কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৬ এএম
পুড়ে যাওয়া মালামালের ওপর বসে আহাজারি করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর। শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট থেকে তোলা। ছবি : আলী হোসেন মিন্টু
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভোররাতে রহস্যময় আগুনের ঘটনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সলিমুল্লাহ সলু ও তার লোকজনকে সন্দেহ করছেন অনেক ব্যবসায়ী। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে মার্কেটটি ভেঙে ১২ তলাবিশিষ্ট বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সলু। কিন্তু দোকানদারদের বাধার মুখে তা সম্ভব হচ্ছিল না। তাদের উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা আরও দাবি করছেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, দোকানি ও ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। দোকানিদের কাছে ১ হাজার ৫০ টাকা করে নতুন আবেদন ফরম বিক্রি করা হচ্ছে। অনেকেই এখন দোকান বরাদ্দ পেতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
সলুর প্রতি অনেক ব্যবসায়ীর এমন সন্দেহ থাকার পরও কেউই প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। কারণ সলু কৃষি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। তার বিরুদ্ধে কথা বললে, নতুন করে দোকান বরাদ্দ পাওয়া বা মার্কেটে টেকা সম্ভব হবে না।
তবে ব্যবসায়ীদের সন্দেহের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি কেন? অন্যরাই-বা কেন আগুন লাগাবে? মার্কেটে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ছিল, যদিও সেটা পুড়ে গেছে, তবে দারোয়ান, নৈশপ্রহরী সবাই আছে। কেউ নাশকতা করলে সেটা অবশ্যই ধরা পড়ত।’
গতকাল শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) কৃষি মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী দাবি করেন, কৃষি মার্কেটের ভেতরে ও বাইরে কয়েকশ ভ্যানগাড়ি বসানো হতো। সলুর লোকজন প্রতিটি গাড়ি থেকে এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। এ ছাড়া দৈনিক নিতেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। মার্কেটের টয়লেট থেকেও প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা আদায় করত সলুর লোকজন। প্রত্যেক দোকান থেকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা আদায় করা হতো। ডিএনসিসির মালিকানাধীন এই কৃষি মার্কেট ঘিরে চাঁদাবাজি করে বিশাল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগে সেখানে নজর পড়ে সলুর।
পরবর্তী সময়ে সলু ডিএনসিসির সহযোগিতায় কৃষি মার্কেটের জমিতে ১২ তলা কমপ্লেক্স ভবন করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন ব্যবসায়ীরা। তারা নিজ নিজ দোকানের পজিশন ছাড়তে রাজি হননি। এ ছাড়া কমপ্লেক্স করার সময় যতদিন মার্কেট বন্ধ থাকবে, ততদিন বিকল্প জায়গা চান ব্যবসায়ীরা। বিকল্প জায়গা না থাকায় মার্কেটের পজিশন ছাড়ার বিষয়টি সুরাহা হয়নি।
কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলেন, বৃহস্পতিবার ভোরে পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে কাঁচাবাজারের প্রবেশমুখে হক বেকারিতে প্রথম আগুন দেখা যায়। একই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের আরও দুটি দোকানে আগুন দেখা যায়। শর্টসার্কিট বা কয়েলের আগুন হলে প্রায় একই সময় তিন স্থানে আগুন লাগা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা মার্কেটে পেট্রোল ছিটিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ করেন।
কৃষি মার্কেটের ‘খ’ ব্লকের রেডিমেড কাপড় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ‘মার্কেটের পাশেই আমার বাসা। প্রথমে যখন আগুন লাগে, তখন মানুষের চিৎকার শুনে আমি দ্রুত দৌড়ে দোকানে আসি। এসে দেখি মার্কেটের পূর্ব পাশে হক বেকারিতে আগুন লেগেছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিম পাশের উত্তর কোনায় আরেকটি দোকানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। একই সঙ্গে পশ্চিম-দক্ষিণ কোনার শেষপ্রান্তে আরেকটি দোকানে আগুন জ্বলে ওঠে। মার্কেট বন্ধ থাকায় কেউ মার্কেটে এসে পেট্রোল জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রায় একই রকম অভিযোগ করে প্রত্যক্ষদর্শী আলম হোসেন বলেন, ‘আগুন যেখানে লেগেছে, সেই জায়গা থেকে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। বৃহস্পতিবার ছিল মার্কেটের সাপ্তাহিক বন্ধ। যে কারণে পরিকল্পনা করে মার্কেটের শেষ প্রান্তের তিন পাশে আগুন লাগানো হয়েছে। এ জন্যই পুরো মার্কেটটি আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে।’ আরও কয়েক প্রত্যক্ষদর্শী একই কথা বলেছেন।
আগুনের উৎসের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কীভাবে আগুন লেগেছে, সেটা জানার জন্য তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে আগুন লেগেছে।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মার্কেটজুড়ে শুধুই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাহাকার। চারদিকে এখনও পোড়া গন্ধ। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানের মালামাল সরাচ্ছেন এবং সেগুলো থেকে বেঁচে যাওয়া পণ্যগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
আলী স্টোরের মালিক খোকন জানান, মার্কেটে তৈরি পোশাক, মনিহারিসহ বিভিন্ন পণ্যের তার ৫টি দোকান ছিল। সবকটি দোকানই পুড়ে যাওয়ায় তার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন কোটি টাকা। পরিবার আত্মীয়স্বজন থেকে ধারদেনার পাশাপাশি ব্যাংক লোন নিয়ে এসব দোকান করা হয়েছে। এখন তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
চাঁদনি স্টোর নামে দোকানের কর্মচারী আলমগীর জানান, কৃষি মার্কেট বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। শুক্র ও শনিবার বেচাকেনা বেশি হয়। তাই বুধবারে নতুন পণ্য তোলেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। বুধবার রাতেই আগুন লাগায় ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন সম্পর্কে কৃষি মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু বলেন, ‘আমাদের এখানে দোকান ছিল ৪৪০টি। (যদিও সিটি করপোরেশন বলেছে মার্কেটে দোকান সংখ্যা ছিল ৩১৭টি। পুড়েছে ২১৭টি)। স্বর্ণের দোকানই ছিল ১৮টি। মাছ বাজারের কিছু অংশ ছাড়া সব দোকানই পুড়ে গেছে। মার্কেট পুড়ে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানেন। তিনি শুক্রবার কৃষিমন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন। সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, সবাই আসছেন। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কত লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কার কত ক্ষতি সেগুলো নিরূপণের জন্য কাজ চলছে।
১২ তলা কমপ্লেক্স করার বিষয়ে সলু বলেন, ‘আপাতত আমরা সেটা চাই না। আমরা চাই এখানে আগের মতো টিনশেড দোকান করে যার যে ব্যবসা ছিল, সেভাবে পুনর্বাসন করা হোক। পোড়া-সামগ্রীগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেখানে কাজ করাও ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা যত দ্রুত সম্ভব পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র সরিয়ে দিতে চাই। যাতে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেখানে নতুন মার্কেট করা যায়। আমাদের মেয়র মহোদয় দেশের বাইরে আছেন। তিনি এলে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’