গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:৫৩ এএম
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৭ পিএম
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ।
সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে কিশোর কুমার দাশ নামের এক স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি।
প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর ভিন্নধর্মী কাজের জন্য চলতি বছর সংগঠনটি পেয়েছে একুশে পদক। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কিশোর কুমার দাশ একুশে পদকপ্রাপ্তির অনুভূতিসহ সংগঠন গড়ার পেছনের কথা, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রমসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
‘পড়ব, খেলব, শিখব’ স্লোগান নিয়ে বিদ্যানন্দের পথচলা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। যার মধ্যে ছিল, ‘এক টাকায় আহার’। এই কার্যক্রমে পথশিশু, এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ পায়।
ইতোমধ্যে ৮০ লাখের বেশি মানুষকে খাবার বিতরণ করা হয়েছে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে। এ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে সাতটি এতিমখানা, দুটি স্কুল ও চারটি শিখনকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিদ্যানন্দ মা ও শিশু হাসপাতালের মাধ্যমে করোনা মহামারির সময় ৭০ শয্যার এই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে শত শত করোনা আক্রান্ত রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন। পরিবেশ রক্ষায়ও সংগঠনটি পরিচালনা করছে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। দুস্থ, দরিদ্র ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একুশে পদকপ্রাপ্তির অনুভূতি জানতে চাইলে কিশোর কুমার দাশ বলেন, অনুভূতি অবশ্যই ভালো। তবে সেটা পুরস্কারের জন্য নয়। বরং যে মানুষগুলো দিনের পর দিন নানা কটূক্তি আর সমালোচনা সহ্য করে কাজ করে গেছে গরিবের জন্য, যে মানুষগুলো মাসের শুরুতে আয়ের একটি অংশ পাঠিয়ে দিয়েছেন গরিব মানুষের জন্য, সে মানুষগুলোর কাজ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে বলে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকার এই পদকের মাধ্যমে বিদ্যানন্দকে নয়, সম্মানিত করেছে মানুষের ভালো কাজগুলোকেই। এই প্রাপ্তির অনুভূতি শুধু আমাদের নয়, বরং এই প্রতিষ্ঠানে শ্রম দেওয়া সকল স্বেচ্ছাসেবক, দাতা আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনকে স্পর্শ করলেই পদকপ্রাপ্তি সার্থক হবে।
তার কাছে জানতে চাই বিদ্যানন্দের যাত্রা শুরুর কথা। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর। নারায়ণগঞ্জে আমার নিজের গ্রামে শুরু করি। নিজেও এত কিছু চিন্তা করে শুরু করিনি। প্রবাসে থাকি। শৈশবে অনেক আর্থিক কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছি। তাই গরিবের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি সব সময়। প্রথমে আমার দিদিকে বলেছিলাম। সে চাকরি ফেলে মাদুর পেতে জেলে পাড়ার শিশুদের পড়ানো শুরু করে। চট্টগ্রামে বন্ধু নাফিজ আর ঢাকায় সহপাঠী ফারুখ একইভাবে পথশিশুদের পড়ানোর কাজ শুরু করে। ‘আনন্দের মাধ্যমে শেখা’- এই স্লোগান থেকেই বিদ্যানন্দ নাম। মিরাজ হোসেন নামে একজন ব্র্যান্ড এক্সপার্ট নামটি দেন। খারাপ লাগে অনেকেই যখন বিদ্যানন্দ নামকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে বিতর্কিত করতে চায়। শুরুতে সমস্যা না হলেও যখন বিদ্যানন্দ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের মানুষের ভালো করে যাচ্ছে, তখনই বিদ্যানন্দ নাম এবং আমার ধর্মীয় পরিচয় টেনে খারাপ কথা বলে যায়। এতে নিজে যেমন বিদ্ধ হয়েছি, পদত্যাগও করতে চেয়েছি একাধিকবার। তবে কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের মনোবল ধরে রাখতে নিভৃতে কাজ করে গেছি। কারণ বিদ্যানন্দ কাজ দিয়েই সমালোচনার জবাব দেয়।
সংগঠনের শুরুর সময়কার কাজ এবং বর্তমানের কাজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না জানতে চাইলে কিশোর কুমার বলেন, কী করব আর কী করব না, এত কিছু ভেবে শুরু করিনি। যখন যেটা প্রয়োজন মনে হয়েছে, আমি সেটাই করেছি। বিদ্যানন্দের যাত্রা পড়ালেখা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মেধার ও পেশার মানুষ যুক্ত হওয়ায় আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রজেক্ট শুরু করি। যেমন আমার নিজের অভাব থেকে এক টাকায় আহার আইডিয়া, আমাদের ডাক্তার স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে এক টাকায় চিকিৎসা, আমাদের ভার্সিটি পড়ুয়া স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে স্কুল প্রজেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে বিদ্যানন্দের ওয়েবসাইট, চার্টার অ্যাকাউন্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের একজনকে পেয়েছিলাম যিনি অডিট শুরু করেন, এভাবেই প্রতিষ্ঠানের এত বড় হওয়া। তবে আমরা যা কিছুই করি না কেন, মূলনীতি থেকে কখনও সরিনি। আমরা ইটপাথরের প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইনি। হয়তো ভবিষ্যৎ বিদ্যানন্দ থাকবে অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এই যাত্রা লাখো মানুষকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করবে, মানুষ ও প্রাণীর প্রতি সহনশীল করবে। এটাই আমাদের চাওয়া।
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে নিয়ে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করলেও বিদ্যানন্দর প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশকে নিয়ে একটা পর্যায়ে শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিতর্ক। সেই সময়গুলো কীভাবে সামাল দিয়েছিলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে কিশোর কুমার বলেন, আমরা মানুষ, সুপারম্যান নই। তাই আমাদের নিয়ে সমালোচনা থাকবেই। সমাজের ট্যাবু কিংবা অসংগতি নিয়েই বিদ্যানন্দ কাজ করে। এটা সবাই পছন্দ করবেন, এমন না। আমরা যেটা ভালো মনে করেছি, সেটাই করেছি। আমাদের এই পাগলামি মানুষ অপছন্দ করলে, বিতর্ক যখন হয়েছিল, তখনই তো প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যেত। সমালোচনা যে একেবারেই ক্ষতি করেনি, তা কিন্তু না। অনেক স্বেচ্ছাসেবক এবং দাতা ভুল বুঝে সরে গেছেন। কেউ আবার ঠিকই বিশ্বাস করেছেন। এই বিশ্বাসই বিদ্যানন্দকে টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের একজন স্বেচ্ছাসেবীও যদি মানুষের জন্য কাজ করে, তার জন্য হলেও বিদ্যানন্দ টিকে থাকবে।
আলোচনার এ পর্যায়ে জানতে চাই, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত। কিশোর কুমার বলেন, সংগঠনের চরিত্র কেমন হবে, সেটা বিদ্যানন্দ ঠিক করবে না। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতার নীতিতেই গড়ে ওঠে। সে নীতি কারও ভালো না লাগলেও তিনি সংগঠনে যতক্ষণ থাকবেন, তাকে সেই নীতিকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
সংগঠনটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিশোর কুমার বলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন বিদ্যানন্দ শুরু হয়নি, তেমনি এখনও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি না। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা মানুষকে লোভী করে। আর লোভ করলে সেই মানুষ দিয়ে চ্যারিটি হবে না। আমরা তাই ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে দূরে থাকি। দাতারা যেহেতু বর্তমানের জন্য অনুদান দেয়, সেহেতু ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সম্পদ বানানোর ইচ্ছা বিদ্যানন্দের নেই। প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হবে, এমন চিন্তাও কখনও করি না। আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করি, একদিন আমাদের থামতে হবে। সেই বিদায়টা যেন সুখের হয়। এটাই নিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা।