× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চিকিৎসাসেবকদের লোভের বলি রোগী-১

ডাক্তারদের পটাতে চেক বাড়ি গাড়ি সবই

শরীফুল রুকন, অতিথি প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৯:২৫ এএম

আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৩ ১৭:৩৫ পিএম

ডাক্তারদের পটাতে চেক বাড়ি গাড়ি সবই

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। এই চিকিৎসকের নামে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ৫ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করে চট্টগ্রামের ওষুধ কোম্পানি এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকটিতে এলবিয়নের পক্ষে সই করেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম নগরের ও. আর. নিজাম রোড শাখার ওই চেকের নম্বর ৮৪৭৩১০৫। চেকটি ২০২২ সালের ২ মার্চ নগদায়ন হয়েছে; অর্থাৎ ডা. গিয়াস উদ্দিনের অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা হয়েছে।

একই চিকিৎসকের নামে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি আড়াই লাখ টাকার একটি (চেক নম্বর ৯৭৯০৪৮৬) এবং একই বছরের ৩০ জুলাই আড়াই লাখ টাকার আরও একটি চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৬) ইস্যু করে এলবিয়ন। চেক দুটি আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকেরই চট্টগ্রামের মুরাদপুর শাখার। 

মাত্র তিন দফায় একটি ওষুধ কোম্পানি থেকেই ১০ লাখ টাকার চেক পাওয়া চিকিৎসক গিয়াস উদ্দিনের দেওয়া দুটি প্রেসক্রিপশন এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে তিনি এলবিয়নের ওষুধ ‘কুইটিনিল ১০০ মিলিগ্রাম’ এবং একই বছরের ৭ মার্চ আরেকজন রোগীকে এলবিয়নের ‘রিসলক ২ মিলিগ্রাম’ ওষুধ লিখে দিয়েছেন।

এফসিপিএস ডিগ্রিধারী ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণেও নিয়মিত রোগী দেখেন তিনি। এ চিকিৎসকের নামে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ৩ লাখ টাকার চেক ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের ও. আর. নিজাম রোড শাখার ওই চেকটির নম্বর ৭১৩১৯৮৮। চেকটি ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর নগদায়ন হয়েছে। এই চিকিৎসকের নামে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর একই কোম্পানির ইস্যু করা ২৪৯৭১৫৭ নম্বরের ৩ লাখ টাকার আরেকটি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক জমা হয় আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায়।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ কাশেমের নামে ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৫ হাজার টাকার একটি চেক ইস্যু করে সান ফার্মা। সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশ, ঢাকার মতিঝিল শাখার ওই চেকের নম্বর ০৭৭২৮৭৭।

এটি শুধু তিনজন ডাক্তার বা দুটি ওষুধ কোম্পানির বিষয় নয়। বরং বিষয়টি আরও অনেক গভীর ও বিস্তৃত। যার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে আমাদের অনুসন্ধানে। তবে দেশের সব ডাক্তার বা সব ওষুধ কোম্পানির প্রতিদিনের চেক লেনদেনের সব তথ্য জোগাড় করা যে অসম্ভব, সেটা সহজেই অনুমেয়। তবু দীর্ঘদিনের নিবিড় অনুসন্ধানে দুই-চারটা নয়, গুনে গুনে ৬৫টি চেকের কপি আমাদের হাতে এসেছে, যেখানে কেবল এলবিয়ন এবং সান ফার্মা থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ‘বড় বড়’ ৪৩ জন চিকিৎসকের নামে মোট ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৭২ হাজার টাকার চেক ইস্যু হয়েছে গত তিন বছরে (২০২২, ২০২১ ও ২০২০ সালে); আর বাকি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা আট বছরে (২০১২ সাল থেকে ২০১৯-এর মধ্যে)। আর যাদের নামে চেক, তাদের মধ্যে এমবিবিএস থেকে শুরু করে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আছেন। এমনকি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরাও আছেন তালিকায়। ডা. এ কে এম মহিউদ্দিন ভূঁইয়া নামে একজন চিকিৎসক দাবি করেছেন, এ রকম এক লাখ চেকের কপি তিনি দিতে পারবেন। (এই চিকিৎসকের পুরো বক্তব্য রয়েছে পার্শ্বপ্রতিবেদনে)।

এই টাকা কিসের? ওই চিকিৎসকরা কি ওষুধ কোম্পানি দুটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত? নাকি অন্য কোনো বৈধ পাওনার টাকা? অনুসন্ধান বলছে, না; ওই ৪৩ জন চিকিৎসকের কেউই এলবিয়ন বা সান ফার্মার মালিকানার সঙ্গে যুক্ত নন। তাদের বেশিরভাগই সরকারি চাকুরে বলে কেউ সেটা বৈধভাবে পাবেনও না। বাকি বেসরকারি চিকিৎসকদেরও সেই সুযোগ নেই; কারণ এলবিয়ন সম্পূর্ণ পারিবারিক মালিকানার এবং সান ফার্মা ভারতীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি দুটির ওয়েবসাইটেই এসব তথ্য রয়েছে। তাহলে কিসের টাকার লেনদেন এসব? এই প্রশ্নে খোদ ডাক্তার ও ওষুধ কোম্পানির লোকদের কী জবাব, সেটা রয়েছে পার্শ্বপ্রতিবেদনে। আমাদের দীর্ঘ অনুসন্ধান কী বলছে, সেটা আগে দেখে নেওয়া যাক।

অসুস্থ সংস্কৃতির কবলে স্বাস্থ্য

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছরের শেষদিকে তাদের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছিল, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের ২৪ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছেন। শুধু চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। ১৬ শতাংশ খানা (এক পাকে খাবার খান এবং একসঙ্গে বসবাস করেন এমন পরিবার) বিনা চিকিৎসায় থাকছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গত ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হয়, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৫৪ হাজার কোটি। আর এই স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশই খরচ হয় ওষুধ কেনা বাবদ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি।

চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের এক কর্মশালায় স্বাস্থ্য সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিটি ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদের অনেক দামি দামি গিফট দেয়। টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ দামি গিফট বন্ধ করা গেলে ওষুধের দাম এমনিতেই কমে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ বিতর্কিত। আমরা এটা খতিয়ে দেখব।’

একই অনুষ্ঠানে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে চাপ রয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে। সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের নেওয়া বিভিন্ন উপহার কমিয়ে দিতে হবে। অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং থেকে সরে এসে ওষুধ কোম্পানিগুলো যদি খরচ কমিয়ে দেয় তাহলে ওষুধের দাম কমে যাবে।

বিশ্বের অন্য কোথাও তো নয়ই, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকদের এভাবে উপহার নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটি না মানলে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা সনদ বাতিলের বিধান করেছে মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। 

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক- উভয় পর্যায়ের গবেষণা ও সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত-বক্তব্য বলছে, শুধু চট্টগ্রামভিত্তিক দুটি কোম্পানিই নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব ওষুধ কোম্পানিই হরদম মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে চলেছে ডাক্তারদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সদ্য সাবেক পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো সিনিয়র ডাক্তারদের টার্গেট করে উপহার-উপঢৌকন দেয়। তাদের অনুসরণ করে ঘুষ নেওয়া শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররাও। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের মাসোহারা তালিকায় ডাক্তারদের নাম লিখে রাখে। প্রতি মাসে তাদের নামে নির্দিষ্ট অঙ্কের চেক চলে যায়। বিনিময়ে ডাক্তাররা রোগীর প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওই কোম্পানির ওষুধ বেশি বেশি করে লেখেন। ডাক্তারদের মনিটরিং করে কোম্পানির লোকজন; তারা প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। ওষুধ কোম্পানিগুলো আবার সেই ঘুষের টাকা উসুল করে ওষুধের দাম বাড়িয়ে। অসহায় রোগীরা সেই দামি ওষুধ কিনে খেতে খেতে হয়তো নিঃস্ব; নয়তো কিনতে না পেরে নিঃশেষ হয়ে যান তিলে তিলে।’

অনুসন্ধানকালে আমরা উল্লেখিত ৪৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৪ জনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। তাদের মধ্যে ৪ জন চেক পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ব্যাখ্যা দেন নিজেদের মতো করে। ৪ জন স্বীকার-অস্বীকার কোনোটিই করেননি; ২ জন বলেছেন, চেক তাদের হাতে পৌঁছায়নি; ১ জন প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি; আর বাকি ৩ জন চেকের বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করে গেছেন। 

তিন দফায় ১০ লাখ টাকার চেক পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন সাগর এই প্রতিবেদককে গালিগালাজ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কার কাছ থেকে চেক নেব, কার কাছ থেকে নেব নাÑ সেটা আপনাকে বলতে হবে?... আপনি আমাকে ফোন করেন কেন?... ফাইজলামি পাইছেন! ... ফালতু কোথাকার!’

এর বাইরে আরও ৪ জন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাদের ২ জন নাম প্রকাশ করে, আর ২ জন নাম গোপন রাখার শর্তে এ রকম ঘুষ লেনদেনের ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। তবে নিজেরা দুর্নীতিমুক্ত থাকার দাবি করেছেন। এ ছাড়া বক্তব্যদাতা ৪ জন চিকিৎসক নেতার প্রত্যেকেই ‘ঘৃণ্য ঘুষ-সংস্কৃতি’র কথা নিশ্চিত করে এর নিন্দা জানিয়েছেন। অন্যদিকে ওষুধ কম্পানির মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ৯ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের প্রত্যেকেই ডাক্তারদের ‘উপহার’ দেওয়ার ঘটনা স্বীকার করেছেন। তবে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে যদি নিউজ করেন, দেখবেন, কালকে সকালেই ডাক্তাররা ধর্মঘট করবেন।’ 

চেকের ছড়াছড়ি এলবিয়নের

২০২১ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন পদে যোগ দেন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছিলেন। তার নামে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ৫০ হাজার টাকার অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের মুরাদপুর শাখার ওই চেকের নম্বর ৫৬৬১৩৪১। একই দিন নগদায়নও হয়েছে চেকটি। আরও আগে ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি ডা. ইলিয়াছকে একই ব্যাংকের আরেকটি চেকে ৫০ হাজার টাকার দেয় ওই কোম্পানি, যার নম্বর ৯৭৯০৫৩৮।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডা. মহিউদ্দীন এ শিকদারকে আড়াই লাখ টাকা করে মোট ৫ লাখ টাকার দুটি চেক দিয়েছে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার এই দুটি চেকের নম্বর ২৫১৬৭৭৭ ও ২৫১৬৭৭৮। প্রথম চেকটি ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ও পরেরটি ওই বছরের ৫ মার্চ ইস্যু করা।

খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডা. সৈয়দুল আলম কোরাইশী প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার রোগী দেখেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাটের জনতা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এ ছাড়াও বন্দরনগরীর ডেলটা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে রোগী দেখেন প্রতি সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবার। এই চিকিৎসকের নামে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ১ লাখ টাকার চেক (নম্বর ৫৬৬১৩৪৩) ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার সেই চেকটি ওই দিনই নগদায়ন হয়েছে।

ডা. মো. ইউসুফ ফারুকী পারভেজ ২০০৪ সালে চমেক থেকে এমবিবিএস পাস করে চেম্বার দেন বন্দরনগরীর রাহাত্তারপুলে এবং হাটহাজারীর আমান বাজারে। তিনি রোগীদের জন্য কোনো ফি নির্ধারণ করেননি; যে যা দেয়, তাই নেন। অসচ্ছল রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন। এজন্য ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাতিও অর্জন করেছেন। তার মানবিকতা তুলে ধরে ‘Steadfast to his oath’ (নিজের শপথে অটল) শিরোনামে ২০২০ সালের ৪ জুলাই একটি স্বনামধন্য ইংরেজি দৈনিক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমন একজন চিকিৎসককে ২০২২ সালের ৬ মার্চ ১ লাখ টাকার চেক দেয় এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের ও. আর. নিজাম রোড শাখার ওই চেকের নম্বর ৮৪৭৩১১৬। পরদিনই চেকটি নগদায়ন হয়।

চমেক হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সরোজ কান্তি চৌধুরীকে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি দেড় লাখ টাকার (নম্বর ৯৭৯০৪৫১); ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট আরও দেড় লাখ টাকার চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৯) দিয়েছে এলবিয়ন। দুটি চেকই আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার।

একই হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ দে’র নামে এলবিয়ন ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ১ লাখ টাকার চেক (নম্বর ৫৬৬১৩৪৪) ইস্যু করে, যা একই ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায় পরদিন নগদায়ন হয়েছে। তার নামে একই কোম্পানির ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি ১ লাখ টাকার আরেকটি চেক (নম্বর ৯৭৯০৪৪৮) এবং ওই বছরের ৮ আগস্ট আরও ১ লাখ টাকার চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৮) ইস্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। 

এভাবে বিভিন্ন চিকিৎসককে এলবিয়নের দেওয়া ৫৮টি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের কপি পেয়েছি আমরা। এর মধ্যে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এবং ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম মহিউদ্দিন ভূঁইয়ার নামে ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল ৩ লাখ টাকা; রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান লোহানীর নামে ৫০ হাজার করে ১ লাখ; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়বের নামে ৫০ হাজার করে ৫ চেকে মোট আড়াই লাখ টাকা দিয়েছে এলবিয়ন। এ ছাড়াও ডা. কাজী মো. আবরার হাসান, ডা. প্রতীক চৌধুরী, ডা. মো. শাহ আলম, ডা. সফিউল আলম, ডা. দিলীপ চৌধুরী, ডা. মঈনউদ্দিন চৌধুরী, ডা. সুরজিৎ রায় চৌধুরী, ডা. সৈয়দ মো. সৈয়দুল বাশার, ডা. মনীশ সাহা রায়, ডা. দোদুল দাস, ডা. জীবন চন্দ্র দাস, ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ডা. মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. ইলিয়াস তালুকদার, ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, ডা. রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী, ডা. মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া, ডা. ইফতেখার রিয়াজ চৌধুরী, ডা. উম্মে হাবিবা রহমান, ডা. নাসরিন ফারজানা সনি, ডা. এমরুল হোসেন, ডা. সুমিত রায় চৌধুরী, ডা. নারায়ণ দাস, ডা. হামিদা ইয়াসমিন জেসি ও ডা. আবদুল্লাহর নামেও বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়েছে এলবিয়ন। সবগুলো চেকেরই প্রয়োজনীয় সব তথ্য আমাদের কাছে আছে।

সান ফার্মার চেক আরও আগের

শুধু এলবিয়ন নয়, ডাক্তারদের হাতে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক তুলে দিচ্ছে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মাও। ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করা সান ফার্মা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চারটিরও বেশি উৎপাদন কেন্দ্রের মাধ্যমে ১০০টিরও বেশি দেশে দুই হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে আসছে। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্রে ৫০টির বেশি ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডাক্তারদের দেওয়া সান ফার্মার ৭টি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক আমাদের হাতে এসেছে। চেকগুলোর মধ্যে একটি ২০১২ সালে, বাকি ছয়টি ২০১৩ সালে ইস্যু করা।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডা. এম এ কাশেমের মতো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মো. সালাউদ্দিনের নামেও ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ২ হাজার টাকার চেক ইস্যু করেছে সান ফার্মা। এ ছাড়া ডা. শেখ মাহমুদুল হাসান, ডা. একেএম আফজাল, ডা. মো. কামরুজ্জামান, ডা. খালেদা আকতার ও ডা. মো. রাসেলের নামেও তাদের একই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চেক ইস্যু করেছে সান ফার্মা। তবে আমাদের হাতে আসা সান ফার্মার চেকগুলো শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদের হাতে পৌঁছায়নি। সান ফার্মার একজন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় তিনি চেকগুলো আর ডাক্তারদের মাঝে বিলি করেননি বলে দাবি তার।

ঘটনাচক্রে এলবিয়ন ও সান ফার্মার ইস্যু করা চেক আমাদের হাতে আসায় তাদের বিষয়টিই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা নেই। অন্য কোনো কোম্পানির চেক আমাদের হাতে এলেও একইভাবে তুলে ধরা হতো এই প্রতিবেদনে।

ব্যাংকেও চেক-অ্যাকাউন্ট কারসাজি

একটি ওষুধ কোম্পানির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘সাধারণত ওষুধ কোম্পানির প্রধান অ্যাকাউন্ট থেকে ডাক্তারদের চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয় না। ডাক্তারদের নামে চেক ইস্যু করতে বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ওই কোম্পানির নামে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব কাজে ব্যাংকও যতটুকু সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখে এবং কোম্পানিকে নানা কৌশলে সুরক্ষা দেয়। যেমন ডাক্তারদের চেক ক্লিয়ারিংয়ের বিস্তারিত তথ্য অনেক সময় অনলাইনে বা নিজেদের সার্ভারে রাখে না ব্যাংকগুলো। কিছু ক্ষেত্রে হিসাব বিবরণীতে অস্পষ্ট বিবরণ বা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর এই অ্যাকাউন্টগুলো আবার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।’

তিনি জানান, কিছু ওষুধ কোম্পানি আবার অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ডাক্তারদের টাকা দেয়। আবার এমন কিছু ডাক্তার আছেন, যারা নিজেদের নামে না নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যু করতে বলেন।

এ পরিচালকের কাছ থেকে আরও জানা যায়, ডাক্তারদের চেক দেওয়ার ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির একটা কৌশল হলো- ‘সেমিনার’ আয়োজন। তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে প্রশাসন যদি আমার কাছে জানতে চায়, ডাক্তারদের কেন টাকা দিলাম? আমি বলব, ওনাদের নিয়ে আমরা সেমিনার করেছি। এই সেমিনারে অতিথি হওয়ার জন্য, বক্তব্য দেওয়ার জন্য বা অংশগ্রহণ করার জন্য টাকা দিয়েছি। এমনও ঘটে, ওই সেমিনার আদতে হয়ইনি বা হলেও নামকাওয়াস্তে।’

আমাদের হাতে আসা ৬৫টি চেকের মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার কাছে পাঠালে যাচাই করে তারাও জানান, চেকগুলো যে ব্যাংকের যেসব শাখার নাম, রাউটিং নম্বর সঠিক আছে। আবার এমআইসিআর চেকে চেক নম্বর, শাখার রাউটিং ও অ্যাকাউন্ট নম্বরের আদলে নিচের লাইনে যেসব নম্বর থাকে, সেখানেও কোনো অমিল নেই। চেকগুলোতে স্বাক্ষরকারীর সইও অভিন্ন। তবু তারা বলেন, চেকগুলো সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা।

পরে এলবিয়নের ইস্যু করা চেকগুলোর ব্যাপারে জানতে গত ১৮ মে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) মো. রায়হান উদ্দিনের সহযোগিতা চাওয়া হয়। তিনি এক কথায় বলে দেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষ কেউ এভাবে ব্যাংকের চেক যাচাই করে দেখতে পারে না।’ তবে চেকগুলো আসল এবং সেগুলো নগদায়নও হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ-সংক্রান্ত প্রমাণাদিও সংরক্ষিত আছে।

বসে নেই অন্যরাও, বাড়ি-গাড়িও গিফট

এতক্ষণ যে দুটি কোম্পানির চেক বিতরণের প্রমাণ দেওয়া হলো, তারা খুব বেশি পরিচিত ওষুধ কোম্পানি নয়। বড় বড় বিখ্যাত আরও অনেক ওষুধ কোম্পানি আছে দেশে; আমাদের অনুসন্ধান বলছে, তারা আরও বেশি গিফট দেয় ডাক্তারদের।

২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা’ নামের সরকারি প্রকাশনার এক গবেষণা নিবন্ধে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ২৫ জন বিক্রয় প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘চিকিৎসকরা যাতে তাদের চিকিৎসাপত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লিখে দেন, সেজন্য চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা বাবদ ব্যয়ও বিপণন ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকে।’

উন্নয়ন সমীক্ষার ওই নিবন্ধেই বলা হয়, জরিপ করা ওষুধ কোম্পানিগুলো গত পাঁচ বছরে তাদের টার্নওভারের প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় করেছে পণ্য বাজারজাতকরণের পেছনে। ৯২ শতাংশ কোম্পানি তাদের ওষুধের প্রচারের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

ঢাকাভিত্তিক বিশেষায়িত ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ফোরপি মার্কেটিং কনসালট্যান্সি’র বরাত দিয়ে ইবিএল সিকিউরিটিজের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে স্কয়ার ফার্মা ৭৪.৮০%, ইনসেপ্টা ৫%, বেক্সিমকো ৫৩.৯০%, রেনেটা ৪৪.৭০% ও হেলথকেয়ার ৩৬.১০% ‘ডাক্তার রিচ’ করেছে। একই সময়ে ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’ করেছে- স্কয়ার ১৩.৮০%, ইনসেপ্টা ৭.৩০%, বেক্সিমকো ৬.৩০%, রেনেটা ৪.৭০% ও হেলথকেয়ার ৩.৩০%।” প্রেসক্রিপশন শেয়ার বেশি হলে বিক্রিও বেশি হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই টার্মগুলোতে আসলে কী বোঝায় জানতে চাইলে ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দেন- আগে একজন ডাক্তার একটি কোম্পানির ওষুধ লিখতেন না। কিন্তু যোগাযোগ করার পর থেকে লেখেন। এখন ওই ডাক্তারের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ভালো। এটাকে ‘ডাক্তার রিচ’ বলা হয়। আর ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’ হচ্ছে- ধরা যাক, একজন ডাক্তার এক রোগীর প্রেসক্রিপশনে মোট ২ হাজার টাকার ওষুধ লিখলেন। কোন কোম্পানির কত টাকার ওষুধ লিখলেন- সেটা দেখার জন্য প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। সেটাই ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’। আর একটা আছে ‘ডাক্তার লিভ’। এটার অর্থ- অনেক সময় ডাক্তারদের মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা মোটরসাইকেল বা অন্য গাড়িযোগে চেম্বারে দিয়ে আসেন। ওষুধ কোম্পানির ভাষায় আরেকটা আছে- ‘সিটি’ বা ক্যাশ ট্রিটমেন্ট। প্রত্যেকটা কোম্পানি তার লভ্যাংশের একটি অংশ প্রতি মাসে ‘সিটি’তে বিনিয়োগ করে, অর্থাৎ ডাক্তারকে ক্যাশ টাকা দেয়।

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প’ শিরোনামে ইবিএল সিকিউরিটিজের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৮ সালে মার্কেটিং বা বিপণন খাতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের খরচ হয়েছে ৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বেক্সিমকো ফার্মার ৪২ কোটি ৮০ লাখ, রেনেটার ৩৩ কোটি ৮০ লাখ, একমির ১৬ কোটি ৪০ লাখ ও ইবনে সিনার ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।’

ডাক্তারদের যে উপহার দেওয়া হয়, সেগুলোর ব্যয় কোন খাত থেকে করা হয় জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার আসাদ উল্লাহ বলেন, ‘ডাক্তারদের গিফট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে খরচগুলো হয়, সেগুলো প্রমোশনাল কস্ট থেকে আসে। তবে আমাদের গিফট তেমন কিছু নয়। কিছু ডেস্কটপ আইটেম থাকে, যেগুলো মূলত কোম্পানির ব্র্যান্ডিং করে। এসবের পাশাপাশি ডাক্তারদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও থাকে।’

২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন এরিস্টোফার্মার মার্কেট ইনফরমেশন অফিসার (এমআইও) মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের সবকিছুই দেয়। শীতকালে কম্বল, গরমকালে এসি; তারপর কুকার, ডিনার সেট, তৈজসপত্র। চাকরিকালে এসব আমি নিজের হাতে দিয়েছি।’

ওরিয়ন ফার্মার একজন বিপণন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডাক্তারদের অনারিয়াম সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, বার্ষিক- বিভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। যার রোগী যত বেশি, তার অনারিয়ামও তত বেশি। যে ডাক্তার দিনে ২০০ রোগী দেখেন, সেই ডাক্তার কোম্পানির জন্য সোনার হরিণ। তাকে গাড়ি দিলে লস নাই। কার্ডিয়াক ডাক্তারদের গাড়ি, ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। কেননা হার্টের ওষুধগুলো একবার লিখলে সারা জীবন খেতে হয় রোগীদের। তবে অনেক ডাক্তার আছেন, যারা কোম্পানির কোনো অনারিয়াম নেন না। শুধু ওষুধ সম্পর্কে তথ্য জানতে চান।’

ফ্ল্যাট, গাড়ি কোম্পানি কীভাবে কিনে দেয় জানতে চাইলে চট্টগ্রামভিত্তিক এক ওষুধ কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালক বলেন, ‘কিনে দিলে তো প্রমাণ থেকে যাবে। তা ছাড়া একসঙ্গে কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে দেওয়াও নানা কারণে সম্ভব না। এ কারণে ডাক্তাররা ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট, গাড়ি নিচ্ছেন। সেই লোন প্রতি মাসে শোধ করছে ওষুধ কোম্পানি। এ রকম অহরহ হচ্ছে।’

বিদেশ ভ্রমণের মুলা ঝুলিয়ে কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের ব্যবহার করছে জানিয়ে এই কোম্পানি-পরিচালক আরও বলেন, ‘আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসকদের নিয়ে একটি সেমিনার আছে। এটার জন্য এখন থেকেই ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে কোম্পানির প্রতিনিধিরা। কেউ বিমানের টিকিট করে দিচ্ছে, কেউ হোটেল বুকিং করে দিচ্ছে। বিমানের টিকিট ধরুন ৪০ হাজার টাকা আসবে। এই টিকিট করে দেওয়ায় ভ্রমণের আগ পর্যন্ত চিকিৎসক ওই কোম্পানির ওষুধ লিখবেন। সেই ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই কোম্পানি হয়তো ৪ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি করে ফেলবে।’

চট্টগ্রামে কর্মরত অপসোসিন ফার্মার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সিসিইউর কার্ডিওলজিতে প্রতিদিন অন্তত ৪০টি প্রেসক্রিপশনে আমাদের ওষুধ বিসলল থাকে। প্রতিদিন ৪০টি প্রেসক্রিপশন হলে বছরের ৩৬৫ দিনে ১৪ হাজার ৬০০টি প্রেসক্রিপশন। যে রোগী একবার বিসলল পাবেন, তিনি এক বছর, এমনকি আজীবন ওষুধটা সেবন করবেন। এই হিসাবে, বছরে শুধু চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি থেকেই বিসলল কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকার সেল হয়। শুধু বিসললের জন্য বছরে ৫০ লাখ টাকা চমেকে ঢেলে দিলে সমস্যা কী?’

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের এক বিক্রয় প্রতিনিধি নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এখন টিভি, ফ্রিজ, এসি, গাড়ির মতো গিফটের চাহিদা ডাক্তারদের পক্ষ থেকেই ওষুধ কোম্পানিকে পাঠানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সেসব ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। ভাতের চাল পর্যন্ত দিচ্ছে। ডাক্তারের চেম্বারের নামফলক, এসি, প্রেসক্রিপশন ছাপানো সবই করে দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানি। তবে সব ডাক্তার এমন, তা-ও নয়। ভালো মানুষও আছেন, তবে সংখ্যাটা নগণ্য।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘ধরুন, আমি একটা নতুন ওষুধ বের করলাম। এটা তো ডাক্তারকে জানতে হবে। এজন্য রিপ্রেজেন্টেটিভ দিয়ে ডাক্তার ভিজিট করাতে হয়। আমার বাড়ি বগুড়ায়। সেখানকার এক উপজেলায় এক ডাক্তারের নামে আমার কোম্পানি থেকে প্রত্যেক মাসে একটা অ্যামাউন্ট যায়। রিপ্রেজেন্টেটিভ দিয়ে আসে। আমি যখন সেখানে সার্ভে করার জন্য লোক পাঠালাম, দেখা গেল, ওই ডাক্তার দুই বছর আগে বদলি হয়ে গেছেন। তাহলে টাকাটা রিপ্রেজেন্টেটিভ খেয়েছে। জানার পর তাকে বিদায় করে দিই। এমনও ঘটে। শুধু ডাক্তারের দোষ দিই কীভাবে?’

‘আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সঙ্গে আপনাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে, যেখানে উল্লেখ আছে, ডাক্তারদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ওষুধ কোম্পানি একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ৫ লাখ, ৩ লাখ টাকাও ডাক্তারদের অহরহ দেওয়া হচ্ছে’- বিষয়টি তুললে ওষুধ কোম্পানির মালিকদের এই নেতা বলেন, ‘এটা হয়। কেউ কেউ করে। এটা খারাপ বলতে পারব। কিন্তু নেতা হিসেবে আমি রি-অ্যাকশনও বেশি দিতে পারি না।’ তবে তিনি বলেন, বড় বড় কোম্পানিগুলো যা করে, ছোট কোম্পানিগুলোর সেই সুযোগ নেই; যার কারণে ডাক্তাররা মিডিয়াম কোম্পানির, ছোট কোম্পানিগুলোর ওষুধ তেমন একটা লেখেন না।’

বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘চেক দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক। এটা কাম্য নয়। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কোম্পানিগুলো যেভাবে ডাক্তারদের মেনটেইন করছে, এটা খুবই অন্যায়। এভাবে করলে ডাক্তার তো আর ডাক্তার থাকে না।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ডাক্তারদের চেক নেওয়ার বিষয়টি নীতি-নৈতিকতাবিরোধী। দরকার হলে উপোস থাকব, চেক নেব কেন? এভাবে চেক নিলে চিকিৎসকদের মানসম্মান বলে কিছু থাকে?’ চেকের ফটোকপি পেলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা