আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৩ ০৯:১৩ এএম
আপডেট : ০১ জুন ২০২৩ ১৫:২১ পিএম
কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের কালাদিয়া চরে একঝাঁক খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিল। প্রবা ফটো
অতি বিরল ও মহাবিপন্ন চামচঠোঁটি চাপাখির খোঁজে সকাল ১০টায় কক্সবাজারের ফিশারি ঘাট থেকে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি। বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে স্পিডবোট সোনাদিয়ার একটি চরের পলিমাটি স্পর্শ করল। দূরে বিস্তীর্ণ জলরাশি। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।
একটি পণ্যবাহী জাহাজ খানিকটা দূরে মাল খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তার আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বদরকৈতর আর গাঙচিল উড়ছে। বিস্তীর্ণ জলরাশি থেকে এক টুকরো ভূমি যেন আমাদের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে। আহ্ কি চমৎকার সে দৃশ্য! এটাই সোনাদিয়ার কালাদিয়া চর।
চরে নামার আগেই একটি ধূসর বককে স্থির দৃষ্টিতে শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। ওর ঠিক পেছনে মাথায় খোঁপাযুক্ত একঝাঁক গাঙচিলের দেখা পেলাম। কালাদিয়া চরের প্রথম লাইফার। সঙ্গে সঙ্গে স্পিডবোট থেকে পাঁচ-পাঁচটি লম্বা লেন্সের ডিএসএলআর ক্যামেরার শাটার গর্জে উঠল। প্রায় মিনিট দুয়েক এ গর্জন চলল। এর পর আমরা সবাই স্পিডবোট থেকে হাঁটুসমান কাদাপানিতে নেমে চুপি চুপি সামনের দিকে এগোতে থাকলাম ও ক্যামেরায় ক্লিক করতে লাগলাম। ক্লিক করতে করতে যখন পাখিগুলোর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি, তখন ওরা উড়াল দিল। দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ক্লিক করে গেলাম। ঘটনাটি ১৭ জানুয়ারি ২০২০-এর। সর্বশেষ ওদের সঙ্গে আবারও দেখা হলো এ বছরের ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি একই জায়গায়।
কালাদিয়া চরের দুর্লভ এই পরিযায়ী পাখিটি হলো খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিল। ইংরেজি নাম Greater Crested Tern, Large Crested Tern বা Swift Tern। ল্যারিডি গোত্রের গাঙচিলটির বৈজ্ঞানিক নাম Thalasseus bergii। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিলের দেহের দৈর্ঘ্য ৪৩-৫৩ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ১০০-১৩০ সেমি ও ওজন ৩২০-৪০০ গ্রাম। প্রজননহীন পাখির ছোট সাদা কপাল, মাথার মাঝখানটায় কালো ছিট এবং ঝুঁটিসহ পেছনের অংশ কালো। পিঠ ও ডানা ধূসর। ঘাড়-গলা ও দেহের নিচটা সাদা। কিন্তু প্রজননকালে মাথার পেছনের লম্বা ঝুঁটিসহ পুরো মাথা ঘন কালো হয়ে যায়। পিঠ ও ডানা হয় গাঢ় ধূসর। ঘাড়-গলা ও দেহের নিচটা থাকে সাদা। চোখের রঙ কালচে-বাদামি। লম্বা চঞ্চুটি সবুজাভ-হলুদ থেকে হলুদ। পা ছোট এবং পা ও পায়ের পাতা কালো। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। বড় আকার, শক্তপোক্ত হলুদাভ চঞ্চু, গাঢ় রঙের পিঠ ও সাদা কপালের (প্রজননকালীন) মাধ্যমে খোঁপাযুক্ত মাঝারি গাঙচিল থেকে পৃথক করা যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটায় প্রচুর বাদামি দাগছোপ থাকে।
শীতকালে পাখিটিকে সচরাচর চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূল থেকে দূরবর্তী দ্বীপ বা চরে একাকী বা ছোট দলে বিচরণ করতে দেখা যায়। পানির অল্প ওপর দিয়ে উড়ে হঠাৎ করে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মাছ ও চিংড়ি শিকার করে খায়। যেহেতু দীর্ঘক্ষণ ধরে উড়তে অভ্যস্ত, তাই প্রায়ই ওরা গভীর সমুদ্রে উড়ে চলে যায়। খাওয়ার সময় কর্কশ গলায় ‘চের্রাক…’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় সমুদ্র উপকূল থেকে দূরবর্তী দ্বীপ, নিচু প্রবালপ্রাচীর, উপকূলীয় দ্বীপ বা উপহ্রদের কাছে প্রজনন করে। বড় বা ছোট কলোনি গড়ে বাসা বানায়। দ্বীপের বালুর প্রাকৃতিক খোদল বা মৃত প্রবালের মাঝে বাসা তৈরি করে। বাসায় অনেক সময় মাছের কাঁটা পাওয়া যায়। সচরাচর একটি ডিম পাড়ে, মাঝেমধ্যে দুটিও পাড়তে দেখা যায়। ডিমের রঙ গাঢ় ছিটছোপসহ ঘিয়ে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ২৫-৩০ দিনে। ছানারা ৩৮-৪০ দিনে উড়তে শেখে। ওরা প্রায় চার মাস বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকে। আয়ুষ্কাল ১০-১১ বছর। লেখক : পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ