× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উত্তর কালশী যেন ছিটমহল

মো. শাহজাহান

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৩ ১৩:১৩ পিএম

মিরপুর সিরামিক কারখানার পেছনে উত্তর কালশী এলাকা। এখানকার বাসিন্দাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। ছবি- আরিফুল আমিন

মিরপুর সিরামিক কারখানার পেছনে উত্তর কালশী এলাকা। এখানকার বাসিন্দাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। ছবি- আরিফুল আমিন

মিরপুর ১২ নম্বরে নাহার একাডেমি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে লগ্ন দাশ। মিরপুর সেনানিবাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে সে এই স্কুলে ভর্তি হয়। নতুন স্কুলে তার মন কিছুতেই টিকছে না। পুরোনো বন্ধুদের বেশিরভাগই আগের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ায় তার মন খারাপ। স্কুলে যাওয়ার জন্য তার বাড়ির পাশেই ছিল একটি পথ (গেট)। করোনার সময় সে পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার স্কুলে যাওয়া-আসা দুরূহ হয়ে ওঠে। আগে স্কুলে যেতে লাগত ১০ মিনিট। ওই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন অনেক পথ ঘুরে যেতে তার সময় লাগে প্রায় ৩৫ মিনিট। এই কারণে লগ্নের মতো অনেক শিক্ষার্থী এখন ওই স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে।

লগ্নর বাড়ি মিরপুর সিরামিক ওয়ার্কস লিমিটেড নামে একটি ফ্যাক্টরির পেছনে উত্তর কালশী এলাকায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় থাকা ওই এলাকার বাসিন্দাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। ওই ফ্যাক্টরির জায়গা ব্যবহার করে তাদের যাতায়াত করতে হয়। জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানাধীন থাকায় ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন মেনে চলাচল করতে হয় উত্তর কালশী এলাকার ৩০ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে। এ কারণে তাদের যাতায়াতের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ভোগে পড়তে হয়। 

লগ্নর মা প্রভারানী দাশ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এই বছর মার্চে মেয়েকে ভর্তি করেছি। অপেক্ষায় ছিলাম রাস্তাটা খুলে দিলে আগের স্কুলে ভর্তি করাব। কিন্তু শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে হলো। ক্যান্টনমেন্টের স্কুল অনেক ভালো ছিল। পড়াশোনার মানও খুব ভালো। এলাকার অন্য অনেক শিক্ষার্থী ওই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এত দূরে তাকে একা পাঠানো সম্ভব নয়। 

উত্তর কালশী এলাকা মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বরাদ্দকৃত এলাকা, যা প-ব্লক হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া রয়েছে হিন্দুপাড়া ও উত্তর কালশী ঘাঁটিপাড়া বস্তি। ওই পুরো এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বাইরে যাতায়াতের তিনটি রাস্তা ছিল। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকা আবাসিক হওয়ার পর দুটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এই এলাকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য সিরামিকের জায়গাই একমাত্র পথ। 

স্থানীয়রা জানান, সিরামিকের জায়গা ব্যবহারের জন্য ওই ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কোনো জিনিস বা আসবাবপত্র প্রবেশ বা বের করতে হয়। এ ছাড়া গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের জন্য নেওয়া লাগে অনুমতি। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রিকশা প্রবেশের নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া প্রাইভেট গাড়ি প্রবেশের জন্য সিরামিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। রাত ১২টার পর প্রবেশ বা বের হতে হলে নিরাপত্তাকর্মীর অনুমতি নিতে হয়।

ঘাঁটিপাড়া বস্তির বাসিন্দা আব্দুস সালাম। পেশায় চ-দোকানদার। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয়ে তার মেয়ে সাদিয়া আক্তার নবম শ্রেণিতে পড়ে। আব্দুস সালাম বলেন, আগে ওই পকেট গেট (রাস্তা) খোলা থাকায় আমার মেয়ে খুব সহজে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করত। এখন মেয়েকে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ১০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তার সব বান্ধুবী স্কুল ছেড়ে দিছে। এত দূর একা একা হেঁটে যাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, ‘মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য খুব কষ্ট করতে হচ্ছে। খরচ অনেক বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়ে নাই। এই গেট খুলে দিলে আমার মাসে তিন হাজার টাকা বেঁচে যেত। গেট বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমাদের আয়ও কমে গেছে। আগে আবাসিক এলাকার লোকরা এদিকে আসত বাজার করতে, এখন এদিকে কেউ আসে না। আগের মতো বিক্রিও হয় না।’

প্রায় ৩০ বছর উত্তর কালশী প-ব্লক এলাকায় থাকেন শরীফুল ইসলাম। যাতায়াতের বিষয়ে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা একটা ছিটমহলের মধ্যে থাকি। চারদিক থেকে আমরা বন্দি। এখান থেকে মেইন রোডে বের হওয়ার জন্য আগে মোট তিনটি গেট ছিল। মিরপুর ১২ নম্বর ডিওএইচএস এলাকায় বের হওয়ার জন্য একটি গেট ছিল। ওই এলাকা সেনাবাহিনীদের অধীনে যাওয়ার পর প্রায় ৮ বছর আগে গেটটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। উত্তর কালশী বস্তিতে একটি পকেট গেট ছিল, সেটাও করোনার সময় থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন এই একটা গেট দিয়ে যাওয়া আসা করা লাগে। এতে আমরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারি না।’

ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা চা-দোকানি চন্দনা সরকারের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের। তিনি বলেন, যেকোনো জিনিস ভেতরে প্রবেশ করতে হলে সিরামিক কারখানা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। ভাড়াটিয়ারা আসবাবপত্র ভেতরে প্রবেশ বা বের করলে অনুমতি নিতে হয়। আবার দোকানে বিক্রির জন্য কোনো জিনিস বাইরে থেকে আনলে অনুমতি নিতে হয়। এই জিনিসগুলোর তালিকা দিতে হয়। পরে ওই তালিকা অনুযায়ী নিরাপত্তাকর্মীরা সব কিছু মিলিয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার অনুমতি দেয়। 

তিনি বলেন, রাতে কারও অসুখ হলে আমরা রোগীকে ভ্যানে নিয়ে যাই গেট পর্যন্ত। পরে নিরাপত্তাকর্মীর অনুমতির পর বের হতে হয়। অনেক সময় তারা না থাকলে অপেক্ষা করতে হয়। তাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তারা অনুমতি দেয়। এখানে কোনো গাড়িও পাওয়া যায় না। আমরা অনেকটা ছিট মহলের মধ্যে আছি।’

১৯৭৪ সাল থেকে ওই এলাকায় থাকেন মো. মুসলিম। তিনি বলেন, আমাদের এই এলাকায় ওয়াসার পানির লাইন নেই। এনজিওরা বোরিং করে পানির পাম্প বসিয়েছে। অনেকে ব্যক্তিমালিকানা পাম্প বসিয়েছে। প্রত্যেক ঘরে বোরিং থেকে পানি দেওয়া হয়। মাসে ৩০০-৫০০ টাকার বিল দিতে হয়। গ্যাসও নেই এই এলাকায়। সিলিন্ডার বা খড়িতে রান্না করতে হয়।

গেটে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর সিরামিকের সিকিউরিটি ইনচার্জ শহীদুল আলম বলেন, ‘এটা পাবলিক রাস্তা নয়, ফ্যাক্টরির জায়গা। কিছু বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু আমরা জরুরি বিষয়ের ক্ষেত্রে রাতে যাওয়া আসা করতে দিই। যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটু রেস্ট্রিকশন না রাখলে আমাদের মালামাল চুরি হয়ে যায়। আগেও অনেক মালামাল চুরি হয়েছে। এলাকার কিছু মানুষ আছে যারা ফ্যাক্টরির জায়গায় মাদকসেবন করে। তাই আমরা যাওয়া আসার ক্ষেত্রে অনুমতিপত্র দিই। নজরদারিতে রাখি।’

এ বিষয়ে ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জায়গার জন্য আমরা হাউজিংয়ের সঙ্গে অনেকবার বসেছি। তারা এখনও আমাদের জায়গা দেয়নি। সেখানে সাগুফতা হাউজিংসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। তারা বলেছে রাস্তার জন্য জায়গা দেবে। তারা দিলে আমরা রাস্তা করতে পারব। এ ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। রাস্তার জায়গার জন্য সিরামিকের মালিকের কাছে গিয়েছিলাম। তারা মেট্রোরেলের জন্য জায়াগা ছেড়েছে আর ছাড়তে পারবে না। 

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকা ডিভিশন-১, মিরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী বলেন, ‘উত্তর কালশীর বাসিন্দাদের জন্য যে জায়গা দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা চলছে, সে জমির ওপর সাগুফতা হাউজিংয়ের সঙ্গে আমাদের মামলা চলছে। মামলা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ওই জমি সিটি করপোরেশনকে দিতে পারছি না। এই কারণে রাস্তাও হচ্ছে না।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা