× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মানুষের ঘাড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলার খড়গ

ফসিহ উদ্দীন মাহতাব ও শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৩ ১৩:০৬ পিএম

ফটো সংগৃহীত

ফটো সংগৃহীত

‘এক সাংবাদিক বন্ধু হঠাৎ করে জানাল, আট দিন আগে আমার নামে মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন ঢাকার হাতিরঝিল থানার এসআই আল-আমিন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলা হয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম মামলায় আমার সঙ্গে আরও ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি আমার অভিযোগ কী।

এজাহারে বলা হয়েছে, ফেসবুকে নাগরিক টিভি নামে একটি গ্রুপে আমার নাম আছে।’ বলছিলেন সংবাদ সংস্থা ইউএনবির অপরাধবিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি।

জাহাঙ্গীর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওই গ্রুপে আমি কখনও যোগ দিইনি। কেউ আমাকে সেখানে যুক্ত করে থাকবে। মামলায় গ্রুপটির কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্য কয়েকজন মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে ওই গ্রুপে।’ মামলাটি হয় গত ১২ এপ্রিল। ঈদের দুই দিন আগে। আর জাহাঙ্গীর জানতে পারেন ২০ এপ্রিল। 

তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ব ভাবতে পারিনি। খুব টেনশনে ছিলাম কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। ভয়ে ঘুমাতে পারিনি। বন্ধুদের কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল কয়েক দিনের জন্য কোথাও গিয়ে পালিয়ে থাকতে। কিন্তু পালিয়ে থাকা তো সমাধান না। পরে হাইকোর্টে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে আগাম জামিনের আবেদন জানাই। ২৬ মে জামিনের মেয়াদ শেষ। এখন চেষ্টা করছি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিন নেওয়ার।’

জাহাঙ্গীর মনে করেন, কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ ধরনের একটি মামলায় তাকে জড়িয়েছে। মামলাটি নিয়ে ভয়, শঙ্কা কাজ করে। তবে মামলাটির সঠিকভাবে তদন্ত হলে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে না বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে সেহেতু পরবর্তী সময়ে কী হবে, তাই নিয়ে শঙ্কায় আছি। মামলাটি নিয়ে শুধু আমি না, আমার পুরো পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পারিবারিকভাবে আমরা একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’

২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয়। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ আইনে ১ হাজার ৩০৫টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ৮৮৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১ হাজার ১১৯ জন আটক হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩০১ জন রাজনীতিবিদ, ১০৬ শিক্ষার্থী ও ৫১ জন শিক্ষক। মামলার প্রায় ৬০ শতাংশের মূলে রয়েছে ফেসবুক কার্যক্রম। এসব মামলায় আসামি হন সাড়ে তিন হাজারের বেশি। আটক হন প্রায় ১ হাজার ৪০০ ব্যক্তি। তাদের অধিকাংশ জামিনে মুক্ত হলেও কেউ কেউ এখনও কারাগারে আছেন। গত ১৪ জানুয়ারি এক ওয়েবিনারে এ তথ্য প্রকাশ করে সিজিএস।

আইনটি সম্পর্কে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘এ আইনের বেশ কয়েকটি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আমরা মনে করি বস্তুনিষ্ঠ, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, তথ্যনির্ভর ও সুস্থ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা কখনোই উচিত হব না। এটি গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক সাংবাদিক এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন। তাই আমরা অবিলম্বে এ আইনের যেসব ধারা সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, সেগুলোর সংশোধন চাই।’

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালেই এ আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি। এর অধিকাংশই ২৫, ২৬ ও ২৯ ধারায় হয়েছে। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ তিনটি ধারায় মামলা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দিতে এ আইনে মামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। মামলায় সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সিজিএসের তথ্য অনুযায়ী, গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩৮টির মামলা হয়েছে, যেখানে ২৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮৪ জন।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, ‘শুরু থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করে আসছে সাংবাদিক সমাজ এবং তারা তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এই আইনে পেশাদার সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আইনটি স্বাধীন, মুক্ত ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য যেহেতু হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে, সেজন্য আমরা অবিলম্বে এই আইনটি বাতিল চাই।’

এ আইনে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে ১৪০টি মামলা হয়েছে, যাতে ২১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৫ জন আটক হয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মানহানি করার অভিযোগে এ আইনে হওয়া অধিকাংশ মামলার বাদী তাদের কর্মী-সমর্থক। এ ছাড়া ফেসবুককেন্দ্রিক মামলা হয়েছে ৬৯৮টি। এগুলোর মধ্যে হয়রানির মামলা ৭৬টি, আর্থিক প্রতারণার ৪৪টি এবং ধর্মীয় অবমাননার ১১৫টি। বাকি ৪৬৩টি রাজনৈতিক মামলা।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এ আইনে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর ৪০ শতাংশই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, মন্ত্রী, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে ‘কটূক্তির’ অভিযোগে।

আর্টিক্যাল নাইনটিনের হিসাবমতে, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ২২৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৫৪ সাংবাদিক। এ ছাড়া এই সময়ে সব মিলিয়ে মামলা হয় ৫৭৩টি। গ্রেপ্তার হন ৪০৪ জন। সর্বশেষ প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার, সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ও নওগাঁয় ভূমি কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় এ আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে আবারও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন, প্রয়োজনে আইনের কিছু ধারা নিশ্চয়ই পরিবর্তন করা হবে। তবে বিভিন্ন মহল আইনটি সংশোধন নয়, বরং অবিলম্বে বাতিলের দাবি করে আসছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে এ আইনের কিছু ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে।

সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন ‘বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকি’ বিবেচনায় আইনটির ৯টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না, তবে সংশোধনী আনা হবে।’ বিরাট সংখ্যক মানুষকে হয়রানির পর মন্ত্রী মূলত দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তবু সংশোধন হচ্ছে না। বরং হয়রানি চলছেই।

স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে, ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ১৫০ থেকে ১৬০টি মামলা বিচারাধীন। সাজার হার শতকরা ৩৫ শতাংশ। বাকিগুলো আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। অনেক মামলার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খারিজ হয়ে যাচ্ছে। মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, মামলা নেওয়ার আগে পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। এরপরও সরকারের শীর্ষ পর্যায়, সংসদ সদস্য বা নেতাদের মানহানি হয়েছে এমন অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করা হচ্ছে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, যাদের অপরাধী বিবেচনা করা হচ্ছে তারা হয় সাংবাদিক, লেখক, না হয় শিক্ষক বা মানবাধিকারকর্মী। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে যত বিভাগেই ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হোক না কেন, অপব্যবহার বাড়ছেই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. গাজী সিরাজুল ইসলাম বলেন, মামলা দায়েরের সংখ্যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আইনটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অবিলম্বে আইন বাতিলের দাবি জানান তিনি। আগের আইসিটি আইন ও বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা সারা দেশের মামলাগুলোর বিচার শুরু হয় ২০১৩ সালে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে। অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে সাতটি বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে মামলা বাড়তে থাকায় বাড়ছে না বিচারের গতি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা