ইন্টারপোলের রেড নোটিস
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩ ০৯:০২ এএম
ফাইল ফটো
সরকার ঘোষিত ৯ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে প্রায় দুই দশক ধরে ঝুলছে ‘রেড নোটিস’। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ‘ওয়ান্টেড’ থাকা এসব ব্যক্তি কোথায় আছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে তাদের নামে ঝুলছে ‘রেড নোটিস’।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে ও পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি-ইন্টারপোল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৬২ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি আছে। তাদের মধ্যে ৯ মাস ধরে কারাবন্দি একজন আসামির নামও আছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের নাম আছে তালিকায়। যদিও তাদের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত হতে না পারায় তাদের রেড নোটিস প্রত্যাহার করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইন্টারপোলে প্রথম রেড নোটিস জারি হলে তার মেয়াদ থাকে পাঁচ বছর। প্রত্যেকটি নোটিস প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নবায়ন করা হয়। হারিছ চৌধুরী ও কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর বিষয়টি গণমাধ্যমে এলেও শতভাগ নিশ্চিত হতে না পারায় তাদের নামে নোটিস ইস্যু রয়েছে।
রেড নোটিস থাকা ৬২ জনের বেরিশভাগই হত্যা মামলার আসামি। সাতজন রয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। ২০০১ সালে সরকার পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী আছেন ৯ জন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পলাতক আসামি রয়েছেন সাতজন। জাল টাকা কারবারের মামলায় পলাতক আসামি আছেন আটজন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি তিনজন। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যায় জড়িত আসামি আছেন সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নেতা মিজান ওরফে বোমা মিজানসহ চারজন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বহুল আলোচিত ওই হত্যা মামলার পলাতক আসামি চন্দন কুমার রায়। লিটন হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর চন্দন কুমার রায়ের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। এরপর রেড নোটিস জারি করে ইন্টারপোল।
২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলন করে চন্দন কুমার রায়কে গ্রেপ্তরের ঘোষণা দেয় র্যাব এবং তাকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার পর আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাকে কারাবন্দি রাখার আদেশ দেন। প্রায় ৯ মাস কারাবন্দি থাকলেও চন্দন কুমার রায়ের বিরুদ্ধে এখনও রেড নোটিস ঝুলছে ইন্টারপোলে।
২০০১ সালে সরকার পুরস্কার ঘোষণার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ফেরদৌস জাহাঙ্গীর ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, জাফর আহম্মেদ জয়, জিসান আহমেদ, আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, সুব্রত বাইন, নবী হোসেন, আব্দুল জব্বার মুন্না ও প্রকাশ কুমার বিশ্বাসের নামে ‘ওয়ান্টেড’ হিসেবে রেড নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। দুই দশক পেরিয়ে গেলেও এসব সন্ত্রাসীর হদিস নেই। তারা কে কোথায় আছেন, নিশ্চিত হতে পারছে না পুলিশ সদর দপ্তর।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামি নূর চৌধুরী, আব্দুর রশীদ খন্দকার, নাজমুল আনসার, শরিফুল হক ডালিম, আহমেদ শরিফুল হোসাইন, খান মোসলেম উদ্দিন ও এম. রাশেদ চৌধুরীর নামে রেড নোটিস রয়েছে ইন্টারপোলে। এদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নানা কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। অপর চার আসামির অবস্থান জানা নেই পুলিশের।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মালায় পলাতক ফরিদপুরের নগরকান্দার জাহিদ হোসেন খোকন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ মো. হোসেন ওরফে মহসিন ও সৈয়দ মো. হাসেন ওরফে হাসেন আলী, ফিরোজপুরের আব্দুল জব্বার, চট্টগ্রামের একেএম ইউসুফ, ফেনীর আলাউদ্দিন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফরিদপুরের আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর নামে ঝুলছে রেড নোটিস। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক আসামি টাঙ্গাইলের মাওলানা তাজউদ্দিন মিয়ার নামেও রয়েছে রেড নোটিস।
মানব পাচার, জিম্মি করে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় ও প্রতারণার অভিযোগে রেড নোটিস আছে কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবাল, তানজীরুল ইসলাম, শিপন, মিন্টু মিয়া, মাদারীপুরের মোল্লা নজরুল ইসলাম ও ঢাকার সিরাজ মোস্তফা লালুর বিরুদ্ধে।
জাল টাকা ও ভারতীয় জাল রুপি তৈরির কারবারে সম্পৃক্ত থাকায় রেড নোটিস ঝুলছে খুলনার আজিজুর রহমান, অজয় বিশ্বাস, তরিকুল ইসলাম, কুমিল্লার হানিফ, নোয়াখালীর ফকির মো. সবুজ, নারায়ণগঞ্জের মনির ভূঁইয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শফিকুল ইসলাম ও গোপালগঞ্জের আব্দুল আলিম শরিফের বিরুদ্ধে। পর্নোভিডিও তৈরি ও বাজারজাত করার অভিযোগে রেড নোটিস রয়েছে টাঙ্গাইলের ওয়াসিমের বিরুদ্ধে।
রেড নোটিস রয়েছে বহুল আলোচিত মডেল তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির নামে। তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম রেড নোটিস ইস্যু হয়। এরপর থেকে পাঁচ বছর পরপর নোটিস নবায়ন করছে পুলিশ। তার অবস্থান অজ্ঞাত থাকলেও তিনি প্রায়ই ভিডিও কনফারেন্সে নিজ এলাকায় কথা বলেন। এমনকি ঈদ-জামাতেও বক্তব্য দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
এ ছাড়া চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে রেড নোটিস রয়েছে লক্ষ্মীপুরের খুরশিদ আলম, ঠিকানা অজ্ঞাত গিয়াস উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার আসামি টাঙ্গাইলের রাতুল আহমেদ বাবু, ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় জাহিদুল ইসলাম, হত্যা মামলায় সাজ্জাদ হোসেন খান, ফরিদপুর বোয়ালমারীর নাইমুল ইসলাম খান, গাজীপুরের বহুল আলোচিত আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার পলাতক আসামি নূরুল ইসলাম দীপু ও একই মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনুর নামে। বাংলাদেশি নাগরিক আরও যাদের নামে নোটিস আছে, তারা হলেন ফজলুল আমিন জাবেদ, ঢাকার রউফ উদ্দিন, প্রতারণার মামলায় আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, হত্যা মামলায় ঢাকার সালাহ উদ্দিন মিন্টু, পুলিশ হত্যা মামলায় শেখ হারুন, খুলনার সুলতান সুজিত ও ঢাকার তৌফিকুল আলম।
ইন্টারপোলের রেড নোটিস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মো. মনজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশি কিছু নাগরিকের নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিস আছে। কিছুদিন পরপর তালিকা হালনাগাদ হয়। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য জানার জন্য সময়ের প্রয়োজন।