহায়তা পাননি। 

আইন শাখার উপপরিচালক শেখ মতিয়ার রহমান জানান, অর্থ সহায়তা অনুমোদনের আগে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না তা তদন্ত করা হয়। এসব বিষয় তদন্ত করার জন্য জেলায় ও মেট্রো সার্কেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কমিটি রয়েছে। যেখানে পুলিশের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তদন্ত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির 

পরিবার ও ওয়ারিশদের সঠিকভাবে চিহ্নিত ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিরূপণ করে বোর্ডের কাছে পাঠায়। 

তিনি জানান, আগামী ২২ অক্টোবর প্রথমবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের এ অর্থ সহায়তা তুলে দেবেন। তাই এখনই কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। 

জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুমোদন হয় একই বছরের সেপ্টেম্বরে। এ আইনে ১৪২ থেকে ১৫৩ নম্বর ধারা পর্যন্ত অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য ট্রাস্টি বোর্ড ও আর্থিক তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিধিমালা না থাকায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়গুলো অস্পষ্ট ছিল। গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ আইনের বিধিমালা প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর মোটরযান থেকে তহবিলের জন্য চাঁদা সংগ্রহ ও ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে আবেদন শুরু করে বিআরটিএ। 

এ তহবিল গঠনে মোটরসাইকেলের মালিককে এককালীন এক হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের (বড় লরি) জন্য বার্ষিক দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বার্ষিক ৭৫০ টাকা, কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর থ্রি-হুইলার ও অন্যদের বার্ষিক ৩০০ টাকা চাঁদা দেয়। মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানের চাঁদা দেওয়ার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে গেলে প্রতি মাস বা মাসের অংশবিশেষের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হয়। 

বিধিমালা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে ৫ লাখ টাকা। আর দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে ভুক্তভোগী পাবেন ৩ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে পাবেন ৩ লাখ টাকা। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এক লাখ টাকা।

ক্ষতিপূরণের আবেদন জমা শুধু ঢাকায়

বিধিমালা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পেতে হলে দুর্ঘটনার ১০ দিনের মধ্যে আবেদন জমা দিতে হবে। এ আবেদন করতে হবে ১২ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর, যিনি বিআরটিএ’রও চেয়ারম্যান। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের দপ্তর ঢাকার বনানীতে অবস্থিত। সারা দেশে বিআরটিএ’র ৭১টি সার্কেল অফিস থাকলেও সেগুলোতে আবেদন গ্রহণ করা হয় না। বিষয়টি বিআরটিএ’র কয়েকটি জেলা সার্কেলের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

বিআরটিএ’র আইন শাখার উপপরিচালক শেখ মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আবেদন করতে হলে চেয়ারম্যান বরাবর করতে হবে। অন্য কোনো জায়গায় করার সুযোগ নেই। তারা চাইলেই ডাকে পাঠাতে পারেন। বেশি কষ্ট হয়ে গেলে আবেদন করার দরকার নেই।’

তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন, আবেদনের প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার।

তিনি বলেন, ‘আবেদন ফরম শুধু অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু যারা অক্ষরজ্ঞানহীন, তাদের জন্য হাসপাতাল, থানা ও বিআরটিএ কার্যালয়গুলোতে রাখা দরকার। পূরণকৃত ফরম বিআরটিএ’র আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিহতের স্বজনরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। এখন তাদেরকে যদি ঢাকায় এসে এসব কাজ করতে হয়, তবে তা খুবই দুঃখজনক।’

ক্ষতিপূরণ দিতে কেন এত দেরি

বিধিমালা অনুযায়ী দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। কর্মকর্তারা জানান, আবেদন গ্রহণের পর ট্রাস্টি বোর্ড সে আবেদন সংশ্লিষ্ট জেলা বা থানায় পাঠান। তদন্ত কমিটি তদন্ত করতে ৩০ দিন সময় পান। আর প্রতিবেদন প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে বোর্ড সহায়তার অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করবেন। 

কর্মকর্তারা বিধি অনুযায়ী আড়াই মাস লাগলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি সময় লাগছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যারা আবেদন করেছেন তারা এখনও টাকা পাননি। 

আইন শাখার কর্মকর্তারা জানান, আবেদনের তথ্য তদন্ত করার কোনো কমিটি ছিল না। প্রথমে বিআরটিএ সার্কেলের সহকারী পরিচালকদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা আবেদন তদন্ত করেন। পরবর্তী সময়ে গত ৫ জুলাই জেলা সার্কেলের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সহকারী পরিচালককে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। 

আর গত ৭ আগস্ট মেট্রো সার্কেলের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত), মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একজন করে প্রতিনিধি কমিটির সদস্য করা হয়। আর মেট্রো সার্কেলের ক্ষেত্রে সভাপতি থাকবেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আর বাকি সবাই জেলা সার্কেলের মতো একই পদের জনবল।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘বিধি আনুযায়ী একজন সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে অর্থ সহায়তা পেতে তিন মাস সময় লাগবে। আর বাস্তবে তো এরও বেশি। কিন্তু দুর্ঘটনায় আহত একজন ব্যক্তির দ্রুত সুচিকিৎসার জন্য দরকার অর্থ। অর্থ সময়মতো না পেলে আহত ব্যক্তি মারা যেতে পারেন। এতে এ অর্থ তার কোনো কাজে লাগবে না।’

সঠিক তথ্য না থাকায় বঞ্চিত হতে পারেন ভুক্তভোগী

আবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত ৫ আগস্ট রাত ১১টা ৩০ মিনিটে মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার বাসিন্দা আদিলুর রহমান জাতীয় হৃদরোগের ইনস্টিটিউটের সামনে মালবাহী ট্রাকচাপায় মারা যান। তার পক্ষে তার পিতা শাহাদাৎ হোসেন গত ১০ সেপ্টেম্বর ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন। তিনি দুর্ঘটনায় বিষয়ে শেরে-ই বাংলা নগর থানায় গত ৬ আগস্ট একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন, যার নম্বর ৩৭৬। 

কিন্তু বিআরটিএ’র হিসাবের খাতায় নেই এই দুর্ঘটনার তথ্য। সংস্থাটির দাবি, তারা পুলিশ, গণমাধ্যম ও নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু থানায় ডায়েরি করা সত্ত্বেও এ তথ্য তাদের নেই বলে জানায় খোদ বিআরটিএ’র রোড সেফটি শাখা। 

এ সংস্থা জানায়, তারা প্রতিটি জেলার জন্য আলাদা করে তথ্য সংগ্রহ করেন। এ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, আগস্ট মাসে ঢাকা জেলায় মোট সাতটি দুর্ঘটনার তথ্য তাদের কাছে আছে। ৫ আগস্টে কোনো দুর্ঘটনার তথ্য তার কাছে নেই।

একই ঘটনা ঘটেছে মৃত রাজু আহম্মেদের ক্ষেত্রে। তিনি গত ২৫ আগস্ট নরসিংদীর শিবচরে তাকে বহনকারী মাইক্রোবাস একটি ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান। তার মৃত্যুর ঘটনাটিও বিআরটিএ’র রেকর্ডে নেই। তার পক্ষে তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার আবেদন করেছেন। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে। তবুও নরসিংদীর জেলার ২৫ আগস্টের এ তথ্য নেই বিআরটিএ’র কাছে। 

এ বিষয়ে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘অনেকে থানায় যেতে চান না। ফলে তাদের কোনো রেকর্ড থাকে না। বিআরটিএ দুর্ঘটনার তথ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ না করলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার ক্ষতিপূরণ বঞ্চিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের রেকর্ড বিআরটিএকে সংগ্রহ করতে হবে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা